প্রসংঙ্গ: মিনায় হতাহতের ঘটনা || যে কারণে আমার এ শব্দকথন
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:১৩:৫৪ রাত
মিনায় হতাহতের ঘটনা সম্পর্কে দেয়া আমার স্ট্যাটাসটি অনেকেই পড়েছেন। পক্ষে-বিপক্ষে অনেকে মন্তব্যও করেছেন। এ জন্য ধন্যবাদ। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি মেয়র ওহিদ আহমদ বর্তমানে হজ্জে আছেন। তিনি স্ট্যাটাসটি পড়ে একটি দীর্ঘ কমেন্ট পোস্ট করেছেন। মিনার ঘটনার একটি ব্যাখাও দিয়েছেন। এজন্য তাঁকেও আন্তরিক ধন্যবাদ।
ওহিদ ভাইর পজেটিভ অভিজ্ঞতার কথা শোনে ভালো লাগলো।
তবে সকলেই হয়তো তাঁর মতো ভাগ্যবান নয়। তাছাড়া বারতানিয়া বা ব্রিটেন থেকে যাওয়া বাঙালি হাজ্জীদের
একটু-আধটু যে কদর আছে তা কিন্ত ওই লাল পাসপোর্টের বদান্যতায়। সবুজ পাসপোর্ট দেখলেই এক ধরনের তাচ্ছিল্যভাব পরিলক্ষিত হয় । তখন বাংলাদেশী হাজী আর সৌদিতে কর্মরত শ্রমজীবী বাংলাদেশীর মধ্যে কিছু সৌদির দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোনো তফাৎ পরিলক্ষিত হয় না।
সৌদি আরব যে প্রতি বছর হজ্জের মতো একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু কিছু ঘটনা তাদের উদাসীনতার কারণেই ঘটে থাকে বলে প্রবাসীরা মনে করেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আগেও বলেছি, সৌদির প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনো চেইন অব কমাণ্ড নেই। অর্থাৎ কারো কাছে কারও জবাবদিহীতা নেই। এটা একটি বড় সমস্যা । এয়ারপোর্টে অল্প বয়সী ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার কাছে আপনি পাসপোর্ট দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অপেক্ষা করছেন একটি সিল দিয়ে আপনাকে খালাস করে দেবে। কিন্তু আপনি দেখবেন ওই ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা মোবাইলে টেক্স ম্যাসেজ লিখতে-রিসিভ করতে কিংবা ওয়াটসআপ ও ফেসবুক নিয়ে খামাকা ব্যস্ত। কারো কাছে তাঁর জবাবদিহীতা নেই। কেউ দেখার নেই।
হজ্জের সময় যেসব ভলান্টিয়ার রাস্তার পাশে সাহায্য করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন এদের অনেকেরই পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের অভাব রয়েছে। অনেকের সাথেই আমার কথা হয়েছে, যারা স্কাউটের ছাত্র। মক্কা শহরের বাইরে দূরের কোনো শহরে থাকেন। হজ্জ উপলক্ষে এই প্রথমবার মক্কায় এসেছেন। রাস্তা-ঘাট চিনেন না। তাদের কাছে বরং ভলান্টিয়ার হওয়ার সুযোগে মক্কায় আসাটাই একটি সৌভাগ্যের ব্যাপার। অনেক সময় হাজীদের দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাদেরকে ভলান্টিয়ারিং বা সাহায্য করা। এ ধরনের নানা সমস্যা হয়ে থাকে।
হজ্জে বহুভাষার ব্যবহার একটি বিরাট সমস্যা। আরবীরা চান তাঁর দেশে যারা যাবেন সকলেই আরবী ভাষা শিখে যাবেন। তাদের সাথে আরবীতে কথা বলবেন। আর তাইতো অন্য ভাষায় কথা বললে শোনতেই চান না। কিন্তু তাঁদেরকে বুঝতে হবে
শুধু হজ্জে যাওয়ার জন্য কি একটি ভাষা শিখা সম্ভব। আরবীদেরকে যদি ব্রিটেন, জার্মান কিংবা বাংলাদেশ সফরের আগে ওই দেশের ভাষা শিখে যাওয়ার জন্য বলা হয় তাহলে তারা কি সেটা পারবেন? বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে কাজ করেন অথচ ইংলিশ জানেন না-এমন সৌদি অফিসার নেই? হাজীরা সৌদি যান ইসলামের একটি হুকুম পালনের জন্য। মাত্র কয়েকদিনের জন্য। তারা সেখানে কাজের জন্য যান না। তাদের কাছ থেকে আরবী ভাষায় কথা শোনার আশা করাটা নিরর্থক। ভাষাগত সমস্যার তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। আমি দেখেছি, ইংলিশে কথা বলার পর 'ইংলিশ মামনুন' বলে তাড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য। অথচ ইংলিশ ইন্টারন্যাশনাল ভাষা। এই ভাষা শিখা উচিৎ। ইংলিশ না জানলে আপনি নন-মুসলিম ইংলিশদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেবেন কীভাবে? আরবী ভাষা যারা জানেন তারাতো মুসলিম। তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার প্রয়োজন নেই। তাহলে ইসলাম প্রচারের তাগিদেই ইংলিশ ভাষা শিক্ষা দরকার। শুধু হজ্জে মানুষকে সাহায্যের জন্যই নয়।
আর হজ্জের সময় মাল্টি ল্যাগুয়েজে কথা বলতে জানেন এমন কোনো মানুষ কি পাওয়া যায় না? কেন পাওয়া যাবেনা? সেদিন সোশাল মিডিয়ায় একজন ফকিরের ভাষাগত দক্ষতা দেখে অবাক হলাম । তিনি ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কমপক্ষে ৩০টি দেশের ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। ভিক্ষা চাওয়া জন্য যেসব বাক্য ও শব্দচয়ন প্রয়োজন তিনি তা রপ্ত করে নিয়েছেন। ওই লোক ভিক্ষার জন্য যদি এতগুলো ভাষা শিখতে পারেন তাহলে হজ্জের মতো একটি বিশাল অনুষ্ঠান সম্পাদনের জন্য কিছু ভলান্টিয়ারকে কেন কিছু ভাষা শিখানো যায় না? আর এখানে ভাষা বলতে কিছু প্রয়োজনীয় বাক্য শিখার কথা বলছি । বহুভাষাবিদ ড. শহিদুল্লাহ হওয়ার তো প্রয়োজন নেই। সৌদি সরকার ইচ্ছা করলেই সেটা পারে। এটা কোনো বড় ব্যাপার নয়।
এবার আসি গণমাধ্যম বিষয়ে। সৌদিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকাও একটি সমস্যা। গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সমাজে কী হচ্ছে, কী ঘটছে-সে চিত্র ফুটে ওঠে গণমাধ্যমে। রাস্ট্রের জন্য এটি বেশ সহায়ক। কারণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে কী ঘটছে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা সবকিছু খুঁজে দেখা সম্ভব নয়। মিডিয়ার মাধ্যমে সমাজের সুবিধা-অসুবিধাগুলো আয়নার মতো ভেসে উঠে। আর এ দেখে কর্তা ব্যক্তিরা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেন। থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোতে গণমাধ্যমই সাধারণ মানুষের প্রধান ভরসা। গণমাধ্যম না থাকলে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে সেসব দেশে মানুষের নিরাপদ বসবাস অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতো।
সৌদিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খুব সামান্য। এতে করে সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার সুযোগ নেই বললেই চলে । সমাজের অসঙ্গতিগুলো কর্তৃপক্ষের নজরে আসে না। তাই সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়। সমাধানে কেউ এগিয়ে আসেনা।
একটি উদাহরণ দিতে চাই। আমরা যারা ব্রিটেন থেকে হজ্জ বা ওমরা পালনে যাই তাদের অধিকাংশই হারামের কাছাকাছি হোটেলে থাকার চেষ্টা করি। অধিকাংশ সময়ই হোটেল থেকে ওজু পড়ে নামাজে যাই। অজু চলে গেলে কিংবা টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হলে আবার হোটেলেই ফিরে আসি। হারাম শরীফের বাইরে আন্ডাগ্রাউন্ডে যে টয়লেট আছে সেখানে খুব কম যাওয়া হয়। একবার গিয়ে দেখা যেতে পারেন, সেখানকার টয়লেট ব্যবস্থাপনা। দেখবেন, কীভাবে টয়লেটের ফ্লোরে জলাবদ্ধতা লেগে আছে। যথাযথ ভেন্টিলেশনের অভাবে আন্ডারগ্রাউন্ড টয়লেট থেকে বাতাস বের হতে পারছেনা। ফলে দুর্গন্ধ লেগে আছে। আপনি কিন্তু বেশিক্ষণ টয়লেটে থাকতে পারবেন না। আপনার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। আমি গত বছরের অভিজ্ঞতা বলছি। এখন পরিবর্তন হলে জানিনা। ব্রিটনে একটি ছোট ও সাধারণ মসজিদের টয়লেটে এমন দুর্গন্ধ পাবেন না।
টয়লেটের এই দুরাবস্থার কারণ কী? আমি আগেই বলেছি, জবাবদিহীতার অভাব। টয়লেট সেকশন পরিস্কার রাখার দায়িত্বে যিনি আছেন তাকে কারো কাছে জবাবদিহী করতে হয়না। আর কোনো বড়কর্তা কখনো ভুলেও সেখানে যান না। তাহলে সেটি কে দেখবে? কোনো মিডিয়াকর্মীর চোখে পড়লেও তিনি তাঁর গণমাধ্যমে লিখতে পারবেন না। কারণ লিখলে তাঁকে জেল খাটতে হবে। অথচ একস্লিপ একটি রিপোর্ট বড়কর্তার নজরে পড়তো এবং টয়লেট অজুখানার চেহারার দৃশ্য পাল্টে যেতে পারতো।
এছাড়াও আরো অনেক বিষয়টি আছে। লিখে শেষ করা যাবেনা।
সেযাক। লিখছিলাম, মিনায় হাজীদের হতাহতের কারণ নিয়ে। বিভিন্ন মিডিয়া দাবী করছে-বাদশাপুত্রের গাড়ির বহর এই জন্য দায়ী। কেউ বলছেন, এটা মিথ্যা গুজব। সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা। সৌদি গ্রাণ্ড মুফতি তো ইতোমধ্যে ফতোয়া দিয়ে বলেছেন- ঘটনার জন্য হাজীদের ভাগ্যই দায়ী। আমি বুঝতে পারিনা, মুফতি সাহেবরা ফতোয়া দেবেন শরীয়তের আইন-কানুন নিয়ে। কিন্তু মানুষ-হতাহতের বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব সরকারের। সরকার তদন্ত করে রিপোর্ট দেবে-এজন্য দায়ী কে? এখানে ফতোয়ার কোনো প্রয়োজন দেখিনা।
মৃতু্যর ওপর কারো হাত নেই। আল্লাহর হুকুম হলে আকাশে মরতে পারি, পাতালে মরতে পারি। মরতে পারি সমুদ্রে। এটা ঈমানদার মাত্রই আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে ফতোয়া দিয়ে ভাগ্যকে দায়ী করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। তবে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে এ ঘটনার প্রকৃত রহস্য শিগগিরই উন্মোচিত হবে বলে আশাবাদী।
সর্বশেষ বলতে চাই এবং আগেই বলেছি, অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা না বলাটাই বরং দোষের কারণ । মক্কা-মদীনা আমার প্রাণের শহর। হারামাইন শরীফ আমার কাছে প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় দুটো স্থান। এদুটো ঘরের ব্যবস্থাপনা কীভাবে আরো উন্নত হয়-সে লক্ষ্যেই এই শব্দকথন। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের নিয়ত কবুল করুন। আমিন।
বিষয়: বিবিধ
১২৪৭ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক বছর ধরে উম্মাহর উপর এ পরিবার আমেরিকা ও ব্রিটেন এর হয়ে এবং সম্প্রতি ইসরাইলের হয়ে যে প্রক্সি নির্যাতন ও নিষ্পেষন চালিয়ে যাচ্ছে - তার মিনিমাম শাস্তি হল - এ প্রতারক শত্রুটিকে হেজাজ হতে বিতাড়ন করা।
সৌদিরা ইংরেজী ভাষা মোটেও বোঝে না । হিন্দী চালিয়ে , ইশারা ইঙ্গিতে এদের বোঝাতে হয় । তাতে কাজ হয় খুব সামান্য ।
নিজেদের লেভেলের একটু নিচের দেশের হলে তারা খুব একটা পাত্তা দেয় না । মুসলমান মুসলমান ভাই - সেটা এদের আচরণে প্রকাশ পায় না । অনেকটা দাম্ভিক ভাব ধরে থাকে ।
যেহেতু এই ফরয কাজের মাধ্যমে সৌদিরা বেশ ভালই ইনকাম করে , সেহেতু মেহমানদের (আল্লাহর) খাতির যত্ন খুব সন্মানের সাথেই করার মানসিকতা অজন করা উচিত এদের । কে আমেরিকান , কে বৃটেনের আর কে বা সুদানি / সোমালিয়ান এটা চিন্তা করলে মুসলমান হতে পারবে না।
যথার্থ বলেছেন, সহমত, জাযাকাল্লাহ
সৌদিতেই আছি, কী আর বলবো!!!
২০১৫ তে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলো সৌদীআরব- আরববাসীদের একেবারে হাঁটে হাঁড়ি ভেংগে দিচ্ছে! এতো অবজেকশন মনে হয় গতবছরও কেউ করেনি! যাক তবু যদি এগুলো কতৃপক্ষ পর্যন্ত পৌঁছায় আর সবার কিছু উপকার হয়!
আমার মনে হয় বিশ্বের সব মুসলিম দেশগুলোতে আরবীভাষা শেখাটা বাধ্যতামূলক করা উচিত! আমরা ইংরেজী যতটা ক্লেশ করে শিখি/শিখাই তার কিছু পরিমান এই আরবীতে দিলে অন্তত নিজে নিজের ধর্ম সম্পর্কে আরো ভালো ভালো জ্ঞানার্জন সম্ভব হতো, পরনির্ভরতা ও কমতো!
আপনাকে আন্তরিক শুকরিয়া লিখনীর জন্য!
মন্তব্য করতে লগইন করুন