পথহারা বুদ্ধিজীবী
লিখেছেন লিখেছেন শিক্ষানবিস ১৮ মার্চ, ২০১৩, ০৩:২৭:৩৭ দুপুর
দৈনিক ইনকিলাব থেকে
17.03.2013
বিশেষ সংবাদদাতা :
যাত্রাবাড়ি টু মিরপুর রুটের ‘ট্রান্স সিলভা’র একটি বাস কাটাবন থেকে নীলক্ষেতের দিকে মুখ ঘুরাতেই এক যাত্রী চিৎকার করে উঠলেন; ‘ড্রাইভার কোন দিকে যাচ্ছেন। আমি মৎস্যভবনে নামবো।’ হেলপার অভয় দিয়ে জানালেন, যাত্রীকে মৎস্য ভবনের সামনে নামিয়ে দেয়া হবে। তবে বাস গুলিস্তান যাবে না। যারা গুলিস্তান ও পল্টন যাবেন তাদের বিজয়নগর অথবা কাকরাইলে নামতে হবে। হেলপারের কথায় ক্ষেপে গেলেন এক মহিলা যাত্রী। ছোট্ট একটি শিশুকে নিয়ে তিনি নামবেন গুলিস্তানে। তিনি অনুনয়-বিনয় করতে লাগলেন। মহিলার অনুনয় শুনে ড্রাইভার বললেন, আপা শাহবাগের রাস্তা বন্ধ করে একমাস ধরে আন্দোলন করছে তরুণ প্রজন্ম। তারা নাকি রাস্তা বন্ধ করে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ করছে। সরকার তাদের খাবার দিচ্ছে, পুলিশ দিয়ে পাহারা দিচ্ছে। বাধ্য হয়েই আমাদের অন্য পথে যেতে হচ্ছে। মহিলাকে কাকরাইলে নেমে রিকশায় গুলিস্তান যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বয়স্ক এক যাত্রী বললেন, ওরা (শাহবাগের তরুণ) সরকারের কাছে চাকরি চায় না; ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের কঠোর বিচারও চায় না; চায় শুধু ফাঁসি। দেশের সবচেয়ে বড় দুইটি হাসপাতালের সামনে মাসের পর মাস রাস্তা বন্ধ করে তারা নিজেরাই কি মানবতাবিরোধী কাজ করছে না? যারা অসুস্থ রোগী নিয়ে বারডেম ও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে যাচ্ছেন তারা বুঝছেন যন্ত্রণা কাকে বলে। শুক্রবারের বাসযাত্রীদের এসব কথাবার্তায় বিরক্ত হচ্ছিলেন এক যুবক। তিনি মুখ খুললেন। বললেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলো রাজনীতির খেলা। যুদ্ধাপরাধীরদের বিচার যদি ’৭২ থেকে ’৭৪ সালে হতো তাহলে জাতি দুইভাগ হতো না এবং মানুষকে এতো দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। সে সময় ক্ষমতাসীনরা ‘যুদ্ধ শেষে প্রাপ্তি’ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এদিকে নজর দিতে পারেননি।
গুলিস্তানে হকারের দোকানে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছেন কয়েকজন। ইনকিলাব হাতে নিয়ে এক বৃদ্ধ অন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন, মুন্সিগঞ্জে খালেদা জিয়া বলেছেন, মসজিদে তালা আর নাস্তিকদের পাহারা দিচ্ছে সরকার। তিনি ঠিকই বলেছেন। জাতীয় মসজিদের সরকার তালা ঝুলিয়ে শাহবাগের ব্লগারদের পাহারা দেয়া হচ্ছে। তিনি (খালেদা জিয়া) ব্লগারদের নাস্তিক হিসেবে অভিহিত করে শাহবাগের মঞ্চ ভেঙ্গে ফেলার কথা বলে তৌহিদী জনতার কাছে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। এখন তিনি জামায়াতীদের খপ্পর থেকে বের হলে আওয়ামী লীগ ও বুদ্ধিজীবীরা উচিৎ শিক্ষা পাবেন। দেশের ওলামা মাশায়েখরা তার পিছনে নামবেন। কিছু বুদ্ধিজীবীরা অন্ধ হয়ে শাহবাগীদের পক্ষ নিয়ে জামায়াতের বিরোধিতা নামে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলছেন। তারা দাবী করছেন শাহবাগীরা নাস্তিক নয়। তাই সভা, সেমিনারে বক্তৃতা বিবৃতি, টেলিভিশনের টকশোতে তারা শাহবাগীদের দেশপ্রেমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। বৃদ্ধের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এক তরুণ প্রশ্ন করে বলেন, আমরা তরুণ নই? শাহবাগেতো যাইনি। দেশে ৫ কোটি তরুণ রয়েছে। শাহবাগে কতজন তরুণ আছে? খালেদা জিয়া ওই তরুণদের নাস্তিক বলায় ক্ষেপে গেছেন বুদ্ধিজীবীরা। অথচ ওই তরুণের হোতা (ইমরান এইচ সরকার) বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘আপনি নাস্তিকদের সাথে থাকবেন না জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে থাকবেন সিদ্ধান্ত নিন।’ এমরানের এ কথায় প্রমাণ হয় তারা নাস্তিক। অথচ কিছু মুখচেনা বুদ্ধিজীবী শাহবাগীদের ইসলামের বিরুদ্ধে নয় বলে প্রচার করে দেশের আলেম ওলামাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে। এসব বক্তব্য শুনে পত্রিকা বিক্রেতা বললেন, ভাই বুদ্ধিজীবীদের কথা বলবেন না। এরা পথহারা বুদ্ধিজীবী। দিল্লীর লাড্ডু আর আওয়ামী লীগ সরকারের হালুয়া-রুটি খেয়ে ‘নৌকা’য় বিবেক বন্ধক রেখেছেন। এতোই অন্ধ যে এরা সরকারের কোনো দোষ দেখেন না। বিশ্বজিৎকে ছাত্রলীগের নেতারা দিনে দুপুরে পুলিশের সামনে চাপাতি দিয়ে হত্যা করলেও এরা সেটাকে সংখ্যালঘু নির্যাতন মনে করেন না। মানুষ আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে সারাদেশে শত শত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বাড়ি তছনছ করেছে। এতে কিছু হিন্দুর বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। এরা এটাকেই সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসেবে প্রচার করছে। দিনরাত অশ্রু বিসর্জন করছে। যে কারো উপর আঘাত সমর্থন যোগ্য নয়। আর সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য সরকারের সমালোচনা করছেন না। কিন্তু সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমনের কথা প্রচার করে সারাদেশের আওয়ামী লীগের উপর সাধারণ মানুষের অক্রোশের চিত্র আড়াল করতে চাইছেন। এই বুদ্ধিজীবীরা শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারী, হলমার্ক, ডেসটিনি কেলেঙ্কারী, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারী নিয়ে দেশ-বিদেশে হৈচৈ হলেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কালো বিড়াল হয়ে কোটি টাকা লুট করলেও তা চোখে দেখেন না। মওদুদীবাদে বিশ্বাসী জামায়াতÑশিবিরের বিরোধিতা করতে গিয়ে তৌহিদী জনতা আর আলেম ওলামাদের সমালোচনা করছেন। অথচ ছাত্রলীগের রংপুরে শিক্ষককে এসিড নিক্ষেপ, বরিশালে বিএম কলেজের অধ্যক্ষকে প্রকাশে দৌড়ানো, কুষ্টিয়ায় শিক্ষকদের পেটানো, সিলেটে হলে আগুন দেয়া, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীর গায়ে হাত উঠানোর পর নীরব থাকেন। হালুয়া-রুটির বালাই সবচেয়ে বড় বালাই। হকারকে থামিয়ে দিয়ে একজন বললেন, ভাই সরকার বলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী এজে-া। সে জন্যই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করছে; এটা ভাল। বুদ্ধিজীবীরা এসব কথা বলছেন টেলিভিশনের টকশোগুলোতে। প্রশ্ন হলো শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করাই কি আওয়ামী লীগের একমাত্র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল? তারা কি ক্ষমতায় গেলে ঘরে ঘরে চাকরি, বাজার সিন্ডিকেট বন্ধ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সংসদ কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দেয়নি জনগণকে? বুদ্ধিজীবীরা এসব কথা বলছেন না কেন? এসব প্রত্রিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছেন না কেন? বুদ্ধিজীবীদের উচিত শাহবাগী তরুণদের দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির পাশাপাশি যুবকদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জনমনে চলমান অনিশ্চয়তা-আতঙ্ক দূর করার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা। তারা এসব করবেন না। কারণ এটা করলে দিল্লীর লাড্ডু আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের লোভনীয় পদ, পুরস্কার বাগাতে পারবেন না।
শুক্রবার ও শনিবারের এ দু’টি ঘটনায় চরমান পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যেকার ক্ষোভের খ-চিত্র মাত্র। শুধু বাসের যাত্রী আর পত্রিকার স্টলের দৈনিক পত্রিকা পাঠক নন; সারাদেশের মানুষের প্রায় একই মনোভাব, একই অভিব্যক্তি। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে সরকারি দল আর বিরোধী দল মুখোমুখি। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী আর কয়েকমাস পর নির্বাচন। অথচ নির্বাচন কোন পদ্ধতির সরকারের অধীনে হবে তা এখনো দেশের মানুষ জানেন না। কিছু বুদ্ধিজীবী আওয়ামী লীগের একগুয়েমির প্রতি পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করলেই অবাধ নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব বলে মত প্রকাশ করছেন। মিডিয়ায় এ নিয়ে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। অথচ তলে তলে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের এজে-া বাস্তবায়নের জন্য ‘বিদ্রোহী প্রার্র্থী’ নির্বাচনের অংশ নিতে পারবেন না এমন আইন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বিদ্রোহী প্রার্থীর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পথরুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কি গণতন্ত্র চর্চার সঙ্গে যায়? শাহবাগে মানবতাবিরোধীদের ফাঁসির দাবিতে অবস্থান কর্মসূচিতে স্কুল থেকে শিশুদের আনা হচ্ছে। শিশুদের দিয়ে ‘ফাঁসি চাই’ ‘ফাঁসি চাই’ শ্লোগান দেয়ানো হচ্ছে। কোমলমতি শিশুদের দিয়ে এধরনের কাজ কি কোনো বিবেকবান মানুষ করতে পারেন। সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার সময় তিনি (সাঈদী) কিছু কথা বলতে শুরু করতেই একজন বুদ্ধিজীবী (তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি) চিৎকার করে বলেন, ‘কুত্তার বাচ্চা’ চুপ করো। এই বুদ্ধিজীবীর কাছে জাতি কি আশা করতে পারেন। তিনি শিক্ষার্থীদের বা কি নৈতিক শিক্ষা দেবেন?
বিষয়: বিবিধ
১০৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন