গাফফার চৌধুরীর বক্তব্যের একটি একাডেমিক জবাব

লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ০৪ আগস্ট, ২০১৫, ১১:৪০:০৯ রাত

তাইছির মাহমুদঃ নিউ ইয়র্কে সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর দেয়া ‘একাডেমিক’ বক্তব্যের একটি একাডেমিক জবাব লিখবো ভাবছিলাম। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। তাই ভাবছিলাম আর লিখবো না, কিন্তু বিবেকের তাড়নায় লিখতে হলো। কারণ গাফফার চৌধুরী গত ২০ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠে তাঁর একটি কলামে লিখেছেন ‘আমি যদি ভুল বলে থাকি, তাহলে নিশ্চয়ই আমার বক্তব্য কেউ খণ্ডন করতে পারেন এবং আমিও ভুল শোধরাতে পারি।’ তাছাড়া তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে না বুঝে অনেকেই অনেক কিছু লিখছেন, বিবৃতি দিচ্ছেন। তাই এ ব্যাপারে তথ্যভিত্তিক একটি লেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করি।

তবে এ লেখার মাধ্যমে তাঁকে শোধরানোর কোনো দায়িত্ব বা উদ্দেশ্য আমার নেই। শুধু কুরআন হাদীসের আলোকে একটি দালিলিক জবাব দেয়ার চেষ্টা করবো। এই লেখাটি পড়ে মনঃপুত হলে গাফফার চৌধুরী চিন্তা করে দেখতে পারেন তাঁর দেয়া বক্তব্য সঠিক কি-না। আর সঠিক না হলে তাঁর করণীয় কী? আর দ্বিমত করলে একটি পালটা লেখা পাঠাতে পারেন। অবশ্যই সেটি ছাপানো হবে- যদি তা কুরআন-হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।

গাফফার ভাইর সাথে আমার একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে। সাপ্তাহিক দেশ-এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের অগে আমি দীর্ঘ প্রায় এক দশক সাপ্তাহিক নতুন দিনের নির্বাহী সম্পাদক ছিলাম। তিনি এই কাগজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। আমার যোগদানের পর তিনি কিছুদিন নতুন দিনে নিয়মিত লিখেছেন। এই সূত্রে তাঁর সাথে প্রায়শই যোগাযোগ হতো। তাঁর সাথে অনেক মজার মজার ঘটনা আছে। সেটি কোনোদিন সময় সুযোগে প্রয়োজন হলে লিখবো। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন, এখনও করেন কি-না জানিনা! তবে একজন বর্ষিয়ান ও বিজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার কোনো কমতি নেই। গঠনমূলক সমালোচনার অর্থ কাউকে অশ্রদ্ধা করা নয়। অতএব, তিনি এই আলোচনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখবেন বলে আশা রাখি। সে যাক, এবার মূল আলোচনায় মনোনিবেশ করা যাক।

গাফফার চৌধুরীর বক্তব্য নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে তিনি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন তা পাঠকদের সুবিধার্থে পুনরায় উল্লেখ করা প্রয়োজন। ৩ জুলাই শুক্রবার বিকেলে জাতিসংঘের স্থায়ী মিশনে তিনি বাংলাদেশ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত শীর্ষক এক আলোচনা সভায় একক বক্তব্য রাখেন। সভায় তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি, এর ব্যবহার, হাজার বছর আগে ও পরে বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষা গ্রহণ ও বর্জনের ইতিকথা তুলে ধরেন। বাংলা ভাষার বিবর্তনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আল্লাহর যে ৯৯ নাম রয়েছে এগুলো কাফেরদের দেবতাদের নাম থেকে এডাপ্ট করা হয়েছে।

বাংলাদেশে আরবী ভাষায় সন্তানের নামকরণের প্রবণতা প্রসংগে তিনি বলেছেন, সবচেয়ে বেশি হাদীস সংগ্রহকারী আবু হুরায়রা নামের অর্থ হচ্ছে বিড়ালের বাবা। আর আবু বকর নামের অর্থ হচ্ছে ছাগলের বাবা। বাংলাদেশের মানুষ অর্থ না জেনে এসব নাম রাখে। আরবে কোথাও এসব নাম পাওয়া যাবে না। বক্তৃতার এক পর্যায়ে বাঙালি মহিলাদের হিজাব পরার বিরোধীতা করে তিনি বলেছেন- বাঙালি নারীরা শাড়ি পরবেন, কপালে টিপ দেবেন, এটা আমাদের সংস্কৃতি।

তাঁর এ বক্তব্যের পর দেশে-বিদেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠলে তিনি নিউ ইয়র্কের স্থানীয় একটি টেলিভিশনে তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দেন। ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আমি ভুল কিছু বলিনি। আমি বড় মুসলমান। তিনি আবারও বলেন, আল্লাহ নামতো আগে কাফেরদের দেবতার নাম ছিলো। তা না হলে রাসুলের পিতার নাম আব্দুল্লাহ কী করে হল? এটা তো মুসলমান নাম নয়। তিনি আরো বলেন, হজ্জও ইসলামের হজ্জ নয়। এটাও ২ হাজার ৩ হাজার বছর আগে কাফেরদের প্রবর্তিত হজ্জ।

সর্বশেষ গত ২০ জুলাই সোমবার ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনকণ্ঠে “নিউ ইয়র্কে আমার ঘটনা এবং বন্ধুদের রটনা” শীর্ষক কলামে তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে বিস্তর লিখেছেন। কলামে তিনি ঐদিন নিউ ইয়র্কে প্রকৃতপক্ষে কী বলেছিলেন তা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন- “ভাষা-জাতীয়তা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আমি বলেছি, ভাষার কোন ধর্মীয় পরিচয় নেই। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবী ভাষা অমুসলিমদের ভাষা ছিল। সেই ভাষাতেই কোরান নাজেল হয়েছে এবং ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। আল্লাহর বহু গুণবাচক নাম আরবী ভাষা থেকেই সংগৃহীত এবং আগে তা কাবার দেবতাদের নাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দেবতাদের মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলার পর এই নাম শুধু আল্লাহর গুণবাচক নাম হয়ে দাঁড়ায়।” তিনি ঐ কলামে আরো লিখেছেন, তাঁর বক্তব্য কাটছাট করে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছে। তবে তিনি দেখিয়ে দেননি কোথায় কাটছাট করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্যের ভিডিও রেকর্ড ফেসবুক ও ইউটিউবসহ সকল সোশ্যাল মিডিয়ায় রয়েছে। এটাতো কাটছাট করার কোনো সুযোগই নেই। তিনি কি বলতে চান ভিডিওটি কোনো আইটি বিশেষজ্ঞ তৈরি করেছেন। নাহ, এমন অভিযোগ অবশ্য তিনি এখনও করেননি। আচ্ছা, ধরে নিলাম ভিডিওটিতে কাটছাট করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এবার জনকক্তে তাঁর কলামে স্বজ্ঞানে লিখেছেন- আল্লাহর বহু গুণবাচক নাম আরবী ভাষা থেকেই সংগৃহীত এবং আগে তা কাবার দেবতাদের নাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দেবতাদের মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলার পর এই নাম শুধু আল্লাহর গুণবাচক নাম হয়ে দাঁড়ায়।

এটুকুই যথেষ্ট। আমি তাঁর বক্তব্যের উপরোক্ত অংশের আলোকেই জবাবটি লিখতে চাই। তবে মূল বক্তব্যে যাওয়ার আগে আল্লাহর গুণবাচক নাম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি বর্ণণা দিচ্ছি।

আল্লাহর গুণবাচক নামের উৎস কী?

আল্লাহর ৯৯ নাম কোথা থেকে এলো? আমরা কীভাবে জানতে পারলাম যে আল্লাহ তায়ালার ৯৯টি নাম আছে। অনেকের মনে নতুন করে এ প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। তাই প্রথমে ৯৯ নামের ব্যাপারে একটি ভুমিকা দিতে চাই। পবিত্র কুরআনের নবম পারায় সুরা আল-আরাফের ৮০ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, “আল্লাহ তায়ালার জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। কাজেই সেই নাম ধরেই তাঁকে ডাকো। আর তাদেরকে বর্জন করো, যারা তাঁর নামে বিকৃতি ঘটায়। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শিগগিরই পাবে।” ৩০ পারা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে নামগুলো সুবিন্যস্ত রয়েছে। যেমন রাহমান, রাহিম, গাফফার, হাকিম, কাদির, রাজ্জাক ইত্যাদি। সুরা হাশরের শেষ আয়াতগুলোতে একত্রে বেশ কয়েকটি নাম উল্লেখ রয়েছে। তবে নামের প্রকৃত সংখ্যা কত- এ সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কুরআনে কিছু বলা হয়নি। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বোখারী শরীফের ২৭৩৬ নং হাদীসে ও মুসলিম শরীফের ২৬৭৭ নং হাদীসে রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ তায়ালার ৯৯টি নাম রয়েছে। এক কম একশ। যে ব্যক্তি নামগুলো গণণা (পাঠ) করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” এখানে হাদীসে নামের সংখ্যা উল্লেখ করা হলেও কোন্ কোন্ নাম আল্লাহর গুণবাচক নাম- এ ব্যাপারে স্পস্ট করে কিছু বলা হয়নি। তাছাড়া বিভিন্ন পুস্তকাদিতে যে ৯৯ নামের তালিকা রয়েছে এগুলো কোনো হাদীসে পাওয়া যায়নি। কুরআন শরীফের বিভিন্ন স্থান থেকে নির্ভরযোগ্য নামগুলো নিয়ে হয়তো ইসলামী চিন্তাবিদরা ৯৯ নামের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। এসব নামের পৃথক পৃথক অর্থ রয়েছে। যেমন রহমান অর্থ দয়াশীল, গাফুর অর্থ ক্ষমাশীল, কাদির অর্থ শক্তিশালী ইত্যাদি। আল্লাহ তায়ালা এসব গুণের অধিকারী বলেই এসকল নামে তাঁকে ডাকতে বলেছেন। আর যারা এসব নাম নিয়ে আজে-বাজে কথা বলে, নামের বিকৃতি ঘটায় তাদেরকে বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এই হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার ৯৯ নামের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।

এখন আলোচনায় আসা যাক সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বক্তব্য প্রসংগে। তিনি বলেছেন, এই ৯৯ নাম কাফেরদের দেবতা বা মূর্তির নাম ছিলো। সেখান থেকেই নামগুলো ইসলামে সংযোজন করা হয়েছে। তাহলে তাঁর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কাফেরদের দেবতাদের নামানুসারে এই নামগুলো পবিত্র কুরআনে সুবিন্যস্ত করেছেন। অর্থাৎ, রাসুল (সাঃ) নিজেই কুরআন রচনা করেছেন (নাউজুবিল্লাহ)। আল্লাহর ৯৯ নাম যে কোথাও থেকে সংযোজন করা হয়নি, বরং তা অনন্তকাল ধরে ছিলো তার কিছু প্রমাণ ও যৌক্তিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই।

এক.

আল্লাহ নিজেই যেহেতু পবিত্র কুরআনে বলেছেন, তাঁর অনেক সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে। সুতরাং আমাদের আর বলার কোনো সুযোগ নেই যে এই নামগুলো সংযোজন করা হয়েছে। কারণ এই বিশ্ব সৃষ্টির আগে অনন্তকাল থেকে যেমন আল্লাহ তায়ালা ছিলেন তেমনি তাঁর নামগুলোও বিদ্যমান ছিলো। পরবর্তীতে অন্য কারো কাছ থেকে এসব নাম হাওলাত করে নেয়া বা সংযোজন করার প্রশ্নই উঠেনা।

দুই.

পবিত্র কুরআনে আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর উল্লেখ রয়েছে। আর কুরআন শরীফ আজ থেকে ১৪০৬ বছর আগে ৬০৯ খৃস্টাব্দে মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর অবতীর্ণ হলেও এই গ্রন্থ অনন্তকাল থেকেই লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত ছিলো। আর কুরআন শরীফ যখন লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত ছিলো, তাহলে আল্লাহর নামগুলোও সেখানেই সংরক্ষিত ছিলো। এ ক্ষেত্রে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, কুরআন শরীফ তো প্রয়োজন অনুসারে জিবরিল (আঃ) এর মাধ্যমে কিছু কিছু করে ২৩ বছরে নাজিল হলো। তাহলে এটি লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত ছিলো কীভাবে? এর জবাব কুরআন শরীফেই দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের ৩০তম পারায় সুরা ক্বদরের প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ইন্না আনজালনাহু ফি লাইলাতিল ক্বাদর। অর্থাৎ আমি ইহা (কুরআন) ক্বদরের রাত্রে নাজিল করেছি। ক্বদর বলতে আমরা কী বুঝি? হাদীস অনুযায়ী লাইলাতুল ক্বদর হচ্ছে এমন একটি মর্যাদাকর রাত্রি, যে রাত হাজারো মাসের চেয়ে উত্তম। রাসুল (সাঃ) এই রাতকে রামাদ্বানের শেষ ১০ দিনের যেকোনো বিজোড় রাতে খুঁজতে বলেছেন। এ জন্যই রামাদ্বানের শেষ দশ রাতে বেশি করে ইবাদত করতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শবে ক্বদর যাতে হাতছাড়া না হয় এজন্য শেষ ১০ দিন মসজিদে এতেকাফ করার বিধান রয়েছে। এই শবে ক্বদরের রাতেই পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে। মুফাসিসরগণ এই আয়াতের তাফসিরে বলেছেন, আরবীতে আনজালা শব্দটি ব্যবহৃত হয় কোনো কিছু একসাথে অবতীর্ণ করা অর্থে। আর নাজ্জালা ব্যবহৃত হয় অংশ বিশেষ করে (সামান্য সামান্য) নাজিল করা অর্থে। ক্বদরের রাতে লওহে মাহফুজ থেকে একসাথে পূর্ণ কুরআন শরীফ প্রথম আসমানে নাজিল করা হয়েছে বলেই সুরা ক্বদরে আনজালনা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এবং পরবর্তীতে প্রথম আসমান থেকে এক আয়াত দুই আয়াত করে প্রয়োজন অনুযায়ী মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর নাজিল হয়। এজন্য সুরা আল-ইমরানের ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন “নাহনু নাজ্জালনাল কুরআনা”। অর্থাৎ আমরা কুরআন নাজিল করেছি। এখানে নাজ্জালা শব্দটি সামান্য-সামান্য করে নাজিল করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাহলে এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় কুরআন নতুন কোনো ঐশিবাণী নয়। এটি আগে থেকেই লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত ছিলো। আর ক্বেয়ামত পর্যন্ত এটি লওহে মাহফুজেই সংরক্ষিত থাকবে। সংরক্ষণের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের ৩০তম পারায় সুরা আল-বুরুজের ২১ ও ২২ নং আয়াতে বলছেন- “বাল হুয়া কুরআনুম মাজিদ, ফি লওহিম মাহফুজ”। অর্থাৎ- “বরং এটি কুরআন মজিদ, লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত রয়েছে।” সুতরাং এই বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয় কুরআন শরীফ লওহে মাহফুজে অনন্তকাল ধরে সংরক্ষিত ছিলো, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সুতরাং কোনো যুক্তিতেই বিশ্বাস করার সুযোগ নেই যে, কুরআনে এই নামগুলো কাফেরদের দেবতাদের নাম থেকে সংযোজন করা হয়েছে। কুরআন যেমন অনন্তকাল যাবত সংরক্ষিত ছিলো, তেমনি আল্লাহ তায়ালার নামগুলোও কুরআনে সংরক্ষিত ছিলো।

তিন.

হযরত নুহ (আঃ) এর মহাপ্লাবনের পর থেকে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে মক্কা নগরীতে কোনো মানুষের বসতি ছিলো না। বোখারী শরীফের ৮৩৩ নং হাদীসে এ ব্যাপারে বিশদ বর্ণণা রয়েছে। হাদীসের সারসংক্ষেপ হচ্ছে- যখন ইব্রাহিম (আঃ) এর স্ত্রী সারাহ ও হাজেরার মধ্যে চরম দ্ব›দ্ব দেখা দেয়, তখন তিনি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইলকে নির্বাসনে পাঠাতে মক্কা নগরীতে নিয়ে গেলেন এবং বর্তমান জমজম ক‚পের পাশে জনমানবহীন ভূমিতে একা রেখে ফিরে গেলেন। তখন সেখানে কোনো পানি ছিলো না। ইব্রাহিম (আঃ) তাঁদেরকে যে সামান্য খেজুর ও পানি দিয়েছিলেন তা কিছু দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। হাজেরা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে পানি পান করানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। সাফা ও মারওয়া পর্বত দুটোর উপরে উঠে সমতল ভ‚মির দিকে লক্ষ্য করে মানুষের খোঁজ করতে থাকেন। এভাবে তিনি সাফা ও মারওয়া পর্বতের একটি থেকে অপরটিতে সাতবার দৌঁড়াদৌড়ি করেন (এ জন্য পরবর্তী হজ্জের সময় হাজীদের ৭ বার দৌঁড়ানো অপরিহার্য হয়ে যায়)। একসময় তিনি একটি শব্দ শুনতে পান এবং একজন ফেরেশতা দেখতে পান। ঐ ফেরেশতা পায়ের গোড়ালী দিয়ে মাটিতে আঘাত করেন। এতে করে ক‚পের সৃষ্টি হয় এবং মাটি ফেটে পানি বের হতে শুরু হয়। এটাই হলো আজকের জমজম ক‚ম। পরবর্তীতে জমজম কূপ এলাকায় পাখির উড়াউড়ি দেখে দূর থেকে একদল লোক অনুমান করে সেখানে সম্ভবত পানি থাকতে পারে। তারা পানির অনুসন্ধানে সেখানে ছুটে আসে এবং পানি পেয়ে যায়। একসময় হাজেরার অনুমতি নিয়ে তাঁরা সেখানে বসবাস শুরু করে। ওরা ছিলো জুরহুম সম্পদ্রায়ের লোক। ইসমাইল (আঃ) তাদের কাছ থেকে আরবী ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন। এভাবেই মক্কা নগরীতে মানুষের বসবাস শুরু হয়। পরবর্তীতে ইব্রাহিম (আঃ) ফিরে আসেন। তিনি ও পুত্র ইসমাইল মিলে ক্বাবাঘর নির্মাণ করেন।

তিনি শরীয়ত প্রাপ্ত হন এবং আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার শুরু করেন। তখন মক্কা নগরীর মানুষ এক আল্লাহর উপসনা করতো। আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করতো না। কাবা ঘরে কোনো মূর্তি কিংবা দেবতা ছিলো না। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর অনেক অনুসারী ধর্মকে বিকৃত করে মুর্তিপূজা শুরু করে। তারা কাবা ঘরে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করে প্রত্যেকটির পৃথক পৃথক নামকরণ করে। আরবের বিভিন্ন স্থানে তারা লাত, ওজ্জা ও মানাত নামে তিনটি বড় দেবতা স্থাপন করে। কাফেররা বলতো এগুলো আল্লাহ তায়ালার নাম। তাই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের ২৭ নং পারায় সুরা আল-নজমের ১৯, ২০ ও ২৩ নাম্বার আয়াতে এই তিনটি মূর্তির কথা উল্লেখ করে ঘোষণা দেন এসব নামের সাথে তাঁর ন্যুনতম কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আল্লাহ তায়ালা উক্ত তিনটি আয়াতে বলেন “তোমরা কি ভেবে দেখেছো লাত ও ওজ্জা সম্পর্কে এবং তৃতীয় আরেকটি (দেবী) মানাত সম্পর্কে? (মূলত) এগুলো কতিপয় (দেব-দেবীর) নাম ছাড়া কিছুই নয়, যা তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা ঠিক করে নিয়েছো। আল্লাহ তায়ালার এর (নামে) সমর্থনে কোনো রকম দলিল প্রমাণ নাজিল করেননি।

সুতরাং, আল্লাহর গুণবাচক নাম আগে থেকেই ছিলো। কাফেররা মূর্তি তৈরি ও পূজা শুরু করে ইব্রাহিম (আঃ) এর ইন্তেকালের অনেক পরে। সুতরাং দেবতার নাম থেকে আল্লাহর নামকরণের কোনো সুযোগ নেই। কারণ আল্লাহর নাম অনেক আগে, দেবতা তৈরি ও পূজা শুরু হয় অনেক পরে। আর হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত হয়, আরবী ভাষা ছিলো ঐ জুরহুম সম্প্রদায়ের ভাষা। ইসমাইল (আঃ) তাদের কাছ থেকে ভাষা শিখেছিলেন। তাহলে আরবী কাফেরদের ভাষা ছিলো না, কাফেররা পরবর্তীতে এ ভাষায় কথা বলে। আর লাত, ওজ্জা ও মানাত সম্পর্কে হযরত ইবনে আববাস (রাঃ) এর উদ্বৃতি দিয়ে তাফসীরে ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, লাত নামে জাহিলিয়াত যুগে একজন সৎ লোক ছিলেন। তিনি হজ্জ মৌসুমে পানির সাথে পাউডার মিশিয়ে হাজীদের পান করাতেন। তাঁর মৃত্যুর পর লোকজন তাঁর কবরের সেবা শুরু করে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তার ইবাদত শুরু করে। এভাবেই তখনকার আরবে সৎ মানুষের নামে মূর্তি তৈরি করে লোকজন তাদের এবাদত (মুর্তি পূজা) করতো।

চার.

ইসলাম আসার আগে কি আরবে আল্লাহর গুণবাচক নামের ব্যবহার ছিলো? এই প্রশ্নটি অনেকের মনেই দেখা দিতে পারে। হ্যা, ইসলাম আসার আগেও আরবে আল্লাহর অনেক নামের ব্যবহার ছিলো। কারণ মুহাম্মদ (সাঃ) এর আগে আরো লক্ষাধিক নবী পৃথিবীতে এসেছেন। কেউ নতুন শরীয়ত পেয়েছেন, কেউ পুরাতন শরীয়ত প্রচার করেছেন। কারো উপরে বড় ধর্মগ্রন্থ, আবার কারো উপর ছোট ধর্মগ্রন্থ (ছহিফা) নাজিল হয়েছে। এসব ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর গুণবাচক নামগুলো সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং আরবে এর প্রচলন ছিলো। এতো সাধারণ একটি বিষয় আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মতো একজন বিজ্ঞ সাংবাদিকের কাছে কেন পরিস্কার নয়, এটা আমার বোধগম্য নয়। তবে ধর্ম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকলে এই সাধারণ ভুলগুলো যে কারো ক্ষেত্রেই হওয়া খুবই স্বাভাবিক। অতিসম্প্রতি যেমনটি করেছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রেডিওকার্বন বিভাগের একদল গবেষক। বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবিষ্কৃত পবিত্র কুরআনের প্রাচীণতম পান্ডুলিপিটি পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে তাঁরা ৯৫ ভাগ নিশ্চয়তার সাথে বলেছেন, এটি ৫৬৮ থেকে ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনো সময়ে লেখা। কিন্তু আমার মতে পান্ডুলিপিটি যতই প্রাচীণ হোক এটি ৬০৯ খৃষ্টাব্দের আগে লিপিবদ্ধ করার কোনো সুযোগই নেই। কারণ রাসুল (সাঃ) জন্ম গ্রহণ করেন ৫৭০ খৃষ্টাব্দে। আর ৬০৯ খৃষ্টাব্দে তিনি যখন ৪০ বছর বয়সে উপনীত হন তখন নবুওত (কুরআন নাজিল শুরু হয়) লাভ করেন। অর্থাৎ ৬০৯ খৃষ্টাব্দে কুরআন শরীফ অবতীর্ণ হওয়া শুরু হয়ে দীর্ঘ ২৩ বছরে (৬৩২ খৃস্টাব্দে) তা পরিপূর্ণ হয়। তাহলে বলতে হবে ৬০৯ থেকে ৬৩২ খৃষ্টাব্দের মধ্যে অথবা এরও অনেক পরে কোনো এক সময় এই পান্ডুলিপি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এটা অতি সাধারণ একটি বিষয় হলেও পাশ্চাত্যের গবেষকদের তা বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ হয়তো তাদের ইসলাম বিষয়ক জ্ঞান একেবারেই সীমিত। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বেলায়ও এমনটি হতে পারে। তিনি সাংবাদিক হিসেবে বিজ্ঞ হতে পারেন। তাঁর লেখার শত শত পাঠক থাকতে পারে। কিন্তু এজন্য তিনি যে সব বিষয়েই পারদর্শী হবেন-এমন কথা বলা যাবে না। যে যে বিষয়ে পারদর্শী সে বিষয়েই কাজ করা উচিত। সারাবিশ্বে সাংবাদিকতায় বিট (নির্দিষ্ট বিভাগ) পদ্ধতি আছে। অর্থনীতি বিটের সাংবাদিককে যেমন পলিটিক্যাল বিটে রিপোর্টিংয়ে পাঠানো হয় না, তেমনি রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়ে কোনো স্পোর্টস রিপোর্টারকে নিউজ লিখতে বলা হবে না। আব্দুল গাফফার চৌধুরী ‘একাডেমিক’ আলোচনায় কুরআন হাদীস নিয়ে নাড়াচাড়া না করলেই পারতেন। কারণ এটি তার বিট-এর আওতায় নয়।

আবু হোরায়রা ও আবু বকর নামের অর্থ:

সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী রাসুলের (সাঃ) সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণণাকারী সাহাবী হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) ও ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর নামের অর্থ ব্যাখ্যা করে এসব নাম কেন রাখা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষ এসব নামের অর্থ না জেনে, না বুঝেই রাখে। আরবের মানুষ এই নামগুলো ব্যবহার করেন না। তিনি নামের অর্থ অনুবাদ করেছেন এভাবে- আবু হোরায়রা অর্থ বিড়ালের বাবা, আবু বকর অর্থ ছাগলের বাবা। এখানে তিনি কী ভুল করেছেন নিচের নাম বিষয়ক আলোচনা থেকে পরিষ্কার হবে।

প্রতিটি ভাষায় একটি শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হয়ে থাকে। তেমনি আরবী ভাষায়ও একটি শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে। কোনো কোনো সময় একটি শব্দের ১০-১২টি অর্থও হয়। ‘আবু’ শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে পিতা। কিন্তু এর একাধিক অর্থ রয়েছে। আবু হোরায়রা নামের ক্ষেত্রে আবু শব্দটি ওয়ালা বা অধিকারী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলেই আরবী ভাষাবিদরা অভিমত দিয়েছেন। আর হোরায়রা অর্থ বিড়াল। সুতরাং আবু হোরায়রা নামের অর্থ বিড়ালওয়ালা অথবা বিড়ালের মালিক। আবু হোরায়রার (রাঃ) প্রকৃত নাম ছিলো আব্দুল্লাহ বা আব্দুর রহমান। তিনি বিড়াল ও বিড়ালের বাচ্চা খুব বেশি পছন্দ করতেন। একদিন তিনি রাসুল (সাঃ) এর সম্মুখে উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ তার আস্তিন বা জামার ভেতরে থেকে একটি বিড়ালের বাচ্চা বের হয়। এ দেখে রাসুল (সাঃ) তাঁকে মৃদু হেসে বলে উঠেন, হে আবু হোরায়রা। অর্থাৎ হে বিড়ালওয়ালা বা বিড়ালের মালিক। এখানে রাসুল তাঁকে বিড়ালের বাবা অর্থে সম্বোধন করেন নি। অনুরূপ আবু বকর নামটিরও সুন্দর অর্থ রয়েছে। বকর শব্দটি বুকরা থেকে নির্গত। বুকরা অর্থ প্রত্যুষ। আবু বকর অর্থ যিনি প্রত্যুষে বা সর্বাগ্রে চলেন। যিনি অগ্রগামী। আর আবু শব্দটি যেহেতু ওয়ালা অর্থে ব্যবহৃত হয় তাই আবু বকর অর্থ হচ্ছে যিনি অগে চলেন। শুদ্ধ বাংলায় বললে অর্থ দাঁড়াবে অগ্রপথিক। এছাড়াও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বকর শব্দটি যুবক উট অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রে আবু বকর শব্দযুগলের অর্থ দাড়াবে উটওয়ালা বা উটের মালিক। কিন্তু আব্দুল গাফফার চৌধুরী কেন্ আবু বকর নামের অর্থ ছাগলের বাবা বললেন জানি না। সাধারণত বাংলাদেশে ছাগলকে বকরি বলা হয়। তিনি সম্ভবত বাংলাদেশী তরজমাটি গ্রহণ করে বলেছেন, আবু বকর অর্থ ছাগলের বাবা। তিনি আরো বলেছেন, এসব নামে আরবে কোনো মানুষের নাম নেই। কিন্তু অনুসন্ধানে এই নামে শতশত মানুষ পাওয়া যাবে। আবু বকর আল রাজি, আবু বকর আল জাযায়েরী, আবু বকর আল জাস্সাস নামক শিক্ষক ও পন্ডিত ব্যক্তিদের নাম রয়েছে আরবে।

আবু হোরায়রা ছিলেন রাসুলের (সাঃ) একজন বিশ্বস্ত সহচর। তিনি সার্বক্ষণিক রাসুলের (সাঃ) সাহচর্যে থাকতেন। চরম ক্ষুধায় ছটফট করলেও মসজিদে নববীতে আল্লাহর রাসুলকে (সাঃ) একা ফেলে তিনি কখনো ঘরে ফিরে যেতেন না। কারণ আল্লাহর রাসুল কখন কী বলেন, আর তিনি যদি না শুনেন তাহলে তা হয়তো পরবর্তীতে হাদীস হিশেবে লিপিবদ্ধ হবে-না, এই ভয়ে। তাইতো তিনি আজ বোখারী মুসলিমসহ সকল হাদীস গ্রন্থের শিরোমনি। সিংহভাগ হাদীসের শুরুতেই “আন আবি হোরায়রাতা (রাঃ) আনহু....” বলে হাদীস শুরু করতে হয়।

অন্যদিকে হযরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলীফা। যে ১০ সাহাবা আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) কাছ থেকে বেহেশতের সার্টিফিকেট পেয়েছেন তাদের মধ্যে আবু বকর হচ্ছেন একজন। সুতরাং নামের শাব্দিক অর্থ বিবেচনা না করে বরং মর্যাদার দিক বিবেচনা করে এই দুই নামে যদি কেউ নিজের সন্তানের নামকরণ করে থাকে, তাহলে মন্দের কিছু দেখি না। নাম দুটো নিয়ে উপহাসের ছলে কথা বলারও কোনো কারণ দেখতে পাই না। বরং দুইজন বড় সাহাবী হিসেবে তাঁদের নাম সম্মানের সাথে উচ্চারণ করা উচিত ছিলো। গাফফার চৌধুরী এই দুই সাহাবীর নাম নিয়ে কথা বলার সময় রাদিয়াল্লাহু আনহু (আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট) শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। তিনি বরং বলেছেন, রাসুল (সাঃ) ঠাট্টা করে আবু হোরায়রা বলেছেন। রাসুল (সাঃ) তো এভাবে কাউকে নিয়ে কখনো ঠাট্টা করেন নি। তিনি বরং আদর করেই প্রখ্যাত এই সাহাবীকে আবু হোরায়রা বলে সম্বোধন করেছিলেন। আর আবু হোরায়রার (রাঃ) কাছেও সেই সম্বোধনটি ছিলো খুব প্রিয়। তাই এই নামেই তিনি পরিচিত হতে পছন্দ করতেন।

রাসুলের পিতার নাম আব্দুল্লাহ কী করে হলো?

গাফফার চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিউ ইয়র্কের একটি টেলিভিশনকে বলেছেন, “আল্লাহ নামতো আগে কাফেরদের দেবতার নাম ছিলো। তা না হলে রাসুলের পিতার নাম আব্দুল্লাহ কী করে হল? এটা তো মুসলমান নাম নয়।”

আরবে কোথাও কোনো দেবতার নাম আল্লাহ ছিলো-এমন কোনো দলিল- প্রমাণ নেই। তাছাড়া গাফফার চৌধুরী যে বলেছেন রাহমান, রাহিম, গাফুর এগুলো দেবতার নাম ছিলো। কিন্তু এর পক্ষে তিনি কোনো রেফরেন্স কিংবা প্রমাণ উপস্থাপন করেন নি। ধর্মীয় বিষয়ে হাদীস ও কুরআনের রেফরেন্স ছাড়া মনগড়া কোনো ব্যাখ্যা দেয়া গর্হিত অন্যায়। আল্লাহ শব্দটি আল্লাহ তায়ালার মূল নাম। আর আবদুন শব্দের অর্থ বান্দা বা দাস। সুতরাং আব্দুল্লাহ নামের অর্থ আল্লাহর বান্দা। রাসুলের (সাঃ) পিতা যদি কাফেরও হয়ে থাকেন তাহলে তার নামটি তো কুরআনিক নাম। একজন কাফেরের ইসলামিক নাম হতেই পারে। যেমন- কোনো নাস্তিক ব্যক্তির নাম যদি আহমদ শরীফ হয়, তাহলে তাঁর নামটি তো আর নাস্তিক বা কাফের হয়ে যায় না। আহমদ তো মুহাম্মদ (সাঃ) এর আরো একটি নাম ছিলো। অপ্রাসংগিক হলেও মুহাম্মদ (সাঃ) এর পিতা-মাতা সম্পর্কে একটি বর্ণণা দিতে চাই। রাসুলের জন্মের ছয় মাস আগে তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। আর জন্মের ৬ মাস পরে ইন্তেকাল করেন তাঁর মা আমেনা। তাঁর পিতা মাতার পরকালীন অবস্থা কী হতে পারে- তা দুটি হাদীস থেকে পরিস্কার হওয়া যেতে পারে। মুসলিম শরীফের ২০৩ নং হাদীসে হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদিন রাসুল (সাঃ) এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বললো- হে আল্লাহর রাসুল আমার (মৃত) পিতা কোথায়? জবাবে রাসুল (সাঃ) বললেন, দোযখে। এ কথা শোনে লোকটি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন রাসুল (সাঃ) তাঁকে ডাকলেন এবং বললেন, নিশ্চয় আমার পিতা ও তোমার পিতা দোযখে। মুসলিম শরীফের ১৭৬৩ নম্বর হাদীসে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, একদিন রাসুল (সাঃ) তাঁর মা’র কবর জেয়ারত করতে গেলেন, তিনি সেখানে কাঁদলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও কাঁদলেন। এ ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কাছে আমার মায়ের আতæার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে অনুমতি চেয়েছিলাম, আমাকে দোয়ার অনুমতির পরিবর্তে শুধু কবর জেয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে তোমরা কবর জেয়ারত করো, এতে তোমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ হবে।

হিজাবের পরিবর্তে শাড়ি পরা ও কপালে টিপ দেয়া:

বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার জন্য হিজাব না পরে বরং শাড়ি এবং কপালে টিপ পরতে বলেছেন সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী। হিজাব হচ্ছে পর্দার একটি উপকরণ। ইসলাম আসার আগে আরবে মহিলারা পর্দাহীন চলাফেরা করতেন। এমনকি রাসুলের (সাঃ) স্ত্রীরাও পর্দা করতেন না। পঞ্চম অথবা ৬ষ্ঠ হিজরীতে পর্দার বিধান নাজিল হয়। সুরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, “হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, আপনার মেয়েদেরকে ও বিশ্বাসীদের স্ত্রীদেরকে বলুন, তারা যেনো তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে করে তাঁদের চেনা সহজতর হবে (তাঁরা যে মুসলমান নারী) এবং তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে মূলত মহিলারা নিজেদেরকে আবৃত বা পর্দা করতে শুরু করেন।

পর্দা শরীয়তের একটি অর্ডার বা ফরজ বিধান। ফরজ কাজ ছাড়লে শাস্তি প্রাপ্য হয়। তবে কেউ কাফের বা অমুসলমান হয়ে যায় না। কিন্তু যদি কেউ আল্লাহ তায়ালার বিধানের ব্যাপারে সাংঘর্ষিক কোনো বক্তব্য দেয় অর্থাৎ আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে কাজ করতে বলে তখন প্রতীয়মান হয় তিনি ফরজকেই অস্বীকার করছেন।

হজ্জ কি কাফেরদের দ্বারা প্রবর্তিত?

আব্দুল গাফফার চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আরো বলেছেন, হজ্জও ইসলামের হজ্জ নয়। এটাও ২ হাজার ৩ হাজার বছর আগে কাফেরদের প্রবর্তিত হজ্জ। ইসলামে পূর্ণ হজ্জরীতি ফরজ হয়েছে ৬৩২ খৃষ্টাব্দে। কিন্তু হজ্জ তো মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) এর সময়েও ছিলো। আদম (আঃ) পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করে তওয়াফ চালু করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন নবীর সময়ে বিভিন্ন নিয়মে হজ্জের প্রচলন ছিলো। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ) হজ্জ পুনঃপ্রবর্তন করেন। পবিত্র কুরআনের সুরা হাজ্জ-এর ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন “হে ইব্রাহিম, মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা দাও...।” কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের পর ধর্মকে বিকৃত করে অনুসারীরা মূর্তিপুজা শুরু করে। চালু করে ভিন্ন প্রক্রিয়ার হজ্জ। কাফেরেরা উলঙ্গ হয়ে ক্বাবাঘর তওয়াফ করতো এবং সাফা ও মারওয়া পর্বতে দৌড়াতো। আল্লাহ তায়ালাই মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর ওহি নাজিল করে হজ্জের সঠিক পন্থা শিখিয়ে দেন। সুতরাং কাফেরদের হজ্জ অনুসারে হজ্জ প্রবর্তন হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কোনো প্রমাণাদীও নেই।

কুরআন আল্লাহ তায়ালার বাণী। মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর এটি অবতীর্ণ হয়েছে। কুরআনের কথাগুলো একান্তই আল্লাহ তায়ালার। জিবরিল (আঃ) এসে রাসুলকে (সাঃ) বলেছেন। রাসুল (সাঃ) কথাগুলো মুখস্থ করেছেন। পরে তাঁর সঙ্গীদের জানিয়েছেন। মুসলমানরা দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করেছেন। রাসুল (সাঃ) তাঁর মনগড়া কোনো কিছু বলেন নি, করেন নি। এখন কেউ যদি বলেন, হজ্জ কাফেরদের প্রবর্তিত। তাহলে প্রতীয়মান হবে কাফেরদের হজ্জ থেকেই এই বিধান রাসুল (সাঃ) কুরআনে এডাপ্ট (সংযোজন) করেছেন। অর্থাৎ এটি আল্লাহ তায়ালার বিধান নয়, মুহাম্মদ (সাঃ) কাফেরদের থেকে এটি প্রচলন করেছেন। আলোচনা আর দীর্ঘ করতে চাই না। অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। আশাকরি এই আলোচনা বুঝতে সহায়তা করবে সাংবাদিক গাফফার চৌধুরীর বক্তব্য কুরআন হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক কি-না?

পাদটীকা ঃ

যেহেতু লেখাটি অনেক অমুসলিমও পড়তে পারেন, যাদের কুরআন হাদীস সম্পর্কে ধারণা নেই তাদের জন্য একটি পাদটীকা সংযোজনের প্রয়োজনবোধ করছি। কুরআনের কথাগুলো একান্তই আল্লাহ তায়ালার। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে জিবরিল আলাইহিস সালামের (ফেরেশতার বা দূতের নাম) মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর কথাগুলো জানিয়ে দেন। ৬০৯ থেকে ৬৩২ খৃস্টাব্দের মধ্যে দীর্ঘ ২৩ বছর সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী সামান্য সামান্য করে ৩০ পারা কুরআন অবতীর্ণ হয়। আর হাদীস হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বাণী। অর্থাৎ রাসুল (সাঃ) তাঁর জীবনে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, যেসব কাজ করেছেন অথবা সমর্থন দিয়েছেন সেগুলোই হচ্ছে হাদীস। রাসুলের (সাঃ) জীবনের যাবতীয় কর্মকান্ড একাধিক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের হাদীস বিশেষজ্ঞদের মতে সিহাহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়টি গ্রন্থ হচ্ছে- বোখারী, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজা, নাসাঈী। এই ছয়টির মধ্যে বোখারী ও মুসলিম হচ্ছে সবচেয়ে বিশুদ্ধ হাদীসগ্রন্থ। এ লেখায় আমি বোখারী ও মুসলিম শরীফের বিশুদ্ধ হাদীসগুলোই উল্লেখ করেছি। মুসলমান মাত্র কুরআন হাদীসের সবগুলো কথা বা নির্দেশনার প্রতি অবশ্যই শতভাগ বিশ্বাস থাকতে হবে। এছাড়াও এ লেখায় কিছু আরবী বাক্যের সংক্ষিপ্ত রূপ রয়েছে। এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। যেমন (সাঃ) শব্দটি সংক্ষিপ্ত হয়েছে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে। এর অর্থ আল্লাহ তায়ালা তাঁর ওপর শান্তি প্রেরণ করুন। (সাঃ) বাক্যটি শুধুমাত্র রাসুলের নাম উচ্চারণের পর বলতে হয়। (রাঃ) শব্দটি রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সংক্ষিপ্ত রূপ। এর অর্থ আল্লাহ তায়ালা তাঁর ওপর সন্তুষ্ট। সাহাবা অর্থাৎ রাসুলের সঙ্গীদের (যেমন: আবু বকর, আবু হোরায়রা, ওমর) নাম উচ্চারন করার পর এই বাক্যটি উচ্চারন করতে হয়। (রাহঃ) বাক্যটি রাহমাতুল্লাহ আলাইহি’র সংক্ষিপ্ত রূপ। বাক্যটির অর্থ তার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। সাধারণত এই বাক্যটি বিশিষ্ট আলেম ও চিন্তাবিদদের (ইমাম আবু হানিফা, হযরত শাহজালাল, হযরত শাহপরান প্রমুখ) নাম উচ্চারণ করার পর বলতে হয়। আর (আঃ) বাক্যটি সংক্ষিপ্ত হয়েছে আলাইহিস সালাম থেকে। এই বাক্যের অর্থ আল্লাহ তাঁর উপর করুনা করুন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছাড়া অন্যান্য নবী রাসুলদের নামের পর এই বাক্যটি উচ্চারণ করা হয় যেমন: ইব্রাহিম (আঃ), ইসা (আঃ), দাউদ (আঃ)।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ

বিষয়: বিবিধ

১৭২৩ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

333750
০৫ আগস্ট ২০১৫ রাত ০২:০৫
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : ধন্যবাদ, অন্ধকে যতই বলুন পথ তাহার শয়তানের ....।
০৫ আগস্ট ২০১৫ রাত ০৮:০৮
276021
তাইছির মাহমুদ লিখেছেন : থ্যাংকস..
333787
০৫ আগস্ট ২০১৫ সকাল ০৮:৩০
রক্তলাল লিখেছেন : গাফফার চৌঃ মূলত আল্লাহ ইসলামে বিশ্বাস করেন না।

মানুষ মাতাল হলে, যখন অনেক সত্য কিছু বলে দেয়, ঠিক তেমনিভাবে তিনিও বেফাস বলে দিয়ে তার অন্তরের জানান দিলেন।

একজন মুসলমান অন্তত যে বিশ্বাসের দিক থেকে হলেও অযথাই এসব প্রসঙ্গ নিয়ে এসে তালগোল পাকাত না।

আমি আল্লাহতে বিশ্বাস করলে কেন জাহেলিয়্যাতের মূর্তিদের নামের সাথে মিল আছে কি না তা খুেজ দেখব?

কিছু পঁচে গেলে দুর্গন্ধ এমনিতেই ছড়ায়।
লতিফ, গাফফাররা এতটাই পচে গেছে, তাদের পক্ষে বলার মানুষও খুজে পাওয়া যায়না!


০৫ আগস্ট ২০১৫ রাত ০৮:১১
276022
তাইছির মাহমুদ লিখেছেন : ধন্যবাদ
333791
০৫ আগস্ট ২০১৫ সকাল ০৯:২৭
মোহাম্মদ নূর উদ্দীন লিখেছেন : অনেক চমৎকার লিখা । হযরত ইব্রাহীম আঃ এর ধর্মতো ইসলামই ছিল । তার প্রবর্তিত হজ্জ কাফেরদের থেকে কি করে হয় ! আবদুল গাফফার চৌধুরীররা যদি না জেনে ভুল করেন সেটা এক কথা । কিন্তু ভুলের পরেও স্বপক্ষে যুক্তি দাড় করানো আর না জেনে ভুল এক কথা নয় । হয়ত আল্লাহ এসব বর্নচোরাদের মুখোস উম্মোচন করে দিচ্ছেন ।
333906
০৫ আগস্ট ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৩৭
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : চমত্কার যুক্তিপূর্ণ আর তথ্যবহুল লেখা | খুবই ভালো লেগেছে|অনেক ধন্যবাদ |
০৫ আগস্ট ২০১৫ রাত ০৮:০৭
276019
তাইছির মাহমুদ লিখেছেন : অনেক অনেক ধন্যবাদ বিশাল আর্টিকুলটি পড়ার জন্য।
333961
০৫ আগস্ট ২০১৫ রাত ১০:১৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File