মায়ের চবিবশতম মৃত্যুদিনে বিক্ষিপ্ত কথামালা
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ১৩ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৯:৪১:২৬ সকাল
গেলো ৮ নভেম্বর ছিলো মায়ের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯১ সালের এই দিনে মা পরপারে পাড়ি জমিয়েছিলেন। মাকে মনে পড়ে সমসময়ই। তবে বিশেষ করে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী এলে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ি। ছোটকালের স্মৃতি পীড়া দেয় বেশি। চোখ বুজলেই দেখতে পাই মায়ের সঙ্গে কাটানো শৈশবের আনন্দমধুর দিনগুলো। বিশেষকরে মায়ের সাথে নানা বাড়িতে মাসের পর মাস ‘নাইর’ কাটানোর অজস্র স্মৃতি আজও অমলিন হয়ে আছে। মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে বিভিন্ন রোগব্যাধীতে আক্রান্ত হয়েপড়া, ডাক্তার কবিরাজে দৌড়াদৌড়ির কথাগুলো স্মরণ হলে মনে কষ্ট পাই। বিশেষ করে মৃত্যুর প্রায় ছয়মাস আগে থেকে কোনো ধরনের খাবার-দাবার ছাড়া রোগশয্যায় একঠায় শোয়ে থাকার দৃশ্য যখন চোখের সামনে ভেসে আসে তখন নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। মা’র কী হয়েছিলো ভালোভাবে বলতে পারব না। কারণ তখন আমি নবম শ্রেনীর ছাত্র। অতশত বুঝি না। শুধু ডাক্তারকে বলতে শুনেছি মা’র গ্যাস্টিক আলসার হয়েছে। সিলেটের তৎকালীন নামকরা ডাক্তার খালিক সাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। তিনি বলেছিলেন, অপারেশন লাগবে। মা তাঁর কাছে দুই-একটি বিষয় জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে তিনি তাঁর চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী বলেছিলেন, তুমি ডাক্তার হলে এখানে এসেছো কেন? এরপর আর খালিক সাহেবের কাছে যাওয়া হয় নি। তারপর তাবিজ, পানিপড়া, কবিরাজী, হোমিও প্যাথিক চিকিৎসা কিছুই বাকী থাকেনি। কিন্তু কোনো কিছুই তাঁকে বাঁচাতে পারেনি। জীবন-মৃত্যুর ওপর কারো হাত নেই। সৃষ্টিকর্তার যখন ইচ্ছা হবে তখন তিনি কোনো রূহকে একটি মাংসপিণ্ডের দেহে ঢুকিয়ে পৃথিবীতে ভুমিষ্ট করে দেবেন। আবার যখন তার ইচ্ছা হবে তখন দেহটি মাটিতে ফেলে রেখে রূহটি বের করে নেবেন। এটাই শ্বাসত সত্য। এটা আমাদেরকে মেনে নিতেই হবে। আমিও মেনে নিই মায়ের মৃত্যুকে। কিন্তু সেই মেনে নেওয়া হয় খুব বেদনার। কারণ তখন আমি মাত্র ১৪ বছরের এক বালক। তাছাড়া চিকিৎসার অভাবে মাকে অনেক কষ্ট করে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এটাই আমাকে বড় কষ্ট দেয়।
স্মৃতিতে ভেসে ওঠে মায়ের মৃত্যুদৃশ্য। বারটি ছিলো শুক্রবার। ঘরের মেঝে একটি বিছানায় শোয়ে আছেন মা। কোনো কথাবার্তা নেই। নেই নড়াছড়া। দ্বিতীয় কেউ নাড়াছাড়া করিয়ে দিলেই তবে তিনি নড়তে পারতেন। বেলা সাড়ে ১২টা দিকে হঠাৎ তাঁর মধ্যে মারাত“ক অস্থিরভাব লক্ষ্য করা গেলো। চোখ তুলে চারদিকে হকচকিয়ে তাকাচ্ছেন। বড় বোন আমাদের সকলকে ডাকলেন। আমি তখন বাইসাইকেল নিয়ে ব্যস্ত। ডাক শোনে দৌঁড়ে এসে দেখলাম মা কেমন আনচান করছেন। এতদিন তিনি মোটেও নড়াছড়া করতে না পারলেও হঠাৎ কিছুটা নড়াছড়া করছেন। চারদিকে তাকাচ্ছেন। আমাদের তখন মনে হচ্ছিলো মা’র হাতে আর বেশি সময় নেই। পরপারের ডাক পড়েছে। তাঁকে বিদায় জানাতে হবে। মালাকুল মওত বা মৃত্যুদূত হয়তো সামনে চলে এসেছেন। আমরা তাঁকে কালেমা শোনাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি ঝাকুনি দিয়ে শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। একসময় চোখদু’টো ফ্যাকাশে হতে দেখা যায়। এরপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকলো মায়ের দেহখানি।
মা ছিলেন খুবই ধর্মভীরু। নামাজের সময় হলেই তাঁর ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেতো। গোসল সেরে অজু পড়ে কখন নামাজ শেষ করবেন। ঘরে কোণে নির্দিষ্ট একটি জায়গা নামাজের জন্য নির্ধারিত ছিলো। সাদা শাড়ি পরে সেখানেই নামাজ পড়তেন। ফজরের অনেক অগে ঘুম থেকে উঠে যেতে দেখতাম। তাহাজ্জুদ শেষ করে ফজরের জন্য অপেক্ষা করতেন। ফজরের নামাজ শেষ হলে মুসল্লাতেই বসে থাকতেন। সূর্যাদয় হলে সালাতুত দোহা পড়ে তবেই জায়নামাজ ছাড়তেন। এরপরেই গৃহস্থালী কাজে মনোনিবেশ করতেন। সারাদিনই ব্যস্ত থাকতেন ঘরের কাজ-কর্ম নিয়ে। আজ এ অবেলায় অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে। প্রায় রাতেই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। মা ঘুম থেকে জাগিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করতেন। অনেক রাগ হতো মায়ের ওপর। বলতাম, কেন খাবো? তিনি বলতেন রাতে না খেলে এক চড়ুই পরিমাণ মাংশ কমে যায়। এরপরও খেতাম না। বলতাম, কমলে তো আমারই কমবে, তোমার তাতে ক্ষতি কী? এরপরও মা কিন্তু নাছোড়বান্দা। অনেক জোরজবরদস্তি করে মুখে খাবার তুলে দিতেন। এরপর হাত মুখ ধুয়ে বেডে শোয়ে দিতেন। এই ছিলেন মা। আমি বিশ্বাস করি, শুধু আমার মা-ই নয়; পৃথিবীর তাবত মা’ই রাতের বেলা সন্তান না খেয়ে ঘুমালে সমানভাবে ব্যথা পেয়ে থাকেন। ছাত্রজীবনে মায়ের আদর খুবই মিস করতাম; যখন হোস্টেলের পাতলা ডাল দিয়ে রাতে না খেলেও কেউ জানতে চাইতো না কেন খাচ্ছো না।
মায়ের সঙ্গের আরো কিছু স্মৃতি আজ মনে পড়ছে। শীতকালে সুষ্ক মৌসুমে ভাইবোন মিলে নানা বাড়ি যাওয়া হতো। বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দূরে নানা বাড়ি। কোনো যানবাহন নেই। হেঁটে যেতে হতো সারাপথ। পড়ন্ত বিকেলে হাওরের মেটো পথ ধরে হেঁটে যেতে কী যে আনন্দ লাগতো। তিনমাইল দূর- তাতে কী যায় আসে? নানা বাড়ি যাওয়ার আনন্দে রাস্তা ফুরিয়ে যেতো অনায়াসেই। তাছাড়া দল বেঁধে যাওয়া হতো নানা বাড়িতে। বিশেষ করে হাওরের পথে রঙ-বেরঙের ঘোড়া, পাখির পাল ইত্যাদি পরম আনন্দ দিতো। পথিমধ্যে একটি জায়গার নাম ছিলো হিলুয়ারটুক। কিছু গাছগাছালি বেস্টিত জনশূন্য একটি জায়গা। মতে হতো যেনো যত দৈতদানব বাস করছে এই ঝোপে। সেখানে পৌঁছলে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতাম। মা’ও বাটা থেকে পান, সুপারি, চুন-জর্দা বের করে গলায় রস করে নিতেন। সেই হিলুয়ারটুককে খুবই মিস করি। এখন আর সেখানে বোধহয় কোনো গাছগাছালি নেই। কেটে চাষাবাদের জমির সাথে একাকার করে দেয়া হয়েছে। তবে আমার মনের মনিকোঠায় হিলোয়রটুক মানেই সবুজ গাছগাছালিবেষ্টিত একটি জায়গা। মধ্যদিয়ে পায়ে হাঁটার ছিপছিপে রাস্তা। কোনো মানুষ নেই। রকমারী পাখির কলতানে মুখরিত। মনে হতো যেনো সেখানে বাস করছে যতসব অজানা জীবজন্তু। কিছু ভয়ও হতো।
মামার বাড়িতে কাটতো মাসেরও বেশি সময়। হায়, কী আনন্দ। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, শুধু আনন্দ-উল্লাস। মামাতো ভাই শামীম, সেলিম, বোন রুলি মিলে সারাদিন খেলাধূলায় মেতে থাকতাম। ওদের সাথে আজ দেখা হয় না। শামীম এখন বড় ব্যবসায়ী। সেলিম নিউ ইয়র্কে। রুলি বিবাহসূত্রে আমেরিকার মিশিগান প্রবাসী। আমি পড়ে আছি লন্ডনে। এই হলো শৈশবের স্মৃতিচারণ। মৃত্যুদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজ অনেক কথাই লিখে ফেললাম। মায়ের জানাজা আমি পড়িয়েছিলাম। গ্রামের শ্রদ্ধাভাজন ইমাম ও আমার শিক্ষক মাওলানা মোহাম্মদ খাঁ বলেছিলেন তুমি পড়াও। ছেলে মায়ের নামাজ পড়ানো উত্তম।
মায়ের মৃত্যুর ২৩ বছর ৬ মাস পর (২৮ এপ্রিল ২০১৫) পরপারে পাড়ি দিলেন বাবা। হঠাৎ করে বাড়ি থেকে খবর এলো বাবা খুব অসুস্থ। বড় ভাইকে বললাম, সিলেটে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। স্থানীয় ডাক্তারের পরামর্শে নিয়ে যাওয়া হলো সিলেট শহরের নয়াসড়কস্থ একটি ক্লিনিকে। একদিন চিকিৎসার পর ডাক্তার জানালেন কিডনি কাজ করছে না। হার্টেও সমস্যা। তিনি আর বাঁচবেন না। কিন্তু পরদিন অন্য ডাক্তার জানালেন কিডনী ডায়ালাসিস করলে প্রসাব হবে। বাঁচার সম্ভাবনা আছে। তাঁর কথামতো ডায়ালাসিস শুরু হলো। তিনিও আস্তে আস্তে ভালো হতে লাগলেন। ফোনে আমার সাথে কথা বললেন। জানালেন দুই দিন পরই রিলিজ করে দেবে। দেশে যেতে চেয়েছিলাম। আপাতত থামলাম। কিন্তু এর দুইদিন পরই জানতে পারলাম- হঠাৎ করেই তাঁর অবস্থার মারাত“ক অবনতি ঘটেছে। ভাবলাম আর বসে থাকার সময় নেই। টিকিট যোগাড় করে ছুটলাম। সাথে ছোটভাই মোহাম্মদ রহিম। আট বছরের ছেলে জিবরিল মাহমুদও সঙ্গ নিলো- দাদাকে দেখতে যাবে। বললো, দাদা মারা গেলে আর তো কোনো দিন দেখতে পারবো না। ওদেরকে নিয়ে কাতার এয়ারওয়েজে রওয়ানা দিলাম। বিমানের মতো সরাসরি ফ্লাইট না হওয়ায় অনেক ছড়াই উৎরাই পেরিয়ে সিলেট এয়ারপোর্ট পৌঁছে জানলাম বাবার অবস্থার চরম অবনতি। গাড়ি নিয়ে ছুটলাম শহরের ক্লিনিক অভিমুখে। রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট। গাড়ি এগুচ্ছে না। একদিকে ক্লিনিক থেকে বারবার ফোন আসছে। অন্যদিকে বাবার শেষ নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে। অনেক চেষ্টা করে শহরের অলিগলি ধরে ড্রাইভার আমাদেরকে ক্লিনিকের সামনে পৌঁছালো। লিফটে চড়ে দ্রুত পৌছতে চাইলাম ৭ তলায় আইসিসিইউতে। কিন্তু সেখানেও ক্লিনিকে মানুষের প্রচণ্ড ভীড়। অবশেষে অনেক কাট-খড় পুড়িয়ে আইসিসিইউকে পৌঁছলাম। বাবা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। ভেতরে ঢুকতে মানা। আইসিসিইউ বলে কথা। অনেক অনুরোধের পর একটি অ্যাপ্রোন পরিয়ে ভেতরে যেতে দেওয়া হলো ছোটভাই ও আমাকে। জিবরিল বয়সে ছোট, তাই ওকে ঢুকতে দেয়া হলো না। আমরা ভেতরে ঢুকে দেখলাম বাবা চোখ বুজে নিচ্ছেন। হার্টবিট খুবই সামান্য। আমি কালেমা পড়তে পড়তে তাঁর চোখদু’টো বুজে দিলাম। তাঁর শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে এলো। চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন। হাসপাতালের বিল চুকে বিকেলের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম। এশার আজানের পরপর পৌছে গেলাম বাড়িতে (মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের ভবানী পুর গ্রামে)। রাতে গোসল দেওয়া হলো। ঘরে সারারাত কুরআন তেলাওয়াত চললো। জিবরিল ঘরে ঢুকেই ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরে শোয়ে পড়ে। ওর বয়স যখন ছয়মাস তখন প্রথম বাংলাদেশ গিয়েছিলো। বাংলাদেশ কী তখনও বুঝার বয়স হয়নি। এবার সে অনেক বড় হয়েছে। সবকিছুই বুঝতে পারে। দাদাকে জীবিত দেখতে না দেয়ায় আফসোস করে বলেছিলো, দ্যা ডিড নট লেটমি সি মাই দাদা (ওরা আমার দাদাতে দেখতে দেয়নি!)।
সে যাক। পরদিন সকাল ১১টায় গ্রামের ঈদগাহ মাঠে জানাজা হলো। মেঝো ভাই আবুধাবী থেকে সকালে সিলেট পৌঁছে জানাজায় অংশ্রগ্রহণ করলেন। আমি জানাজার নামাজ পড়ালাম। পারিবারিক গোরস্থানে লাশ কবরে নামালাম। মিনহা খালাকনাকুম.... পড়তে পড়তে বাবাকে ক্বেবলামুখী করে শোয়ে রেখে কবর থেকে উঠে পড়লাম। মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো কবর। দোয়া দুরুদ শেষে একসময় ফিরে এলাম বাড়িতে। সপ্তাহ দিন বাড়িতে থাকলাম। নিয়মিত মসজিদে নামাজে যাওয়া, কবর জেয়ারত করাই ছিলো দৈনন্দিন কাজ।
চারদিনের মাথায় বাবার শিরনী করার প্রস্তাব এলো। সবধরনের ফলমূল দিয়ে শিরনী দিতে হবে। গ্রামে যুগের পর যুগ এই রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। পরিবারের সকলকে এই ফল-শিরনীর রেওয়াজ বর্জনের অনুরোধ জানালে তাঁরা আমার প্রতি বেশ মনক্ষুন্নই হলেন। অনেকের কাছে মনে হলো- আমি লন্ডন আসার কারনে বোধহয় ধর্মকর্ম বাদ দিয়ে দিয়েছি। অর্থাৎ কারো মৃত্যুর চারদিনের মাথায় রকমারী ফল দিয়ে শিরনী বিতরনের রেওয়াজও যেনো ধর্মের একটি অনুষঙ্গ। সকলকে সাধ্যমতো বুঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেউ কোনো যুক্তিই মানতে রাজি নন। অনেকটা ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার’ অবস্থার মতোই। তাঁদের কথা একটিই। এতোদিন ধরে এই রেওয়াজ চালু আছে, ওটা না করলে এলাকার মানুষ কী বলবে? তাই শিরনীটা যেকোনো উপায়ে করা চাই, করতেই হবে।
বললাম, ইসলাম ধর্মে চারদিনের শিরনীর কোনো ভিত্তি নেই। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের পরে চারদিনের মাথায় কোনো ফল-শিরনী দেওয়া হয়নি। আবু বকর ও ওমর (রাঃ) নিজেদের প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসতেন রাসুল (সাঃ) কে। তারা কি মদীনার বাজার থেকে কিছু ফল কিনে এনে শিরীন দিতে পারেন নি। রাসুল (সাঃ) এর পরবর্তী যুগে চার খলিফা, তাবেয়ী অথবা চার মাযহাবের চার ইমামের ইন্তেকালের পরও কোনো ফল-শিরনী বিতরনের কোনো প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়নি। যা ইসলামের কোনো আমলেই ছিলোনা তা আজ চৌদ্দশ বছর পরে কীভাবে বড় সওয়াবের কাজ হয়ে গেলো। কুরআন- হাদীসে যা নেই তাতো ইসলামের কোনো বিধান হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
মৃত্যুর চারদিনের মাথায় রকমারী ফল দিয়ে শিরনী বিতরন একটি হিন্দুয়ানা সংস্কৃতি। হিন্দু ধর্মের কেউ মারা গেলে তারা চারদিনের মাথায় সবধরনের ফল দিয়ে শ্রাদ্ধ করে থাকেন। “হযরত শাহজালাল (রহঃ) আসার আগ পর্যন্ত আমাদের পুর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। সেই সময়কার অনেক হিন্দুয়ানা সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে এখনও চালু রয়ে গেছে। আমরা সেগুলো অনুসরণ করছি”- আমার এসব কথা শোনে অনেকেই তো আকাশ থেকে পড়লেন। এসব কী বলছি। একজন বললেন, গ্রামের লোকজন কী বলবে? শিরনী করলে সাওয়াব না হলেও গুনাহ তো হবে না। বললাম, যা কুরআন হাদীসে নেই তা সওয়াবের কাজ মনে করে চালু রাখাই গোনাহ। সে যাক, অবশেষে বুঝাতে সক্ষম হলাম এবং ফল-শিরনী বিতরন থেকে বিরত থাকা সম্ভব হলো। চারদিনের শিরনীর সংস্কৃতি ভেঙে অন্যদিন স্থানীয় মসজিদে কিছু শিরনী দিয়ে বাবার রুহের মাগফেরাত কামনা করা হলো।
লেখা শুরু করেছিলাম মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী দিয়ে। প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী এলে বাড়িতে খতমে কুরআন ও দোয়া-দুরুদ পড়ানো হয়। দশ-বারোজন আলেম দাওয়াত দিয়ে এনে কুরআন খতম পড়িয়ে দোয়া করানো হয়। এ বছর আর পড়ানো হলো না। খতমপড়া ও পড়ানো জায়েজ-নাজায়েজ নিয়ে একটি বিতর্ক আলেম সমাজে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত আছে। এতোদিন এসব বিতর্কে কান না দিয়ে মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী এলে প্রতিবছরই কয়েক জন আলেম দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে কুরআন খতম পড়িয়েছি। আর এর মাধ্যমে মায়ের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ অনুভব করেছি।
কিন্তু সম্প্রতি খতম না পড়ানোর পক্ষে একজন আলেমের একটি যুক্তি আমার কাছে সঙ্গত মনে হলো। তিনি বললেন, পবিত্র কুরআনের একটি অক্ষর পড়লে দশটি সওয়াব পাওয়া যায়। হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত। যিনি পড়বেন শুধু তারই সওয়াব হবে। তাহলে আলেমদের দাওয়াত দিয়ে এনে কুরআন শরীফ পড়ালে প্রতি অক্ষর তেলাওয়াতের সওয়াব যারা পড়ছেন শুধু তারাই পাচ্ছেন। যিনি পড়ালেন তাঁর লাভ কী? আসলে তার কোনো লাভ নেই। কারণ সওয়াব প্রথমে নিজে অর্জন করে অর্থের বিনিময়ে অন্যের জন্য ট্রান্সফার করা যায় না। তাহলে তো এটা ব্যবসা হয়ে যায়। অর্থাৎ একজন আলেম কুরআন তেলাওয়াত করে সওয়াব অর্জন করলেন। আর আমি তাঁকে কিছু অর্থ হাদীয়া বা উপহার হিসেবে দিয়ে দিলাম এবং তিনি এই অর্থের বিনিময়ে অর্জিত সওয়াব বা পূণ্য মৃত ব্যক্তির রুহের প্রতি ট্রান্সফার করে দিলেন। এটা কীভাবে ইসলামে গ্রহণযোগ্য হবে? অবশ্যই না। একেবারে সহজ হিসাব। এটা বুঝার জন্য হাদীস-কুরআন ঘাটাঘাটির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ
বিষয়: বিবিধ
১৫০৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক বেদায়াত, যা কিনা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, সেসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দায়িত্ব প্রতিটা ইমানদারের, আর আপনি সে কাজটা করেছেন, আল্লাহ আপনাকে উত্তম জাযা দিন।
বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের অবস্থা সুবিধার না। এতো জ্যাম যে, রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার আগেই মারা যেতে দেখা যায়।
ছবিটা যদি আপনার হয়ে থাকে, তাহলে বলব, ব্লগে নিজের ছবি না দেওয়াই উত্তম। এখানে প্রদর্শনেচ্ছা বেড়ে গিয়ে ইমানে ঘাটতি পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
সবশেষে, আপনার সর্বাংগীন কল্যাণ কামনা করছি।
তবে প্রশ্ন থেকে যায় আমি তো লুকিয়ে গোপনে কিছু লিখছিনা। সুতরাং কেন প্রকাশ্যে করবোনা। তাছাড়া ছবি মানুষ সহজে চেনার জন্য। প্রদর্শন ইচ্ছার উদ্রেক যাতে না হওয় এজন্য দোয়া করি। তবে ছবি বর্জন উত্তম বলেই মনে করি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন