জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা একজন বাদশা ভাই ও কিছু কথা
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ১২ অক্টোবর, ২০১৪, ০৭:৫৪:২৩ সকাল
মৃত্যু নিয়ে ইদানিং একটু বেশী ভাবি। মাঝে মধ্যে ফেসবুকে একটু আধটু লিখিও। সম্ভবত বয়স বাড়ার সাথে সাথে মৃত্যুর চিন্তাও বাড়ছে। সেদিন আমার এক বন্ধু মৃত্যু নিয়ে বেশী লিখালিখি না করতে বললেন। কারণ এতে তাঁর ভয় হয়। তাই ইদানিং এ নিয়ে কম লিখি।
কিন্তু যখনই কারো জানাজায় যাই। লাশের মুখ দেখি। গোরস্থানে দাফনে যাই। ফিউনারেল সার্ভিসের গাড়িতে রাখা কফিনবন্দি লাশের পাশ অতিক্রম করি কিংবা হাসপাতাল বেডে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা কোনো রোগীকে দেখতে যাই তখন মৃতু্য ভাবনা তাড়া করে বেড়ায়। কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়। রাতে বালিশে হেলান দিয়ে লেপটপ নিয়ে যখন বিছানায় বসি তখন মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তিটির চেহারা চোখের সামনে ভেসে আসে। কিছু না লিখে বসে থাকতে পারিনা।
আজও এমনই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা এক কলমযোদ্ধা আমাকে মৃত্যু নিয়ে লিখতে বাধ্য করেছেন । আজ সন্ধ্যায় তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। কেন্টের অরপিংটন এলাকার একটি হাসপাতালে স্ট্রোক ইউনিটে তিনি শয্যাশায়ী আছেন প্রায় মাস দুয়েক। তিনি হচ্ছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক আমিনুল হক বাদশা। একসময় যিনি লন্ডনের সাংবাদিক অঙ্গনে ধাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি আজ লন্ডন থেকে অনেক দূরে একটি হাসপাতালে অচেতন দেহে শোয়ে আছেন। কথা বলতে পারেন না। খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন না। বেড থেকে ওঠে বসতে পারেনা। বালিশে মাথা রেখে কাত হয়ে শোয়ে থাকেন সর্বক্ষণ ।
জানতাম তিনি বেশ দিন যাবত অসুস্থ। দুই দুই বার স্ট্রোক করেছেন। দেখতে যাবো যাবো করে যাওয়া হয়ে ওঠছিলোনা। কিন্তু আজ সেই সুযোগটা পেয়ে গেলাম।
সাপ্তাহিক বাংলা পোস্ট সম্পাদক তারেক চৌধুরী দুপুরে ফোন দিয়ে বললেন, বাদশা ভাইকে দেখতে যাবো। চলুন আমার সাথে। আমি তাঁকে তাৎক্ষনিকভাবে কথা দিতে পারিনি। বললাম, কিছু কাজ আছে তবে চেষ্টা করবো। তিনি কিছুক্ষণ পর আবারও ফোন দিলেন। বললেন, রেডি হোন। আমি আপনার ঘরে আসছি। আপনাকে নিয়ে যাবো। যেই বলা সেই কাজ। তিনি ড্রাইভ করে সরাসরি আমার ঘরে। আমিও সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। কারণ বাদশা ভাই বিলেতের সাংবাদিক অঙ্গনের অতি পরিচিত মুখ। সদাহাস্যজ্জল ও উদার মনের মানুষ। আমাদের তিনি স্নেহ করতেন। সাংবাদিক অঙ্গনে ছোট-বড় সকলের সাথে মিলে মিশে চলতেন।
হাসপাতালের উদ্দেশে বের হওয়ার আগে ভাবলাম গাড়ি নিয়ে যখন যাচ্ছি তাহলে আরো দু'একজন সাংবাদিককে সহযোগী করলে মন্দ কী? এক মুসলিমের ওপর অন্য মুসলিমের যে ৫টি অধিকার আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে অসুস্থ হলে তাঁকে দেখতে যাওয়া। তাছাড়া কথা বলতে বলতে পৌঁছা যাবে।
তারেক ভাই ফোন দিলেন বাংলা টিভির চীফ রিপোর্টার ইব্রাহিম খলিলকে। ইব্রাহিম একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। পথিমধ্যে তাকে পিকআপ করে আমরা ব্লাকওয়েল টানেল হয়ে ছুটলাম অরপিংটন অভিমুখে। ঘন্টা খনেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হাসপাতালে।
বাদশা ভাইর কেবিনে ঢোকলাম। বেডে কাত হয়ে শোয়ে আছেন তিনি। চোখে চশমা। ঘুমঘুম ভাব। শ্বাস নিচ্ছেন জোরে জোরে। কেমন জানি একটা অশান্তিবোধ তাঁর মাঝে। এক পাশে তাঁর স্ত্রী বসে সার্বক্ষনিক দেখাশোনা করছেন। অপরপাশে আরো কিছু স্বজন বসা।
আমরা এক পাশে দাঁড়ালাম। বাড়তি মানুষের শব্দ শোনে তিনি চোখ খুলে তাকালেন। অশান্তির মধ্যেও যেনো ঠোটের কোণে তাঁর চিরায়েত হাসিখানা দেখতে পেলাম। তিনি ইশারায় আমাদের সালামের জবাব দিলেন। অনেকটা অচেতন হলেও তিনি যে আমাদেরকে দেখেই চিনে ফেললেন- তাঁর মুখায়ব দেখে এমনটা বুঝা গেলো। তিনজন সহকর্মীর এক পলক দর্শন তাঁকে যেনো খানিকটা শান্তিও দিলো।
সে যাক। রাত তখন ৮টার কাটায় ছুঁইছুঁই। ভিজিটরদের জন্য হাসপালের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় । তাই আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হলো। তবে বেরিয়ে আসার আগে তাঁকে শান্তনা দিতে গিয়ে বললাম, বাদশা ভাই চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবেন। আমাদের মধ্যে ফিরে আবারও লিখালিখ শুরু করবেন। তিনিও মাথা নাড়লেন। কারণ তিনি বাঁচতে চান। এ সুন্দর ভুবন ছেড়ে কেউ মরতে চায়না।
বাদশা ভাইর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করলাম। রাস্তায় তিনজন মিলে কথা বলতে বলতে পৌঁছে গেলাম নিজ নিজ গন্তব্যে। ঘরে ফেরার পর মৃতু্য ভাবনা আমাকে ঘিরে ধরলো । লেপটপ টেনে বসে পড়লাম। তাহলে ভাবনাগুলো শব্দবন্দি করে ফেলি।
ভাবছি নিজের কথা। এই যে বাদশা ভাইকে আশ্বাস দিয়ে এলাম। বললাম, চিন্তা করবেন না। সুস্থ হয়ে আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন। এই তো শেষ। তিনি সুস্থ হয়ে আসতে পারেন। নতুবা কফিনবন্দি হয়ে হাসপাতাল থেকে গার্ডেন অব পিসের অভিযাত্রীও হতে পারেন। আমরা কি তাঁর আর খবর রাখবো? শনিবার অফিসের কাজ নেই তাই হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যেতে পেরেছি। সোমবার থেকে কাজের ব্যস্ততায় হারিয়ে যাবো। বাদশা ভাইর কথা আর মনে থাকবে না। হঠাৎ হয়তো মোবাইল ফোনে টেক্স ম্যাসেজ ভেসে আসবে আমিনুল হক বাদশা আর নেই। মৃত্যু সংবাদটি আমাদের কষ্ট দেবে। কিছুক্ষণ তাঁকে নিয়ে ভাববো। এরপর ভুলে যাবো। সময় হলে হয়তো জানাজা ও দাফনে অংশগ্রহণ করতে পারবো। নতুবা নয়। এরপর আমি আমরা ভুলে যাবো বাদশা ভাইকে। মনে থাকবে না। কেউই মনে রাখবেনা।
ঠিক আমার অবস্থাও তো যেকোনো সময় বাদশা ভাইর মতোই হতে পারে। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যেতে পারি। হাসপাতাল বেডে বন্ধু-বন্ধুব আত্মীয় স্বজন দেখতে যাবেন। শান্তনা দিতে গিয়ে বললেন, ভাই চিন্তা করবেন। ইনশাল্লাহ সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। এরপর তারা আমাকে হাসপাতাল বেডে রেখে চলে আসবেন। পরদিন থেকে ভুলে যাবেন আমাকে। যেভাবে আমি ভুলে গেলাম বাদশা ভাইকে। আমি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারি। নতুবা গন্তব্য হতে পারে গার্ডেন অব পিস বা অন্য কোনো গোরস্থানে। এরপর কিছুদিন হয়তো আমাকে নিয়ে বন্ধু-বন্ধবদের মধ্যে কিছু আলোচনা, কথা বার্তা হতেও পারে । এরপর একসময় সকলেই ভুলে যাবেন। যুগের পর যুগ, শতাব্দির পর শতাব্দি পেরিয়ে যাবে কারো মনে থাকবে না আমি নামক মানুষটিকে।
সে যাক ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে বসে দীর্ঘ একটি গদ্য রচনা হয়ে গেলো। তাছাড়া আমার ঐ বন্ধুটি যিনি মৃতু্যর ভয়ে মৃত্যু নিয়ে লিখতে বারণ করছেন তাঁর জন্য এ লেখাটি ভীতিকর হলে তিনি আমাকে গালমন্দও করতে পারেন। তবে একটি কথা বলতে চাই-মৃত্যুর ভয়ে মৃত্যু সংক্রান্ত লেখা পড়া থেকে বিরত থাকলেও মৃত্যু কিন্তু আমাদেরকে অনুসরণ করবেই। কবর আমাদেরকে প্রতিদিন সত্তরবার ডাকছে। মৃত্যু কোন সময় আসবে আমরা জানিনা। আমরা আমাদের জন্ম তারিখটা জানি কিন্তু মৃত্যু তারিখটা জানি না।
পরিশেষে বাদশা ভাইর জন্য দোয়া করি, আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করে আমাদের মধ্যে আবারও ফিরিয়ে আনুক। আমিন।
বিষয়: বিবিধ
৩০০৭ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জীবনের নির্মম সত্য 'মৃত্যু' কে এড়িয়ে যাওয়ার কোন পথ নেই। জন্মিলে মরিতে হবেই।
মৃত্যু নিয়ে অসাধরণ লেখনীর জন্যে অনেক ধন্যবাদ ।
'বাদশা'ভাই কে পরিপুর্ণ সুস্হ্য করে মহান আল্লাহ আবার সবার মাঝে ফিরিয়ে দিন, আমাদের ও ড়ি দোয়া।
সুন্দর ও সময়োপযোগী লেখাটির জন্য শুভেচ্ছা ....
আপনি যার কথা লিখেছেন ইনি কি শেখ মুজিবর রহমান এর প্রেস সচিব ছিলেন।
ধন্যবাদ আমাদের অন্তর চক্ষু খুলে দিয়েছেন।
দোয়া করি, আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করে আমাদের মধ্যে আবারও ফিরিয়ে আনুক। আমিন।
জাযাকুমুল্লাহ
অনেক মুল্যবান আলোচনা করে সবাইকে স্থায়ী নিবাসের কথা স্মরন করিয়ে দিলেন ।তাই আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরুস্কার দান করুন আরআমি ও বাদশা ভাই সহ সকল রুগীদের আল্লাহ সুস্থ্যতা দান করে নেকহায়াত দিন।
দোয়া করি আবার তিনি সুস্থ হন। আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন