আব্দুল কাদের মোল্লার শাহাদত : বিক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন লিখেছেন শিক্ষানবিস ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৯:৪৬:০৬ রাত

আমাদের সকলের চোখের সামনে একটি মানুষকে পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হল, আমরা কি করলাম? আমরা কি এই হত্যার দায় থেকে মহান আল্লাহর কাছ থেকে মুক্তি পাবো? আল্লাহ ও তার রাসূল তো বলেছিলেন, পৃথিবীতে কোন জুলুম দেখলে জালেমকে শক্তি দিয়ে বাধা দিতে। প্রতিবাদ করতে। অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতে। আমরা কয়জন তা করতে পেরেছি? কে কে করেছি? আল্লাহ যখন প্রশ্ন করবেন, তুমি কি করেছো? তখন আমি কী উত্তর দেব? মহান প্রতিপালকের দরবারে জওয়াবদিহিতার এই দায়বোধ আর জালেমদের থেকে দায়মুক্তির প্রমাণ হিসাবে কিছু কথা :

এক. ইসলামের প্রসার প্রচারে নিয়োজিত ব্যক্তিদের রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক হত্যা, ক্রুশবিদ্ধ করে মারা, জলন্ত আগুনে পোড়ানো, ফুটন্ত তেলে নিক্ষেপ, জ্বলন্ত কয়লার উপরে শুইয়ে রাখা, কারাগারে প্রেরণ, লোহার করাত দিয়ে মাথা থেকে শরীর দুভাগ করা, লোহার চিরুনী দিয়ে শরীরের চামড়া মাংশ থেকে, মাংশ হাডিড থেকে আলাদা করা নতুন কোন ঘটনা নয়। এ রকম ঘটনা হাজার হাজার ঘটেছে। এগুলো যেমন দশ হাজার বছরের ইতিহাস তেমনি তা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর নির্বাচিত প্রিয় নবী রাসূলগণও এ বর্বর নির্যাতন থেকে মুক্তি পাননি। তাদের সহচরগণও এ থেকে রেহাই পাননি। মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে নন্দিত ইমামগণও এ থেকে নিস্তার পাননি। আর এভাবে চলতে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। এটা মহান আল্লাহর সুন্নত বা সিস্টেম।

দুই. শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা একদিন মারা যেতেন। হাসাপাতালে অথবা ঘরের বেডে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করতেন। যখন হায়াত শেষ, তখন ফাসী না হলেও তিনি অন্যভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নিতেন। কিন্তু কী পেতেন? মানুষ তাকে কতদিন মনে রাখতো? কিন্তু এখন তিনি মুসলিম উম্মাহর কাছে একজন শহীদ বলে গণ্য হয়েছেন। শুধু দেশে নয়। সারা বিশ্বে। হাজার বছর পর্যন্ত মানুষ তাকে মনে করবে পরম শ্রদ্ধার সাথে। তার শাহাদত প্রেরণা যোগাবে কোটি কোটি মানুষকে। আর কে না জানে ইসলামের শহীদের মর্যাদা? এ কারণে ঈর্ষায় অনেক অমুসলিম বা নাস্তিকরাও শহীদ হতে চায় কখনো কখনো। নামের আগে শহীদ লাগিয়ে দিতে চায়। কিন্তু শহীদ তো একটি নির্দিষ্ট ধর্মের পরিভাষা। যারা শহীদ তারা তো আল্লাহ কর্তৃক নিবাচিত। আল্লাহতো বলেছেন : আর এই সব দিন আমি মানুষের মাঝে পালাক্রমে আবর্তন করি। যাতে আল্লাহ ঈমানদারদেরকে জেনে নেন, তোমাদের মধ্য থেকে কতক মানুষকে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করেন। (আল কুরআন ৩: ১৪০)

তিন. নবী রাসূলসহ যত ইসলাম অনুসারী মানুষকে রাষ্ট্র বা সরকার কর্তৃক হত্যা করা হয়েছে, তাদের কিন্তু সংশ্লিষ্ট সরকার বা আদালত কখনো বলেনি, তোমাদের ইসলামের কারণেই হত্যা করা হল। প্রতেককেই একটি ভূয়া বা কাল্পনিক অভিযোগে হত্যা করা হয়েছে। আল কুরআন ও হাদীসে এর বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ফেরাউন যখন মুছা ও তার দলকে হত্যা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলো, তখন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে জনগণকে বলেছিল, এই মূছা ও তার দল যাদুর মাধ্যমে তোমাদের দেশ থেকে বের করে দেবে।

যদি বলত, তোমাদের দেশ থেকে বের করে দেবে, জনগণ বিশ্বাস করতো না। তখন তারা বলত, মূছা ও তার সঙ্গীদের এমন শক্তি নেই যে আমাদের বের করে দেবে। তাই ফেরআউন তাদের বুঝালো, মূছা যাদু জানে। যাদুর মাধ্যমে তোমাদের দেশ থেকে বের করে দেবে। এ কারণে মূছা ও তার সঙ্গীদের হত্যা করা উচিত।

আর এভাবেই সকল ক্ষমতাসীনেরা ইসলামের সৈনিকদের মিথ্যা অভিযোগে হত্যা, নির্যাতন ও দেশান্তর করেছে।

চার. আল্লাহ বলেছেন, যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তোমরা তাদের মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা বুঝতে পারো না।

আল্লাহর এ বানীর দুটো দিক আছে। একটি অপ্রকাশ্য। যা আমরা আসলেই দেখি না। সেটা হল জান্নাতে তাদের বিচরণ ও বিশাল পুরস্কার। আর একটি হল বাহ্যিক দিক, যা আমরা দেখি। তা হল, মুসলিম জাতি শহীদদের নাম শত শত বছর ধরে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তাদের জন্য মুনাজাত করে। তাদের সন্তানেরা শহীদের সন্তান হিসাবে মর্যাদা পেয়ে থাকে। তাদের পিতা-মাতা শহীদের জনক-জননী হিসাবে সম্মান লাভ করে। তারা এভাবেই তারা মানুষের সমাজে জীবিত থাকে। কিন্তু তাদের হত্যাকারীদের নাম উচ্চারণ করার কেহ থাকে না। তারা দু দিক দিয়েই মারা যায়। তিতুমীরকে হত্যা করা হল। আজো তার কোটি কোটি ভক্ত আছে, কিন্তু যারা তাকে ও তার সঙ্গীদের হত্যা করল, মানুষ তাদের ঘৃণা করে। তাদের নাম জানে না। আজো যদি তাদের কাউকে পাওয়া যেত তবে দেখা যেত মানুষ তাদের কত আদর করে! এভাবেই আব্দুল কাদের মোল্লার ঘাতকেরা নির্মূল হবে, হারিয়ে যাবে আর বেচে থাকবে আল্লাহর পথের এই শহীদেরা। আমার মত কোটি মানুষ শহীদ হাসান আল- বান্নাকে চেনে। শহীদ আ. কাদের আওদাহকে জানে। কিন্তু তাদের হত্যাকারীদের জানে না। শুধু ঘৃণাই করি।

পাচ. আমাদের চোখের সামনে এমন একটা বর্বর অন্যায় কান্ড ঘটে গেল, আলেম-উলামাসহ বহু মানুষ এটাকে ঘৃণা করেছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেননি। তারা জালেমদের বিরুদ্ধে দুআও করেছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে দুআ কি কবুল কবুল হয়? হাদীসে তো স্পষ্ট বলা আছে, তোমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ থেকে বিরত থাকলে তোমাদের দুআ কবুল হবে না। যারা এটাকে অন্যায় জেনেও প্রতিবাদ করেননি তারা নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করতে পারেন, এটা আল্লাহর কাছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিনা। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।

ছয়. আব্দুল কাদের মোল্লার ফাসীর রায় কার্যকর করার পর জাতিসংঘের মহাসচিব, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ ও সংস্থা দু:খ প্রকাশ করেছে। আমি মনে করি এর মাধ্যমে তারা এই হত্যা থেকে নিজেদের দায়মুক্তির ঘোষণার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি আশ্চর্য হই, আরব ও মুসলিম দেশগুলো নিজেদের দায়মুক্তির চিন্তাটা কেন করে না। আমরা যাদেরকে সাম্রাজ্যবাদী, ইহুদী খৃষ্টান বলে সমালোচনা করি তাদের মধ্যে যদি এতটুকু মানবতাবাদী বিবেক থাকে তা হলে আমাদের মুসলমানদের মধ্যে তা অনুপস্থিত কেন?

সাত. সরকার ও রাষ্ট্রপক্ষের স্বাক্ষীরা মনে করেছে, কয়েকটা জামাতী নেতাকে যেন তেন করে ফাসীতে ঝুলাতে পারলেই ইসলাম অনুসারীদের আতঙ্কিত করা যাবে ও তাদের দমন করা সহজ হবে। জামাতের বাহিরের অন্যান্য মেৌলবাদীদেরও একটা ভয়ানক মেসেজ দেয়া যাবে।

আসলেই এটা তাদের এমন এক মূর্খতা যার চিকিৎসা করার চেষ্টা করা হয়নি দেড় হাজার বছরের বাস্তব ইতিহাস দেখেও। একটি আদর্শিক দলকে হত্যা ও নির্যাতন করে কখনো পরাস্ত করা যায় না বরং তাদের উস্কে দেয়া যায়, উত্তেজিত করা যায়, জাগ্রত করা যায়। সামপ্রতিক কালে যা হয়েছে মিশরে, যা হয়েছে তুরস্কে, যা দেখা গেছে তিউনিসিয়ায়, যা দেখতে পেলাম লিবিয়ায়। এ সব দেশে আব্দুল কাদের মোল্লার মত বহু ইসলামিক নেতাকে হত্যা-নির্যাতন করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ কোন আদর্শিক দল নয়, একটি ভোগবাদী দল। তা সত্বেও পনের আগষ্টের ঘটনা, জেলহত্যার ঘটনাসহ কত ঝড়-তুফান তাদের উপর দিয়ে বয়ে গেছে কিন্তু তাদের দমন করা সম্ভব হয়নি। সেখানে ইসলামী দলগুলোকে কিভাবে সাইজ করা সম্ভব? তারা কেন বুঝে না, তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না থাকলে বন্ধু মহলে তাদের কি কোন দাম থাকবে?

আট. অনেকে মনে করেন, এই হত্যার প্রতিবাদ করলে আদালত অবমাননা হয়ে যাবে। জেলে যেতে হতে পারে। আসলে আদালতের রায়ের বিরোধিতা করলে আদালত অবমাননা হয়, আমি মানি না। আদালত কখনো কখনো ভুল রায় দিতে পারে। এটা বাস্তব। ইসলামেও এ কথার স্বীকৃতি আছে। রাসূলুল্লাহ সা. এর মত বিচারক একটি বিচারে একবার ভুল রায় দিয়েছিলেন। আল-কুরআনে সুরা্ আন-নিসার ১০৫ থেকে ১১৩ নং আয়াতে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। অতএব আদালতের রায় সর্বদা সঠিক হয় এটা কোন মানুষই মানে না। যখন তারা বিশ্বাস করে আদালত অন্যায় সিদ্ধান্ত দিতে পারে তখন তারা সমালোচনা বা প্রতিবাদ নিষিদ্ধ জানবে কেন? দ্বিতীয়ত কোন অন্যায় বা জুলুম দেখে তার প্রতিবাদ না করার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে মুসলমানদের জানা আছে। কাজেই জেলের ভয়ে এই হত্যাকান্ড মেনে নেয়া ঈমানের দৃষ্টিতে একটি অপরাধ। এই অপরাধবোধ থেকেই আমি এই অপরাধটি করে ফেললাম।

বিষয়: বিবিধ

১২১৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File