একজন গোলাম রব্বানী ও কিছু কথা...
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ১৫ নভেম্বর, ২০১৪, ০৩:১৭:৫৯ দুপুর
কারো সাথে আগের দিন মসজিদে নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে করমর্দন করে কুশলাদীও বিনিময় করলেন। পরদিন জোহরের নামাজে গেছেন। জামায়াত শেষে ইমাম সাহেব একাধিক ব্যক্তির জানাজার নামাজের ঘোষণা দিলেন। একে একে মৃত ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করলেন। শুনলেন গতকাল যে ব্যক্তির সাথে করমর্দন করে গেছেন ইমাম সাহেব আজ সেই ব্যক্তিরই নাম বলছেন। তাঁর জানাজা হবে।
এ ধরনের ঘোষণা শুনলে কেমন লাগবে? নিশ্চয় বিশ্বাস করা কঠিন হবে। মনে হবে একই নামের তো অনেক মানুষই আছে। নাহ, গতকাল যার সাথে দেখা হয়েছে তিনি মারা যাওয়ার কথা নয়। একজন সুস্থ সবল মানুষ। এভাবে মারা যাবেন না?
নামাজ শেষে আপনি কৌতুহলী হলেন । ভাবলেন, তাহলে লাশ দেখে নিশ্চিত হয়ে যাই। মানুষের ভীড়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। কফিনের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এগুচ্ছেন। ধীর ধীরে সম্মুখপানে গিয়ে দেখেলেন সাদা কাপড়ে মোড়া মানুষটি তো গতকালের সেই ব্যক্তি, যার সাথে আপনি করমর্দন করে কুশল বিনিময় করেছিলেন। কাফনে মোড়া সারা শরীর। মুখখানি শুধু খোলা । যেনো রাজ্যের ঘুম সেই চির পরিচিত মানুষটির চোখে-মুখে । পাশে স্বজনেরা কাঁদছেন বিলাপ করে। তখন কেমন লাগবে? নিশ্চয় হতবাক না হয়ে পারবেন না।
ইদানিং আমার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। ইস্ট লন্ডন মসজিদের পাশে অফিস হওয়ায় প্রায়শই জোহর,আসর কিংবা মাগরিবের জামাতে অংশগ্রহণরে সুযোগ হয়। আর তাই অনেকের সাথে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হয়। হয় কুশল বিনিময়। কিন্তু আগের দিন যার সাথে দেখা, পরদিন তার জানাজার নামাজ পড়ার মতো কঠিন বাস্তবতারও মুখোমুখী হতে হয় ।
গত শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে এরকমই এক বাস্তবতার মুখোমুখী হলাম। যার সাথে প্রায়শই ইস্ট লন্ডন মসজিদে দেখা সাক্ষাৎ হতো, কুশল বিনিময় হতো, তাঁর জানাজা পড়লাম। বয়স খুব বেশী হলে ৪৫ হবে। তাঁর নাম সৈয়দ গোলাম রব্বানী। এক সময় সাপ্তাহিক নতুন দিন অফিসে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে গল্প করতেন। নিজের জীবনের একান্ত সুখ-দু:খের কথা বলতেন। অত্যন্ত সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।
শুক্রবার জুমার নামাজের ঘন্টাখানেক আগে মোবাইল ফোনে আকস্মিক তাঁর মৃতু্য সংবাদের টেক্সট পেলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ঐ গোলাম রব্বানী মারা গেছেন যার সাথে এই কয়েকদিন আগেও ইস্ট লন্ডন মসজিদে দেখা হয়েছে। ভাবতে কষ্ট হচ্ছিলো-কিভাবে এরকম একজন সুস্থ সবল মানুষ হঠাৎ চলে যেতে পারেন।
নামাজ শেষে এলএমসির গ্রাউন্ডফ্লোরে তাঁর লাশ রাখা হলো। দেখতে গেলাম। সৈয়দ রব্বানীর দেশের বাড়ি জগন্নাথপুর উপজেলার প্রবাসী অধু্যষিত সৈয়দপুর গ্রামে। তাই যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সৈয়দপুরের বিপুল সংখ্যক মানুষ ছুটে এসেছেন তাঁর জানাজায় । এলএমসির গ্রাউন্ডফ্লোরে উপচেপড়া ভীড়। শেষবারের মতো তাঁকে দেখতে লাইনের দাঁড়ালাম। ধীর ধীরে কফিনের সম্মুখভাবে পৌঁছে দেখলাম চির নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন গোলাম রব্বানী । পাশে তাঁর ১৭ বছরের কুরআনে হাফিজ ছেলে পিতার মুখের দিকে চেয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে। কাঁদছেন তাঁর ভাই বোন ও স্বজনেরা।
জানাজায় আগত স্বজন ও এলাকাবাসী সৈয়দ রব্বানী সম্পর্কে কথা বলছেন। সকলের মুখে একই কথা-খুবই সরল মনের মানুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন একজন ভালো মানুষ।
আমিও তাঁকে একজন ভালো মানুষ হিশেবেই জানতাম। এই যে তাঁর সম্পর্কে সকলেই ভালো বলছেন তার মাঝে কি কোনো ভালো বা কল্যাণ আছে। প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে গিয়ে রাসুল (সা এর জীবনের একটি ঘটনা মনে পড়লো।
তিনি একদিন তাঁর কয়েকজন সহচরকে সাথে নিয়ে একটি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। পথিমধ্যে তাঁরা একটি জানাজার পাশ অতিক্রম করলেন।
সেখানে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে লোকজন নেতিবাচক কথা বার্তা বলছেন। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির চরিত্র ভালো ছিলোনা। রাসুল (সা উপস্থিত লোকজনের কথা শুনে বললেন- 'ওয়াজাবাত' (ওয়াজিব হয়ে গেছে)। এরপর সহচরদের নিয়ে ঐ রাস্তা দিয়েই আবার হাঁটতে শুরু করলেন। কিছুদূর এগুতেই আবার আরো এক ব্যক্তির জানাজার মুখোমুখী হলেন । তাঁরা লক্ষ্য করলেন, প্রথম জানাজা ও দ্বিতীয় জানাজার পরিবেশ ভিন্ন। এখানে জানাজায় আগত লোকজন মৃত ব্যক্তির উচ্চসিত প্রশংসা করছেন। বলছেন, মৃত ব্যক্তি উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। রাসুল (সা মানুষের কথা শুনলেন এবং এবারও ওয়াজাবাত শব্দটি উচ্চারণ করলেন।
হযরত ওমর (রাএর মনে কৌতুহল জাগলো- রাসুল (সা কেন দুই ব্যক্তির ক্ষেত্রে একই মন্তব্য করলেন? শুধু বললেন ওয়াজাবাত। এই ওয়াজাবাত কী? তাঁরা রাসুলের (সা কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। জানতে চাইলেন তিনি কেন দুই ব্যক্তির ব্যাপারে অভিন্ন মন্তব্য করলেন।
রাসুল (সা বললেন, প্রথম যে জানাজা আমাদের পাশ অতিক্রম করলো তাঁর সম্পর্কে উপস্থিত লোকজন নানান নেতিবাচক কথাবার্তা বলছেন। অর্থাৎ ঐ লোক পার্থিক জীবনে ভালো ছিলেননা। আসলেও ঐ লোক খারাফ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন । অর্থাৎ লোকজন যা বলছে তা-ই সত্য। আর ইতোমধ্যে তার জন্য জাহান্নামও ওয়াজিব হয়ে গেছে।
আর দ্বিতীয় যে ব্যক্তি সম্পর্কে লোকজন ভালো কথা বলছেন । তাঁর চারিত্রিক গুণাবলীর প্রশংসা করছেন । তাঁকে ভালো মানুষ বলে সাক্ষি দিচ্ছেন। আর আসলেও তিনি ছিলেন একজন ভালো মানুষ। আর আল্লাহ তায়ালা তাঁর উপর জান্নাত বা বেহশেতও ওয়াজিব করে দিয়েছেন।
সৈয়দ গোলাম রব্বানীর জানাজা শেষে ফেরার পথে রাসুলের (সা জীবনের সেই ঘটনাটিই আমার মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কারণ সৈয়দ রব্বানীর জানাজায় আগত তাঁর স্বজন ও এলাকাবাসী তাঁকে একজন ভালো মানুষ হিশেবে সত্যায়ন করছেন। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে ভালো মানুষ। আল্লাহর রাসুলের জীবনের সেই ঘটনার আলোকে বলতে পারি, যেহেতু লোকজন সৈয়দ রব্বানী সম্পর্কে ভালো মন্তব্য করছেন তিনি আসলেও একজন ভালো মানুষ ছিলেন। আল্লাহর কাছেও তিনি ভালো মানুষ হিশেবে বিবেচিত হবেন। আর এজন্য তাঁর ওপর জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে বলে আমরা আশা করি। আমিন।
লন্ডন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর।
বিষয়: বিবিধ
১১৬৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জানি মৃত্যু কঠিন সত্য এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই তবু মৃত্যুর কথা শুনলে কেন এত ভয় পাই ।
আল্লাহ আমাকে মাফ করুন । আমীন ।
আপনার লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন