কোনটি আনন্দের? বাবার হাত ধরে ঈদগাহে যাওয়া, নাকি পিতা হয়ে পুত্রকে নিয়ে ঈদের নামাজে যাওয়া?
লিখেছেন লিখেছেন তাইছির মাহমুদ ০৮ আগস্ট, ২০১৩, ০৮:৪৩:২১ সকাল
ছোটকালের ঈদ মানেই ছিলো নতুন জামা কাপড়। সকালে ঘুম থেকে জেগে পুকুরে ডুব দিয়ে গোসল। তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে মুছতে মায়ের হাতের তৈরী গরম সুস্বাধু সন্দেশ খাওয়া। তারপর নতুন পাজামা পাঞ্জাবী আর রঙিন টুপি পরে বড়দের সাথে ঈদগাহে যাওয়া। নামাজ শেষে দলবেধে দাদা-দাদী ও নানা-নানীর কবর জিয়ারত করা। আমার নানা বাড়ি ছিলো আমাদের লাগোয়া গ্রামে। তাই দাদা দাদীর কবর জিয়ারত শেষে নানা বাড়ির গোরস্থানে গিয়ে নানা নানীর কবর জিয়ারত করা ছিলো ঈদের দিনের রুটিন ওয়ার্ক। তারপর গোরস্থান থেকে সরাসরি নানা বাড়ি যাওয়া।
নানা বাড়ি লাগোয়া গ্রামে হওয়ায় নানা মামা খালাদের অভাব ছিলোনা। গ্রামের সকলই যেনো মায়ের সম্পর্কে আত্মীয় হতেন। তাই প্রায় সকল বাড়িতেই যাওয়া হতো। যার ঘরেই যেতাম ভাগনা কিংবা নাতি বলে সম্বোধন করতেন। আলাদা যত্নপাত্তিও করা হতো আমাদের।
নানার গ্রামে ঘুরাঘুরি শেষ হলে আমাদের গ্রামে ফেরা। সেখানে গোষ্ঠির চাচাদের বাড়িতে যাওয়া। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। সারাদিনই এভাবে কেটে যেতো। বাড়ি ফিরতে যেনো ভুলেই যেতাম। বিকেলে বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফের বেরিয়ে পড়তাম। ঈদ উপলক্ষে বাড়ির সম্মুখে খোলা মাঠে ষাড় লড়াইর আয়োজন করা হতো। হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হতেন দেখার জন্য। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বাররাও আসতেন। বিজয়ী ষাড়ের মালিককে পুরস্কৃত করা হতো। সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবেই চলতো ঈদের আনন্দ উপভোগ।
তবে ঈদের আনন্দ এখানেই শেষ নয়। ঈদ এলেই সপ্তাহ দশদিনের জন্য মায়ের সাথে নানাবাড়ি যাওয়ার সুযোগ হতো। বাড়িতে বাংলা ও আরবী পড়ার জন্য বাবার কঠোরতার মাঝে সপ্তাহ দিনের জন্য নানা বাড়ি যাওয়ার সুযোগ ছিলো বাড়তি আনন্দ। কারন নানা বাড়ি মানেই অফুরন্ত আনন্দ। বাধবাঙ্গা আনন্দের জোয়ার। মাঝে মধ্যে যখন মাস-দেড় মাস পর নানা বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরতাম তখন মনে হতো সবকিছু যেনো বদলে গেছে। বাড়িটি যেভাবে রেখে গিয়েছিলাম সেভাবে আর নেই।
পৌষ ও মাঘ মাষের হাড় কাঁপানো শীতে আমি কয়েকবার ঈদ করেছি। ঐ সময় ঈদের সব আনন্দ ম্লান হয়ে যেতো একটি কথা ভেবে। সেটা হচ্ছে- খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রচন্ড ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে হতো । ঈদের দিন গোসল করাটা যদিও সুন্নাত, কিন্তু এমনভাবে গুরুত্ব দেয়া হতো মনে হতো যেনো গোসল না করলে ঈদই হবেনা। তাই ঈদের দুচারদিন আগে থেকেই সকালের গোসল নিয়ে ভীত থাকতাম। মনে হতো, ঈদের দিন কেন গোসলটা অপরিহার্য করা হলো, এটা না হলে ভালো ছিলো।
তবে আমরা ভাই-বোন মিলে আগে থেকেই শীত নিবারনের ব্যবস্থা করে নিতাম। বাড়ির পাশের শুকনো খেত থেকে খড়ের স্তুপ এনে ছোট একটি ঘর তৈরী করতাম। এই ঘরকে মেড়ামেড়ির ঘর বলতাম। পুকুর পারে খোলা জায়গায় ঘর তৈরী করা হতো। ভাই বোন মিলে পুকুর ঘাট থেকে এক সাথে একটি লাফ দিয়ে পুকুরের পানিতে পড়তাম। মাত্র ৩০ সেকেন্ডে একটি ডুব দিয়েই পুকুর থেকে উঠে আসতাম। আগুন ধরিয়ে দিতাম মেড়ামেড়ির ঘরে। মুহুর্তে দাউদাউ কলর জ্বলে উঠতো আগুন। আর শীতও পালিয়ে যেতো।
পরবর্তীতে শহরে পাড়ি দিলে ঈদের সেই আমেজ অন্যরকম হয়ে গেলো। শহুরে ঈদ অন্যরকম। এখানে ঠান্ডার মধ্যে বাথরুমে গোসল করতে হয়। পুকুরে লাফ দিয়ে ৩০ সেকেন্ডে গোসল সারার সুযোগ নেই। গোসল শেষে খড় জ্বালিয়ে আগুন পোহানোরও সুযোগ নেই। নানা বাড়ি নেই। গ্রাম-গঞ্জ নেই। আছে পাড়া। পাড়ার এ বাসা থেকে ও বাসায় বন্ধু বান্ধবদের বাসায় ঘুরে বেড়ানো যায় । কিংবা প্রিয়জনকে নিয়ে কয়েকঘন্টা রিক্সায় ঘুরে বেড়ানোও ঈদের আনন্দ হিসেবে মন্দ হতোনা। সন্ধ্যায় হয়তো বন্ধু-বান্ধব মিলে সিনেমা হলে ঈদের সিনেমা দেখে জম্পেশ একটি আড্ডা দেওয়া-এই ছিলো শহরের ঈদ আনন্দ।
লন্ডনে আসার পর একটি সমস্যা কেটে গেলো। সকালে গোসল নিয়ে আর ভীত সন্ত্রস্ত থাকতে হয়না। কারণ বাথরুমের শাওয়ার টিপলেই গরম পানি আসে। সন্দেশ পিঠারও অভাব হয়না। নিজের ঘরে তো রকমারী পিঠা-পায়েশ তৈরী হয়ই, উপরন্তু যে ঘরে বেড়াতে যাওয়া হয় সেখানেই সন্দেশ পিঠা খেতে রীতিমতো পীড়াপীড়ি শুরু হয়ে যায় । এখানে ঈদগা নেই। তাই খোলা প্রন্তরে নামাজ পড়ার সেই আনন্দ নেই। মসজিদের চার দেয়ালে বন্দি হয়ে নামাজ পড়তে হয়। তবে সব কিছু মিলিয়ে লন্ডনে ঈদের আনন্দ একেবারে কম নয়।
এক সময় সকালে ঈদগাহে যেতাম বাবার হাত ধরে । এখন সেই হাতটি ধরে ঈদের নামাজে যায় আমার ছয় বছরের ছেলে জিবরিল ও পাঁচ বছরের মেয়ে সারাহ। মিকাইলের অবশ্য ঈদের নামাজে যাওয়ার বয়স হয়নি। বাবার সাথে ছেলে হয়ে ঈদগাহে যাওয়ার আনন্দ বেশী নাকি বাবা হয়ে পুত্রকে নিয়ে নামাজে যাওয়ার আনন্দ বেশী-আজকের ঈদে ব্যবধানের মাত্রাটি খুঁজছি। সকলকে নিরন্তর ঈদ শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
তাইছির মাহমুদ, লন্ডন।
বিষয়: বিবিধ
১৮৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন