গার্ডেনস অব পিস-এ কিছুক্ষণ কেউ মনে রাখবে না

লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৯:০৭:০২ সকাল



লন্ডনে আসার পর গার্ডেনস অব পিস-এ (মুসলিম কবরস্থান) প্রথম গিয়েছিলাম ২০০৮ সালের ১লা আগষ্ট। আর দ্বিতীয়বার গেলাম আজ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩। ঐদিন ছিলো এক নিকটাত্মীয়ের দাফন। আজ ছিলো আমার দাদী শাশুড়ির । জানাজা ও দাফন থেকে ফিরে কিছুই ভালো লাগছেনা। মৃতের চেয়ে জীবিত আমাকে নিয়েই আমি গভীর উদ্বিগ্ন।

আমার চোখের সম্মুখে দাদী শাশুড়ির দাফনের দৃশ্যটি বারবার ভাসছে। আমি যেনো এখনো দেখছি, তাঁকে কিভাবে কবরে নামানো হচ্ছে। বাক্সের মতো একটি গর্তে তাকে কিভাবে শোয়ে রাখা হলো। উপরে কাঠ বিছিয়ে তার উপরে মাটি দেয়া হলো। সবমিলিয়ে এটি ছিলো মাত্র আধাঘন্টার একটি কার্যক্রম । আমরা অর্ধশতাধিক মানুষ তাতে অংশগ্রহন করলাম।

এমনিতে ফেইসবুকে বসলে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়। কোন দিকে সময় পেরিয়ে যায় টেরই পাওয়া যায়না। কিন্তু মাত্র আধঘন্টা সময়ে শেষ হওয়া এই দাফন কর্মযজ্ঞটি আমার মনের গহীনে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকলো। আমাকে আলোড়িত করলো দারুনভাবে।

গার্ডেনস অব পিস । সরল বঙ্গানুবাদে অর্থ দাড়ায়-শান্তিময় বাগানগুলো। লন্ডনে যাকে আমরা মুসলিম সেমিট্রি বলি । বাংলাদেশে বলা হয় গোরস্থান । এই একটি স্থানে পৃথিবীর সর্বস্তরের মানুষের মুল্যায়ন অভিন্ন। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে রাস্তার কুলি কিংবা মুচি ব্যক্তিটিও সমাহিত হন একই কায়দায় । একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো কোনো অবিসংবাদিত নেতার জন্য যতটুক জায়গা বরাদ্দ থাকে ঐ কুলি ব্যক্তিটির জন্যও কিন্তু ততটুকু জায়গাই বরাদ্দ থাকে। যে সাদা কাপড় পরিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান ব্যক্তিটিকে দাফন করা হয় একই কাপড়ে কবরস্থ করা হয় রাষ্ট্রের একজন মজুরকেও । এই একটি জায়গায় গেলে অন্তত: কোনো তারতম্য দেখা যায়না । জন্মের সময়ে মায়ের গর্ভ থেকে যেভাবে আসা, চলে যাওয়ার সময়ও ঠিক তেমনী। ব্যতিক্রম শুধু সেখানে। কেউ হয়তো উন্নত হাসপাতালে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় জন্মগ্রহন করেছেন। আবার কেউ হয়তোবা কুড়ে ঘরে একজন নিরক্ষর ধাত্রীর সহযোগিতায় ভুমিষ্ট হয়েছেন । কিন্তু মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে আসাটা ছিলো কিন্তু একইভাবে। তেমনী বিদায় বেলায় কাউকে হয়তোবা রাষ্ট্রিয় মর্যাদায় দাফন করা হতে পারে। কারো কফিন ফুলে ফুলে ভরে দেয়া হবে । সোনার তৈরী কফিনে করে লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। আবার কাউকে হয়তো বাশেঁর তৈরি একটি সাধারণ কফিনে নিয়ে যাওয়া হবে। অর্থাভাবে নিম্নমুল্যের সাদা কাপড়ে মোড়িয়ে দেয়া হবে । তবে সকলকে কিন্তু যেতে হবে একই মাপের কবরে।

শুধু মাঝে যে কয়টি বছর আমরা বাঁচি, ভেদাভেদ শুধু সেখানেই। কেউ মন্ত্রী, কেউ এমপি, কেউ নেতা, কেউ মুচি, কেউ মজুর-কুলি । কিন্তু গন্তব্য সকলের একই জায়গায়। সেটা হচ্ছে কবর। গার্ডেনস অব পিস। যে যা-ই করিনা কেন। আমাদের অনন্তকালীন জীবনের প্রথম স্টেশন হচ্ছে কবর।

আমার কিছুই ভালো লাগছেনা। শুধু মনে হচ্ছে-আমরা এতগুলো মানুষ একজন মহিলাকে একটি গর্তে একা ফেলে চলে এলাম । আমরা এতই নিষ্ঠুর। আমাদের করার কিছুই কি ছিলোনা। ঐ মহিলার আত্মাটি হয়তো পাশে থেকে আমাদের ডাকছিলো । আমাকে কেন একা ফেলে যাচ্ছো। নিয়ে যাও আমাকে। কিন্তু আমরা কেউই তার আর্তনাদ শুনছিনা। শুনতে পারছিনা। শোনলেও আমাদের ফিরে আসা ছাড়া করার কিছু নেই।

এই যে তাকে একা গর্তের ভেতরে রেখে এলাম। আমি জানি, বিশ্বাসও

করি । আমাকেও যেকোনো সময় যেকোনো মুহুর্তে এভাবে নিয়ে যাওয়া হবে। এভাবেই একটি অন্ধকার নির্জন গর্তে শোয়ে রেখে আসা হবে। আমার আত্মাটিও হয়তো কাঁদবে। সকলকে ডাকবে । কিন্তু কেউই সেই ডাক শোনবে না। কেউ সাড়া দেবেনা। খুবই তাড়াহুড়ো চলবে আমার দেহটি কবরস্থ করে ফিরে যেতে । আমার জন্য আর কারো কোনো প্রয়োজন থাকবেনা। এই একটু আগেও হয়তো আমার টেলিফোনে একটি দেশের যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যেতো। আমার নির্দেশে যুদ্ধ লেগেও যেতো। হাজার হাজার মানুষের প্রাণ যেতো । আজ কিন্তু আমার আর কোনো শক্তি নেই। আমাকে আর কারো নু্যনতম প্রয়োজন নেই। আমি এখন পরিত্যক্ত একটি মুল্যহীন বস্তু । আমার সাথে যে ব্যক্তিটির সারাজীবন মাখামাখি ছিলো। যার সাথে এক বেডে না শুইলে ঘুম আসতোনা। সেই প্রিয়তম স্ত্রীর কাছেও আমি এখন পরিত্যক্ত মরদেহ । এই একমিনিট আগেও আমাকে মহামান্য বা মাননীয় বলে সম্বোধন করতে হয়েছে। মাননীয় বিচারপতি না বলে সম্বোধন না করলে পথিমধ্যে কোর্ট বসিয়ে সাজা দিয়েছি। কিন্তু এক মিনিট পরে আমার মতো মাননীয় বা মহামান্য ব্যক্তিকে আর কেউ নাম ধরেও ডাকে না। এখন বলা হয় অমুকের মরদেহ। মরহুম অমুক।

এই যে আমাকে গর্তে ফেলে প্রত্যেকেই নিজ নিজ ঘরে ফিরে গেলেন। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দৈনন্দিন কর্মজীবনে । তারা মনে রাখলেন আমাকে কিছুদিন। মাঝে মধ্যে তারা আমার কবর জিয়ারতে এলেন। ফিরে গেলেন। মৃতু্যবার্ষিতীকে কুরআনখানী ও দোয়া-দুরুদ করলেন। যতদিন তারা বেঁচে থাকলেন শুধু ততদিন। কিন্তু একসময় তারাও মারা গেলেন। তাদের ছেলে সন্তানরা হয়তো আমাকে মাঝে মাধ্যে স্বরণ করলো। কবরস্থানে গেলে আমার কবরের পাশে দাড়িয়ে জিয়ারতও করলো। কিন্তু এক সময় তরাও মরে গেলো। একসময় কবরের স্থান সংকুলানের জন্য আমার অবশিষ্ট হাড়গুলো তুলে ফেলা হলো। যেখানে অন্য একজনকে কবরস্থ করা হলো। আমার কবরের নামফলকটিও সেখান থেকে তুলে ফেলা হলো। এখন আমার নামটি আর সেখানে নেই। কবরে সাইনবোর্ডেটিও নেই। কোনো মানুষের মনেও আমি নেই। আমার নামখানি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। বিশ্বে হারিয়ে যাওয়া এক মানুষ হয়ে গেলাম আমি।

অথচ একটি সময় আমার কী বর্ণাঢ্য জীবন ছিলো । আমার কী জৌলুশ ছিলো। দামী পাজেরো গাড়ি হাকিয়ে আমি চলতাম। মানুষ আমাকে দেখলে হ্যান্ডশেক করতে ভীড় জমাতো। ঠেলাধাক্কা সামলাতে আমাকে সিকিউরিটি নিয়ে চলতে হতো । প্রটোকলের মধ্যে চলাফেরা করতে হতো। পুলিশ বেস্টনীর ভেতরে ছিলো আমার বসবাস । আমি কোথাও গেলে লাল গালিচা বিছিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু আজ আমার নামটিও কেউ জানেনা। কেউ মনে রাখেনি আমাকে। কোটি কোটি বছর আয়ুর এই পৃথিবীর অগণিত মানুষের সাথে আমিও একজন ছিলাম। এই পৃথিবীর কোনো একটি ক্ষুদ্র আয়তনে আমার বিচরণ ছিলো। সেখানে আজ আর আমার কোনো পদচিহ্ন নেই। নেই কোনো স্মৃতি চিহ্ন।

এই লেখাটি যখন লিখছি রাত তখন সাড়ে ১২টা। ঘরের দেয়ালে ঝুলন্ত ঘড়িটি টিকটিক শব্দে সময় গুণছে। সেকেন্ডের কাটার টিকটিক শব্দ আমাকে নিয়ে গেলো ভাবনার জগতে।

আমার মৃতু্য কখন হবে আমি জানিনা। জানিনা বলেই নামাজ পড়িনা। হজ্জেও যাইনা। মনে হয় সময় তো আছে। জীবনের মাত্র ৩০টি বসন্ত পেরিয়েছি। এখনও অর্ধেক জীবন বাকী আছে। নামাজ-কালাম করার সময় তো আছে। জীবনের শেষ দিকে হজ্জ করে সব গুনা মাফ করিয়ে নেবো। এখন জীবন উপভোগের সময়। অর্থ উপার্জনের সময়। নেতৃত্ব দিয়ে সমাজে খ্যতি অর্জনের সময়। ইবাদত করার সময় আছে। এগুলো পরে করবো।

বিষয়টি এবার আমি অন্যভাবে ভাবতে শুরু করলাম । আমাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। আজ রাত ১২টা ১মিনিটে। জানানো হলো, সময় আছে মাত্র এক ঘন্টা। তাহলে আমার এই আধঘন্টা সময় কতটুকু দীর্ঘ মনে হবে? কত কিছু করতে মন চাইবে? আধঘন্টা জীবনের গুরুত্ব আমার কাছে কত বছরের সমান মনে হবে? এই সময়ে নিশ্চয় মৃতু্যর ভয়ে আমার ঘুম আসবেনা। আমি নিশ্চয় এই আধঘন্টা সময় আল্লাহর জন্য উতসর্গ করে দেবো। কারণ আমি জানি মৃতু্য আমার সম্মুখে। এক ঘন্টা পরেই আমি অজানা এক সত্যকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছি।

তাহলে জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে আমি কি এভাবে ভাবতে পারিনা। যে আমার কাছে আর মাত্র এক ঘন্টা সময় আছে। আমাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। আমি মরে যাবো। আমাকে মরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। পরকালের জন্য যা প্রয়োজন তা এখনই যোগাড় করে নিতে হবে। আমি, আমরা কেন এমন পারিনা। কেন? বড়ই আফসোস হয় আমার।

তাইছির মাহমুদ

লন্ডন । ৩০ ডিসেম্বর ২০১৩

বিষয়: বিবিধ

১৫৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File