অধ্যাপক গোলাম আজমের সাথে এক বিকেল

লিখেছেন লিখেছেন শিক্ষানবিস ২৪ অক্টোবর, ২০১৪, ০৮:৫২:১৮ রাত

আমি তখন রাজধানীর ধানমন্ডির একটি ইসলামিক ইনিস্টিটিউটের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল। ১৯৯৩ সালের আগষ্ট মাস। তারিখটা মনে নেই, ডায়েরীতে লেখা আছে।

একজন ছাত্র এসে বলল, গোলাম আজম স্যার আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান। যদি আপনি রাজী থাকেন, আপনার সাথে আমরাও যাবো।

আমি শুধু রাজী হয়ে গেলাম তা নয়, বিরাট সুযোগ মনে করলাম। তারিখ ঠিক করা হল। আমরা গেলাম। আছরের পর থেকে মাগরিব। একটি কনফারেন্স রুমে আমিসহ মোট কুড়ি জন। ঊনিশ জন আমার মাসিক ছাত্র। আমি অধ্যাপকের ডান পাশে বসলাম। যাকে নিয়ে এতো আলোচনা-সমালোচনা, তাকে আজ কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি তা নয়, তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছি। আজকের এই সংক্ষিপ্ত বৈঠকে তিনি আমাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশী।

আমার পড়াশুনা কোথায়, জানতে চাইলেন। আমি বললাম, হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস পাশ করেছি। শুনে বললেন, বাপরে বাপ! আপনি এমন জায়গা থেকে পড়াশুনা করে এসেছেন, যারা আমাদের সকাল-বিকাল কাফের বলে গালি দেয়।

আমি বললাম, না স্যার! এটা ঠিক নয়। এটা আপনার ধারনা, যা সঠিক নয়। এমন অনেক অবাস্তব ধারনা পোষণ আমাদের ঐক্যের একটি বাধা বলে আমি মনে করি। আমি দু বছর হাটহাজারী মাদরাসায় পড়শুনা করেছি, কখনো কারো মুখে শুনিনি, জামাতে ইসলাম বা মওদুদী কাফের। বরং তারা বেশী বললে বলে থাকেন, গোমরাহ-বিভ্রান্ত।

তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, আপনি আহমদ শফীর ক্লাস করেছেন? আমি বললাম, হ্যা, আমি তার কাছে ইবনে মাজাহ পড়েছি। মুনাজারার পন্থা-পদ্ধতির বিশেষ দরসে অংশ নিয়েছি। মসনবীয়ে রুমীর পাঠ নিয়েছি। তা ছাড়া তিনি মুহতামিম হিসাবে সপ্তাহে কমপক্ষে দু বার সকল ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। তিনি জামাতের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তাদের কাফের বলেননি।

অধ্যাপক বললেন, আচ্ছা আপনি মাওলানা ইলিয়াছকে চেনেন- যিনি হাটহাজারী মাদরাসার ভিতরে থাকেন-?

বললাম, জী স্যার তাকে চিনি। বললেন, উনিই আমাকে বলেছেন, যে মাওলানা আহমদ শফী বাষিক মাহফিলে বহুবার বলেছেন, জামাতে ইসলামী কাফের।

আমি বললাম, স্যার! মাওলানা ইলিয়াসের সাথে উনাদের শত্রুতা আছে। কম সংখ্যক মানুষই তাদের শত্রুদের সম্পকে ন্যায় ও সত্য কথা বলে। তাদের বিরুদ্ধে আপনাদের আরো বেশী ক্ষেপিয়ে নিজের স্বাথ হাসিল করার মতলব থাকলে আশ্চয হওয়ার কিছু নয়।

বলে রাখা ভাল, আমার সাথে অধ্যাপকের সাক্ষাতের সময়টা ছিল আওয়ামী লীগের সাথে জামাতের একত্রে কেয়ার টেকার সরকার আন্দোলনের মৌসুম।

তারপর শুর হল, আমার প্রশ্ন।

প্রথমে আমি জানতে চাইলাম, জামাতে ইসলামী আওয়ামী লীগের সাথে কিভাবে একত্রে আন্দোলন করে? যে আওয়ামীরা জামাতের বিরুদ্ধে ঘাদানিক নামের জানোয়ার জন্ম দিল। তারা গণ-আদালত কায়েম করল।

তিনি বললেন, ব্যাপারটা রাজনীতির দিক দিয়ে কৌশলগত। উলামায়ে দেওবন্দ কি মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে হিন্দু কংগ্রেসের সাথে আন্দোলন করেননি?

আর ব্যক্তিগত জীবনে শেখ হাসিনা খালেদার চেয়ে অনেক ভাল। শেখ হাসিনা প্রতিদিন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েন, ভোরে কুরআন তেলাওয়াত করেন আর খালেদা জিয়া দশটার আগে ঘুম থেকে জাগেন না।

প্রশ্ন করলাম, অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোন পরিকল্পনা জামাতের আছে কি না।

তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, জামাতের সাথে অন্যান্য ইসলামী দলের ঐক্যের বাধা কোথায়?

বললাম, আমি মনে করি, আকীদাগত বাধাই আসল বাধা। মাত্র দুটো বিষয়; ইসমাতে আম্বিয়া আর আদালতে সাহাবা। জামাত উদ্যোগ নিলে পারবে এ দুটো বিষয় ফয়সালা করতে। তাহলে দুরত্ব কমে যাবে।

তিনি বললেন, যদি আকীদা এক থাকলে ঐক্য হয়, তাহলে এক খেলাফত আন্দোলন ভেঙে তিন খেলাফত কেন হল? চরমোনাইর পীর সাহেব, শাইখুল হাদিস, ফজলুল হক আমিনী প্রমুখের আকীদায় কোন পাথক্য আছে? তাদের আকীদা এক, সিলেবাস এক, উস্তাদ এক তারপরও কেন তারা ভিন্ন। আসলে তারা সবাই পদ চাচ্ছেন। সুবিধা চাচ্ছেন। ঐক্য নয়।

আর জামাতের আকীদার যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য আমরা বহুবার আলেমদের সাথে বসেছি। বৈঠকে তারা স্বীকার করে যান, এগুলো অপ-প্রচার। পরে কোন খবর থাকে না। আমি চরমোনাইর পীর ফজলুল করীম সাহেবকে দাওয়াত দিয়েছি। তিনি একাধিকবার এসেছেন। অনেক সময় ধরে আলোচনা হয়েছে। তিনি যখন বই-কিতাব গেটে দেখলেন, জামাতের বিরুদ্ধে আকীদাগত অভিযোগ ভিত্তিহীন তখন তিনি তার মুফতী সাহেবকে দোষারোপ করলেন। বললেন, মুফতী সাহেব তাকে বিভ্রান্ত করেছেন। তিনি এখন ক্লীয়ার। কিন্তু এরপর আর কোন খবর নেই। যোগাযোগ করলে সাড়া দেন না।

চা-বিস্কুট আসলো। তিনি ঘড়ির দিকে ইশারা করে বললেন, একটু পরেই কিন্তু মাগরিবের আজান, তাড়াতাড়ি চা খেয়ে নিন।

সেই সাক্ষাতের পর থেকে তার সম্পকে আমার ধারনা উন্নত হতে থাকল। যখন শুনলাম, তিনি ‘জীবনে যা দেখলাম’ নামে আত্নজীবনী লিখেছেন, প্রথম খন্ড বের হওয়ার পর তা কিনে খোজ-খবর নিতাম পরের খন্ড বের হয়েছে কিনা। এভাবে কামিয়াব প্রকাশন থেকে পাচ খন্ড কিনেছি। পরেরগুলো পড়া হয়নি। জানিনা মোট কত খন্ড প্রকাশিত হয়েছে। এখন আবার খবর নিতে হবে।

আজ শুক্রবার ২৪ অক্টোরর-২০১৪ তিনি নব্বই বছরের সাজা থেকে মুক্তি পেলেন। তিনি আর কোনদিন জালিমের কারাগারে প্রবেশ করবেন না। কোন শাস্তি তাকে আর পেতে হবে না। যুদ্ধ শেষ। তিনি বিজয়ী। আশা করা যায়, জীবনের সব পরীক্ষার ফলাফল আর পুরস্কার শুরু হয়ে গেছে। আদশবাদী কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন। ভোগবাদি উম্মাদেরা আর রাম সাম্রাজ্যবাদের চাকর-বাকরেরা কে কী বলল, কী আসে যায় তার?

সারা জীবন যারা মানুষকে ঈমানের অগ্নি পরীক্ষায় সফলতা লাভের দীক্ষা দিয়ে গেছেন তারা ঈমানের পরীক্ষায় অংশ নেবেন না তা কি করে হয়? এটাতো আল্লাহর নেজাম নয়। তাই তার লাশ বের হল জালিমের কারাগার থেকে। এটা কি কম সৌভাগ্যের? কারাভোগ তো নবীদের সুন্নাত। কারাগার কবে থেকে চালু হয়েছে তা জানা না গেলেও নবী ইউসুফকে অন্যায়ভাবে কারাগারে আবদ্ধ রাখার ঘটনা থেকে মানুষ কারাগারের অস্তিত্বের সাথে পরিচিত। বহু ইমামের লাশ তো জেলখানা থেকে বের হয়েছিল। এমন সৌভাগ্যে ইমামে আজম আবু হানীফাও ধন্য হয়েছিলেন।

মহান আল্লাহ তো এ সকল জেল-জুলুমের মাধ্যমে তিনি মুমিনদের পরিশুদ্ধ করতে চান আর তাদের দুশমনদের করেন নিশ্চিন্হ।

তাই তো দেখতে পাচ্ছি মাশরেক থেকে মাগরেব গোলাম আজমের নাম নেয়ার মত মানুষ থাকবে অসংখ্য-অগণিত। কিন্তু তার শত্রুদের চেনে না তারা, তাদের নাম ভুলে যাবে মানুষ।

আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন। জান্নাতে উচ্চ আসন দান করুন।

বিষয়: বিবিধ

১৮৯৮ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

277899
২৪ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৯:১০
সুশীল লিখেছেন : Yawn Yawn Yawn
277901
২৪ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৯:২৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার পোষ্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
277904
২৪ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৯:৩২
মনসুর আহামেদ লিখেছেন :
আমিও তার সাথে দেখা করেছিলাম। কাজীর
লেইনের টিনের ঘরে। জীবনে যা দেখলাম’ নামে আত্নজীবনী লিখেছেন। দেশে না থাকলেও
অন লাইনে সব সীরিজ পড়েছি। ইসলামী
আনন্দোলনের পথিকৃত ছিলেন।
277912
২৪ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১০:৪৬
মুক্তির মিছিল লিখেছেন : আপনার লেখা পড়ে উনার সম্পর্কে আরও শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। আল্লাহ্ উনাকে মাফ করে দিয়ে জান্নাতে উচ্চ আসন দান করুন।-আমিন!
277955
২৫ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৭:১০
শেখের পোলা লিখেছেন : "ফাদখুলি ফি ইবাদী ওয়াদখুলি জান্নাতী৷"
278333
২৬ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৪:২৪
ইয়াফি লিখেছেন : 1993 সনের আগষ্ট মাসের অনেক সময় পর 1996 সনের সংসদীয় নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে চট্টগ্রাম শহরের বিখ্যাত মুসলীম হলে চরমোনাইর তত্কালীন পীর ফজলুল করীম সাহেব তাঁর দলীয় সভায় বলছিলেন জামায়াতে ইসলামী কোন ইসলামী দল নয়।
গত বছর শাহবাগীদের ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে সাংবাদিকরা হেফাজতের আমির আল্লামা শফী সাহেবকে প্রশ্ন করেছিলেন আপনাদের আন্দোলন জামায়াতকে সুবিধা দেয়ার জন্য! আল্লামা শফী সাহেব উত্তরে বললেন এ কথা বলার আগে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলুন।
278863
২৮ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ১১:৪৬
বাংলার সিংহ লিখেছেন : ভাল পোষ্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
278867
২৮ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ১২:০৩
রাইয়ান লিখেছেন : সুন্দর লিখেছেন.... অসংখ্য শুভেচ্ছা ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File