প্রসঙ্গ: পূর্ব লন্ডনে ছাত্রী ধর্ষক আরবী শিক্ষকের কারাদণ্ড
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ০৪ এপ্রিল, ২০১৬, ১০:০৮:৩১ রাত
তাইছির মাহমুদ : চৌদ্দ বছরের এক কিশোরীকে যৌন নির্যাতনের দায়ে পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীনের বাসিন্দা এক আরবী শিক্ষকের উনিশ বছরের জেল হয়েছে। সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর এ খবরটি মূলধারার বিভিন্ন মিডিয়াসহ লন্ডনের বাংলা সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছে।
প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ওই কিশোরী পূর্ব লন্ডনে মুহাম্মদ ইসলাম নামে ৩১ বছর বয়স্ক এক গৃহ শিক্ষকের কাছে আরবী পড়তো। সে তার শিক্ষক কর্তৃক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে বিষয়টি পরিবারকে জানায়। কিন্তু মা-বাবা তাতে গুরুত্ব দেননি। এমনকি তারা তার কথা বিশ্বাস পর্যন্ত করেন নি। এমতাবস্থায় মেয়েটির ওপর প্রায় পাঁচ বছর যৌন নির্যাতন চলে। এক পর্যায়ে কিশোরী অন্তস্বত্তা হয়ে পড়ে এবং সে যৌন নির্যাতনের বিষয়টি পরিবারের কাছে প্রমাণের জন্য সন্তান জন্ম দেয়। অবশেষে পরিবারের টনক নড়ে। বিশ্বাস হয়- তাদের মেয়ে গৃহশিক্ষক কর্তৃক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষক গ্রেফতার হন। বিচার শুরু হয়। অবশেষে আদালতের রায়ে তিনি উনিশ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হন। বাংলা সংবাদপত্রে খবরটি প্রকাশের পর বিষয়টি ছিলো টক অব দ্য কমিউনিটি।
খবরটি আমাদের কমিউনিটির জন্য নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। বৃটেনের মতো দেশ- যেখানে শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে সেখানে এমন একটি ঘটনা আমাদের সকলকে ভাবিয়ে তোলে। ঘটনাটি প্রমাণ করে এ ধরনের ঘটনা কমিউনিটিতে আরো ঘটছে। এই ঘটনাটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় সংবাদপত্রে খবর এসেছে। কিন্তু হয়তো ছোট-খাটো অনেক ঘটনাই ঘটছে যেগুলোর খবর কেউ জানে না। কোনো পরিবারে ঘটে থাকলেও মান সম্মানের কথা ভেবে বিষয়টি ছেপে যাওয়া হচ্ছে। তাই সেটি পুলিশ পর্যন্ত গড়াচ্ছে না। মিডিয়ায়ও আসছে না।
যৌন নির্যাতনের এ ঘটনার জন্য ওই আরবী গৃহশিক্ষককে যতই তিরস্কার করা হোক, পাষন্ড ও অমানুষ বলে যতই ধিক্কার জানানো হোক; কিশোরীর অভিভাবককে কিছুতেই ক্ষমা করা যাবে না। তারা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন।
নিজের মেয়ে এমন একটি স্পর্শকাতর অভিযোগ করলো, আর তারা তা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিলেন। অবশেষে মেয়েকে সত্য প্রমাণ করতে অবৈধভাবে গর্ভধারণ ও সন্তান জন্ম দিতে হলো। ভাবতে লজ্জা লাগে। তাহলে সন্তানের ওপর অভিভাবকের দায়িত্ব কী। সন্তানকে তারা কীভাবে লালন পালন করছেন? এ ধরনের অভিভাবককে পিতা-মাতা হিসেবে পরিচয় দেয়া যেকোনো সন্তানের জন্যই লজ্জাকর।
লন্ডনে বাঙালি কমিউনিটিতে বহু পরিবারে শিশুদের জন্য আরবী গৃহশিক্ষক রাখা হয়। প্রথমত এই শিক্ষকদের ডিবিএস (ডিসক্লোজার এন্ড ব্যারিং সার্ভিস-যা এক সময় সিআরবি নামে পরিচিত ছিলো) সার্টিফিকেট আছে কি-না সেটা কেউ দেখেন না। শিক্ষকের ব্যক্তিগত চরিত্র কেমন? শিক্ষাগত যোগ্যতা কতটুক- তা খুঁজে দেখা হয় না। পড়ানোর কোনো অভিজ্ঞতা আছে কি-না তাও দেখার প্রয়োজন মনে করা হয় না। ওই শিক্ষক লন্ডনে কোথায় থাকেন? তাঁর বাংলাদেশের ঠিকানা কী- তাও জানেন না। সম্পুর্ণ অজানা এক ব্যক্তিতে নিজের ঘরে নিয়ে সাবালিকা মেয়েকে পড়াতে দেয়া হয়।
এমন অনেক পরিবার আছে, যে পরিবারের মা কিংবা দাদী হাঁট-বাজারে ধুমধাম শপিং করে থাকেন। পুরুষের ভীড়ে বেপরোয়া চলাফেরা করেন। এতে তাঁদের কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু নিজ ঘরে আরবী শিক্ষক বা মাওলানা সাহেবের সম্মুখে বের হতে সংকোচবোধ করেন। নিজের সাবালিকা কিশোরী মেয়েকে আরবী শিক্ষকের কাছে নির্জন রুমে পড়তে দেন। কিন্তু তিনি ভুলেও শিক্ষকের সামনে অথবা ওই রুমে প্রবেশ করেন না। মনে করেন পর্দার খেলাফ হবে। অথচ তাঁর চেয়ে তাঁর কিশোরী মেয়েরই পর্দার বেশি প্রয়োজন। তাছাড়া, একটি সাবালিকা মেয়ের জন্য তার মা ও বোনই হচ্ছেন সবচেয়ে নিরাপদ সঙ্গী। এমনকি জ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে ছেলে-মেয়েদেরকে এক বেডে রাখতে নিষেধ করা হয়েছে।
আরবী শিক্ষক তো আর ফেরেশতা নন, রক্তে মাংশের একজন মানুষ। শয়তান তার সঙ্গেও আছে। যেকোনো সময় তাঁর পদস্খলন ঘটতে পারে। তিনি আলেম, তিনি পীরে কামেল, তার কাছে আমার সাবালিকা মেয়ে নিরাপদ- এটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত ছেলে মেয়েদেরকে কখনো অভিভাবকের দৃষ্টির বাইরে রাখা সমিচিন নয়।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মসজিদগুলোর দেখভালের জন্য কাউন্সিল অব মস্ক নামে একটি সংগঠন আছে। যে সংগঠনটি মসজিদগুলোকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে থাকে। একজন শিক্ষকের ব্যাপারে প্রাথমিক তথ্য যাচাই-বাছাই করে এই সংগঠনটিও সার্টিফিকেট দিতে পারে।
এছাড়া ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইস্ট লন্ডন মসজিদ এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টারও কাজটি করতে পারে। যখন কারো গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন হবে তখন তারা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ করবেন। তারা তাদেরকে শিক্ষক সরবরাহ করবেন। তখন এক সঙ্গে দুটো বিষয় হবে। একটি হচ্ছে, সরকারী চারিত্রিক সনদপত্র ‘ডিবিএস’ তো আছেই, উপরন্তু সামাজিক সনদপত্র থাকবে। কারণ শুধু সরকারী চারিত্রিক সার্টিফিকেট দিয়ে কারো চরিত্র শতভাগ ভালো- এই নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। ডিবিএস সার্টিফিকেট দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যাবতীয় পুলিশ রেকর্ড পর্যালোচনা করে। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানী কিংবা অন্য কোনো অভিযোগ পুলিশে কিংবা অন্য কোনো অথরিটির কাছে আছে কি-না সেই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে ডিবিএস সার্টিফিকেট দেয়া হয়।
তবে কোনো ব্যক্তি যদি যৌন হয়রানী কিংবা অন্য কোনো অপরাধের সাথে জড়িত থাকেন এবং বিষয়টি পুলিশে রিপোর্ট না হয়ে থাকে তাহলে তো তিনি পুলিশের খাতায় ধোঁয়া তুলসি পাতা, পুত-পবিত্র একজন মানুষ। তাই ওই শিক্ষকের ডিবিএস সার্টিফিকেট দেখার পাশাপাশি তাঁর সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ খবর নেয়া অত্যাবশ্যক। অর্থাৎ সামাজিক সার্টিফিকেট প্রয়োজন।
তাই কাউন্সিল অব মস্ক ও ইস্ট লন্ডন মসজিদ চাইলে স্কুলের সাপ্লাই টিচারের মতো কিছু শিক্ষকের বায়োডাটা যাচাই-বাছাই করে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের ঠিকানা, লন্ডনের ঠিকানা, লেখাপড়া, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ছাত্রজীবন, শিক্ষাজীবন, প্রবাস-জীবন ইত্যাদি পর্যালোচনা শেষে যদি তাঁকে শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য নিরাপদ ও যথোপযুক্ত মনে করেন তবেই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করবেন। তখন কেউ গৃহ শিক্ষকের জন্য যোগাযোগ করলে তাঁকে অপেক্ষমান তালিকা থেকে একজন শিক্ষক দেয়া যেতে পারে।
কাউন্সিল অব মস্ক কিংবা ইস্ট লন্ডন মসজিদ এই দুটো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে কেউ এই দায়িত্বটি নিতেই হবে। নেয়াটা জরুরী। নতুবা এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে এবং কমিউনিটির দুর্নাম হবে। মসজিদের ইমাম তথা আলেম সমাজের সম্মানহানী ঘটবে। তাই সকলের স্বার্থেই বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া উচিত।
তবে আজকাল ঘরে আরবী শিক্ষক রেখে সন্তানদের পড়ানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ পূর্ব লন্ডনে অনেক মানসম্পন্ন ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। নিজের ছেলে-মেয়ের ইসলামি শিক্ষার জন্য সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানটি খুঁজে বের করতে অনেক উইক এন্ড স্কুল ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। কমার্শিয়াল রোডের আল-ইহসান একাডেমি, এসপায়ার একাডেমি, ইস্ট লন্ডন মসজিদ ইভনিং মাদ্রাসা, দারুল উম্মাহ ইভনিং মাদ্রাসা, কুরতুবা ইন্সটিটিউট, তানজিল উইক এন্ড স্কুলের নাম এখানে উল্লেখযোগ্য। আমার বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর লেখাপড়ার মান বেশ ভালো। আধুনিক পরিবেশে নিজস্ব শিক্ষা কারিকুল্যাম অনুযায়ী ইসলামি শিক্ষা দেয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে একজন হেড টিচার থাকেন। বৃটেনে সুশিক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষিকারা থাকেন। দুই তিনশত শিক্ষার্থী থাকেন। শিক্ষকদের ডিবিএস সার্টিফিকেট বা চারিত্রিক সনদপত্র থাকে। তাই যৌন হয়রানীর মতো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আশংকা থাকে না। তাই আমার মতে উইক এন্ড স্কুলগুলো সন্তানের ইসলামিক শিক্ষার জন্য উপযুক্ত ও নিরাপদ।
তবে এই উইক এন্ড মাদ্রাসাগুলোতে ইসলামী শিক্ষার জন্য সমন্বিত কোনো সিলেবাস নেই। টাওয়ার হ্যামলেটসে যেহেতু অনেকগুলো মাদ্রাসা রয়েছে, তাই একটি সমন্বিত সিলেবাস প্রণয়ন করা অতি জরুরী। এতে করে আরবী শিক্ষা ক্ষেত্রে আরো প্রাতিষ্ঠানিকতা আসবে। শিক্ষার মানও উন্নত হবে। কাউন্সিল অব মস্ক, ইস্ট লন্ডন মসজিদ, দারুল উম্মাহ, ব্রিকলেন মসজিদ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে একটি সমন্বিত সিলেবাস প্রণয়ন সম্ভব হতে পারে। আমার অনুসন্ধানে টাওয়ার হ্যামলেটসে এমন কিছু ইভনিং স্কুল রয়েছে যেখানে সন্তানদের আরবী পড়তে পাঠানো সময়ের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। সপ্তাহে সোম থেকে শুক্রবার পাঁচ দিন বিকেলে দুই ঘন্টা করে আরবী এবং বাংলা শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। দুজন শিক্ষক মিলে ৩৫/৪০ জন জন্য ছাত্রকে আরবী ও বাংলা পড়ান।
প্রতি শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে দুই পাউন্ড করে ফি দিতে হয়। অর্থাৎ চার সপ্তাহ বা সারামাসে একটি শিশুর শিক্ষার জন্য ৮ পাউন্ড খরচ করেন অভিভাবক। এই আট পাউন্ড খরচ করে আসলে ঘোড়ার ডিম ছাড়া তেমন কিছু মেলেনা।
অনেক সেন্টার দেখেছি, যেখানে শিক্ষকেরা পান-সুপারী ও চা-বিস্কিট খাওয়া, পত্রিকা পড়া আর টেলিফোনে রাজনৈতিক আলাপচারিতা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। পড়ালেখা হয় খুবই কম। অভিভাবকেরা সন্তানদের সেন্টারে পৌঁছে দেন। দুই ঘন্টা পরে গিয়ে নিয়ে আসেন। সেন্টারে কী পড়ানো হচ্ছে, সন্তান দুই ঘন্টায় কী শিখলো- এসবের মোটেও কোনো খোঁজ রাখেন না।
অথচ শিশু বয়সে ইসলামী শিক্ষা কতটুকু অপরিহার্য তা আমরা প্রত্যেকেই বুঝি। কারণ একটি শিশুর আরবী শিক্ষার মুখ্য সময় হচ্ছে তার বাল্য বয়স। স্কুল কলেজে পাড়ি দেয়ার পর আর তার আরবী পড়ার মনমানসিকতা, সুযোগ ও পরিবেশ থাকে না। তাই এই মক্তবের যথসামান্য শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই তার জীবনের বিশাল ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয়। তাই শিশু বয়সে যদি উপযুক্ত ইসলামি শিক্ষা দেয়া না হয়, তাহলে বড় হওয়ার পর সে ইসলাম ব্যাপারে অজ্ঞ থেকে যায়, যদি সে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা না করে।
সর্বশেষ যে বিষয়টি বলতে চাই, সন্তানেরাই হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত সম্পদ। এই সম্পদেই আমাদেরকে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করতে হবে। কারণ সন্তান যদি বিপথগামী হয় তাহলে জীবনে তার চেয়ে আর অশান্তির কিছু নেই।
ব্যাংকে টাকার পাহাড়, লন্ডনের অভিজাত এলাকায় একাধিক বাড়ি, বাংলাদেশে বিশাল হাউজিং প্রকল্প, ফাইভ স্টার হোটেলের ডাইরেক্টর, গ্রামের বাড়িতে বিশাল অট্রালিকা- কিন্তু সন্তানের ইসলামি শিক্ষার জন্য মাসে ৮ পাউন্ড ব্যয়ও যেনো বড়তি খরচ মনে হয়। ব্যাংক ব্যালেন্স কমে যাবে তাই সন্তানকে ভালো স্কুল কলেজে পাঠানো হয় না। প্রাইভেট পড়তে দেয়া হয় না। অথচ সন্তানের জন্যই সর্বোচ্চ ব্যয় হওয়া উচিত ছিলো।
বিষয়: বিবিধ
১২৮৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন