টিভি দেখা হারাম : ইদানিং অনুভব
লিখেছেন লিখেছেন শিক্ষানবিস ১৪ মার্চ, ২০১৩, ০৬:০৯:২২ সন্ধ্যা
আমার শৈশব থেকে বলছি। তখন ধর্মপ্রাণ সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল, টিভি দেখা, ঘরে টিভি রাখা জায়েয নয়।
আমার আব্বাকে যখন ভক্তরা দুআ-মুনাজাতের জন্য তাদের বাসায় দাওয়াত দিত তখন তিনি প্রশ্ন করতেন, বাসায় টিভি আছে কিনা। যদি টিভি থাকত তাহলে তিনি যেতেন না। আম্মাকে দেখেছি এক বাসা থেকে প্রেরিত হাদীয়া ব্যবহার না করে অন্য মানুষকে দিয়ে দিলেন। কারণ, যারা পাঠিয়েছে তাদের বাসায় টিভি আছে। সে সময় যাদের বাসায় টিভি থাকত তাদের বাসায় বিশাল দীর্ঘ বাশের মাথায় এন্টেনা দেখা যেত। কাজেই টিভির উপস্থিতিকে গোপন করার কোন সুযোগ ছিল না। ঢাকা শহরে কোন দালানের ছাদে উঠে তাকালে দিগন্ত জুড়ে শুধু টিভি এন্টেনাই নজরে আসতো। একটি দালানে বারোটি ফ্যামিলি বসবাস করলে ছাদে বারোটি লম্বা বাশ, সাথে তার ও এন্টেনা দেখা যেত। বাসা বদল করলে ঠেলাগাড়ীতে মাল-সামানের সাথে এই লম্বা বাশ শোভা পেত।
এ হারামের ধারনাটা এত প্রবল ছিল তা বুঝার জন্য একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। ১৯৮১ সনে হাফেজ্জী হুজুর যখন রাজনীতিতে আসলেন, তখন সাংবাদিকরা তাকে সবচে বেশী যে প্রশ্নটি করেছে তাহল, টিভি দেখা জায়েয, না হারাম? একদিন দেখলাম কয়েকটি জাতীয় দৈনিক সবচেয়ে বড় শিরোনামে খবর দিয়েছে, টিভি দেখা হারাম নয় - হাফেজ্জী হুজুর।
সংবাদের মূল কথা ছিল, হাফেজ্জী হুজুর ফতোয়া দিয়েছেন, খালি চোখে যা দেখা জায়েয, টিভিতেও তা দেখা জায়েয।
হাফেজ্জী হুজুরের এই ফতোয়ার সমালোচনা কম হয়নি আলেম সম্প্রদায় ও ধর্মপ্রাণ সমাজে। আর বৈরী পত্রিকা ও বাম-রামেরা এটাকে বলেছে ভন্ডামী। তারা বলত, প্রতিক্রিয়াশীল ধর্ম ব্যবসায়ীরা এতদিন যা হারাম বলে আসছে রাজনৈতিক স্বার্থে তারা এখন বিলকুল জায়েয বলছে। চরম বাম-রামপন্থী বলে পরিচিত কবি সুফিয়া কামাল এর সাথে যোগ করে বলেছে, বহুদিন পর্যন্ত মোল্লারা মাইককে হারাম বলে আসছিল। পরে দেখা গেল প্রতিটি মসজিদে এই হারাম মাইক স্থান পেয়েছে।
এরপর থেকে আমিও টিভি দেখাকে আর হারাম ভাবছি না। হারাম বলে ফতোয়া প্রচার করছি না।
আমার এক সহপাঠি তাবলীগে সময় লাগিয়ে বাড়ীতে এসে ত্রিশ হাজার টাকা দামের টিভি সেটটি ভেঙ্গে ফেলেছে। এ নিয়ে তাদের ফ্যামিলিতে বিশাল হাঙ্গামা দেখা দিল।
আমি যখন ২০০২ সালে স্বপরিবারে ঢাকাতে বসবাস শুরু করলাম তখন টিভি কিনলাম। আমার বাড়ীতে এ খবর পৌছলে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেছে। আম্মা প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি কখনো আমার বাসায় যাবেন না।
আম্মাকে অনেক বুঝিয়ে বাসায় নিলাম। বললাম, আমরা টিভিতে খারাপ কিছু দেখি না। আপনি এসে দেখে যান। তারপরও যদি বলেন, টিভি বিক্রি করে দে, দেব।
একদিন রাত আটটার সংবাদ দেখতে বসালাম আম্মাকে। সংবাদ দেখতে বসে শুধু মাথায় ঘোমটা দেয় আর বলে, আমার বোরকাটা কই?
আমার স্ত্রী বলল, আপনি এখন বোরকা দিয়ে কী করবেন?
আম্মা বললেন, টিভির ঐ ব্যাটা খবর কয় আর বার বার আমার দিকে তাকায়। আমার বউ তাকে বলল, আপনাকে ঐ লোকটা নতুন দেখেছে তো এ জন্য বার বার তাকায়। পুরান হয়ে গেলে আর তাকাবে না।
সেই সময়ে বিটিভির সাথে ছিল একুশে, এটি এন আর চ্যানেল আই। এটিএন চ্যানেলে আল্লামা সাঈদী, আল্লামা জাফরী প্রমুখ দেশবরেণ্য আলেমগণ যখন প্রোগ্রাম শুরু করলেন, তখন বহু আলেম ও ইসলামওয়ালাদের ঘরে ডিসসহ টিভি ঢুকে পড়ল। আমার যে বন্ধুটি একদিন বাপের কেনা টিভি ভেঙ্গেছিল সেও বাসায় টিভিকে সযত্নে জায়গা দিল। আমার এলাকার ইমাম সাহেব গোপনে আমার বাসায় এসে টিভি দেখতেন। ভয় ছিল, ইমাম সাহেব বাসায় টিভি কিনলে তার পিছনে মুসল্লীরা নামাজ পড়বে না।
আজকে কি অবস্থা এই টিভি মিডিয়ার? দু একটি চ্যানেল ছাড়া সবগুলো সারাদিন মিথ্যাচার চালাচ্ছে। যেগুলো এই মিথ্যাচারে অংশ নিচ্ছে না, তাদের নিষিদ্ধের দাবী উঠছে। তারা তিলকে তাল করছে। কোথাও পর্বত উড়ে গেলে চুপ থাকছে। আবার কোথাও ইদুর বাচ্চা প্রসব করলে লাইভ দেখাচ্ছে আর পাগলা কুকুরের মত চেচামেচি করছে। শিশুদের দিয়ে ঘৃণা সৃষ্টিকারী শ্লোগান প্রচার করছে। মানুষের মাঝে ঘৃণা, ক্ষোভ, হতাশা ছড়াচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে তরুন সমাজকে বিভ্রান্ত করে অপরাধী বানিয়ে রাস্তায় নামাচ্ছে। নিরাপরাধ আলেম সমাজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দেশের কলঙ্ক বলে প্রচার করছে। টার্গেট করছে আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলামকে। আগে বিটিভিতে খবর চলাকালে বাচ্চাদের ডাকতাম। খবর শুনে ওদের সাধারণ জ্ঞানের পরিধি বাড়বে, এই আশায়। এখন পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে টিভিতে যখন খবর শুনি, তখন বাচ্চাদের দূরে সরিয়ে রাখি। তারা কোন কিছু দেখে ফেলে যখন প্রশ্ন করে তখন বলি, টিভির লোকেরা মিথ্যা বলেছে। ওরা আমাদের ধর্মের শত্রু, তাই মিথ্যা বলছে। তুমি দেখছ না লোকগুলোর নাম লগি, বৈঠা, দে, দাস, হালদার, পোদ্দার, পাল? তারা মুসলমান নয়। তাই তারা কতগুলো আলেম উলামা, পীর মাশায়েখ- যাদের অনেকে জামাতেরও বিরোধী- তাদের ছবি দেখিয়ে যুদ্ধাপরাধী রাজাকার বলে চেচাচ্ছে।
আর তখন ভাবি, যদি বাসায় টিভি না থাকত, আজ আমার প্রিয় সন্তানদের বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকত না।
সরকার দুটো টিভি চ্যানেলকে তাদের আঙ্গিনায় নিষিদ্ধ করেছে। এর মাধ্যমে আমরা পাবলিক বুঝে নিয়েছি বাকীগুলো তাদের দখলে থেকেই দাজ্জালের ভূমিকা পালন করছে।
আজ যদি হাফেজ্জী হুজুর এ অবস্থা নিজের চোখে দেখতেন, কি বলতেন? আমার মনে হয় বলতেন, আমার ফতোয়া ভুল ছিল। তোমরা দেশে এত মুসলমান থাকতে এ মাধ্যমটি সম্পূর্ণ দেশ ও ইসলামের শত্রুদের হাতে চলে যাবে, আমি কখনো ভাবিনি।
আমরা যখন শুনি, তালেবান তাদের এলাকায় টিভি নিষিদ্ধ করেছে, ভাবি, ওরা কত মূর্খ, কত প্রতিক্রিয়াশীল! কিন্তু আমরা তখন ভাবতে চাই না, যে টিভিগুলো তারা নিষিদ্ধ করছে সেগুলো আমাদের দেশের টিভির চেয়ে কি ভাল? না এগুলোর মতই ভিনদেশী এজেন্ট বা সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্টভোগী চাকর-চাকরানী দ্বারা পরিচালিত ও উপস্থাপিত?
তালেবান টিভি চ্যানেল নিষিদ্ধ করলে সেটা দোষের অবশ্যই আর আমাদের কোন কোন এলাকায় অমুক টিভি বা সমুক দৈনিক পত্রিকা নিষিদ্ধ করলে সেটা তালেবানের মত দোষের হয় না। হয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বা প্রগতিশীলতা। এই সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রের এমন নির্বিচার অবিচার থেকে জন্ম হয় তালেবানের, পয়দা হয় আল কায়েদার, সৃষ্টি হয় জেএমবি।
বিষয়টি নিয়ে আমি কোন সিদ্ধান্ত দেব না, আপনারাই চিন্তা করে দেখবেন, পুরাতন সেই ফতোয়াটা আবার নতুন করে দেবেন কিনা।
বিষয়: বিবিধ
১৬২০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন