টুকরো কথা
লিখেছেন লিখেছেন ইয়াহ্ইয়া রেজয়ান ১৯ জুন, ২০১৩, ০৭:৪৬:১৫ সন্ধ্যা
জীবনকে আমরা যতোই সরল সংজ্ঞায় ফেলতে চাইনা কেনো, তা সম্ভব হয়না, এই জীবন প্রতিবারই এক নতুন রূপে ফিরে এসে আমাদের চমকে দেয়। এই চমকানোটা কোনো সময় নিয়ে আসে রংধনু আর কখনো কষ্টকর বর্ষণ।রৌদ্রোজ্জল আর ঝিরঝিরে হাওয়ায় ভরা জীবনের স্বপ্ন দেখে কেটে যায় আমাদের বেশীরভাগ সময়, কিন্তু সপ্ন আর বাস্তবতার মিলন হওয়া কি এতো সহজ? তাইতো স্বপ্ন দেখেই কেটে যায় ছোট্ট এ জীবন।
ছোট বেলায় নানা বাড়ির ফটিক ঘরের সামনে যখন বসতাম অজানা এক হাওয়া এসে আমার ছোট্ট শরীরটাকে ভাসিয়ে নিতো, আমি ভাবতাম আরে এতো বেহেশতী হাওয়া! তারপরে হঠাৎ করে কখন সেই বেহেশতী হাওয়া কোথায় যে হারিয়ে গেলো! আজ ও আমি সেই বেহেশতী হাওয়া খুঁজি।কৈশোরের শেষাংশে আর যৌবনের প্রারম্ভে আনেক খুঁজেছি সেই বাতাসকে, কখনো সেই ফটিক ঘরের সামনে, কখনো অলিতে-গলিতে, আর এই পূর্ণ যৌবনে লন্ডনের রাস্তায়-রাস্তায়, কিন্তু তার আর দেখা পাইনি। সেই বেহেশতি বাতাসই আমাকে স্বপ্ন দেখা শিখিয়েছিলো তাই হয়তো আমার সব স্বপ্নই বেহেশতী হাওয়ার মতোই হঠাৎ মিলিয়ে যায়।
মনে পড়ে লন্ডনে আসার আগের অনেক ঘঠনা। সিলেটের সব লোকেরই লন্ডনে আসার প্রতি প্রচন্ড উৎসাহ, আর আমার বন্দ্বু সাদীর ছিলো বাড়াবাড়ি রকমের প্রচন্ড উৎসাহ! প্রতিদিন সকালে ও ঠিক করতো ইংল্যান্ডে আসাই ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, আর দুই-এক দিন পর হতাশ হয়ে সে আশা ছেড়ে দিতো, তা নিয়ে আমরা সবাই হাসাহাসি করতাম। ২০০৫ সালের একদিন রাত সাড়ে ১২ টার সময় লুঙি পরে আমার বাসায় এসেছিলো শুধু এটা বলার জন্যে, ও যেভাবে হোক ইংল্যান্ড যেতে চায়! ওর ওই পুরাতন ডায়ালগ নতুন আঙ্গিঁকে শুনে আমি কিছুটা অভিভূত হয়ে গেলাম এবং কথা দিলাম যে আমি ওর সাথে আছি। ওকে বললাম, শুন ইংল্যান্ডে যেতে হলে আমাদের প্রথম যে কাজটা করতে হবে তা হলো IELTS, ও বললো যে কোন কিছু করতে ও রাজি। ওর সেই উৎসাহ আমার ইংল্যান্ডে আসার উৎসাহ হাজারগুণ বাড়িয়ে দিলো, আমি IELTS এ ভর্তি হলাম আর আর ওর বাসায় ইংরেজী প্র্যাকটিসের জন্য যাওয়া শুরু করলাম। মজার ব্যাপার হলো প্র্যাকটিসের শুরুর আগে ও বলতো আমার সামনে নাকি ওর ইংরেজী বলতে লজ্জা লাগবে বলেই লাইট নিভিয়ে ফেলতো আর বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতো বাংলায়!! সেই একই ধাক্কায় ২০০৬ সালে আমি ইংল্যান্ড চলে আসলাম কিন্তু তার এই ২০১২ তেও এসে IELTS এ ভর্তি হওয়া হলোনা!!
কিন্তু আমার বন্ধুটির এই পাগলামি আচরণ আমার ভালোই লাগতো। আমার যথেষ্ট পাগলামি আচরনের জন্য আমার অনেক বন্ধুই আমাকে হিমু বলতো, কিন্তু সত্যি বলতে কি , আমার জীবনে আমি প্রথম হিমুর ছাপ দেখেছিলাম সাদীর মাঝে তাই হয়তো মাঝে মাঝে সাদীকে নিয়ে এপিং ফরেষ্টের জোৎস্না দেখার ইচ্ছাটা প্রবল হয়।
আমার বন্ধু মাহফুজ সম্বন্দ্বে বলতে গেলে বলতে হয়, ওই আমার একমাত্র বন্ধু যার সাথে আমি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় একসাথে পড়েছি, এমনকি আমরা প্রায় একসাথেই ইংল্যান্ড এসে এক বাসায় থেকেছি এবং এক জায়গায় কাজ করেছি!! আর এই ঐতিহাসিক(!) ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটে ওর বিয়ের মাধ্যমে, যে বিয়ের প্রধান এবং একমাত্র ঘটক ছিলাম আমি।বিয়ের পরই ও ওর বৌকে নিয়ে ওঠে আলাদা বাসায়। যদিও ও আর ওর বৌসহ সবাই আমাকে অনুরোধ করেছিলো ওদের সাথে ওটার জন্যে, কিন্তু আমি বিনয়ের সাথে সেই অনুরোধ প্রত্যাখান করেছিলাম।
কি অদ্ভুত লাগে আগের সেই স্বপ্নগুলো যখন মনে পড়ে।মাহফুজ তোর কি মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা যখন তুই আর আমি তোর বাসার পিছনের মাঠে অথবা আমার বাসার সামনের দেয়ালে বসে সামনের দিনগুলি নিয়ে কতই না রঙীন স্বপ্ন দেখতাম।যদিও আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি তারপর ও মাঝে মাঝে যখন তুলনা করি বড়ই কষ্ট লাগে, আমার সেই স্বপ্নের ব্যালান্স সিট আর বাস্তবের ব্যালান্স সিটে বিরাট ফারাক, যেনো কোন হিসাবই মিলেনা। তুই কেমন আছিস? তোর স্বপ্ন আর বাস্তবতা কি এক হয়েছে? যদি হয় তবে আমার চেয়ে খুশী আর কে হবে বল। আর যদি না হয় তবে দোয়া করি শীঘ্রই যেনো তা বাস্তব হয়।
কেমন যেনো মন খারাপ করা লেখা তবে আর না।গত ১৭ ই জুলাই ছিলো মাহফুজের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। ভাবা যায়, কত দ্রুতই না সময় চলে যায়! মনে হয় এই তো সেদিন আমি আর ও গিয়েছিলাম কনে দেখতে। যাই হোক বিয়ের কথাই যখন উঠলো মাহফুজের বিয়ে রিলেটেড কিছু মজার ঘঠনা পাঠকদের সাথে শেয়ার করা যাক।বিয়ের আগে যখন কনে দেখা হয় তখন মাহফুজ ওর ভাগিনী, দুই মামা আর যেহেতু আমি মাঝে ছিলাম (পাঠকগণ চাইলে আপমান করে ঘঠক বলতে পারেন। তবে কিরে কেটে বলতে পারি এক টাকা ও charge নেইনি!!) আমাকে ও যেতে হলো। যাই হোক, চা- নাস্তা খাওয়ার পর সবাই মাহফুজ আর কনেকে আলাদা রূমে পাঠিয়ে দিলো প্রাইভেট বাত-চিত শেষ করার জন্য। মাহফুজের প্রথম বিয়ে, আগের অভিজ্ঞতা না থাকলে যা হয় আর কি, পুরোপুরি নার্ভাস, স্ট্যাচু অভ লিবার্টির মতো দাঁড়িয়ে আছে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে সাহসের জন্য। বেটা ভালো করেই জানে আমিও ওর মতো পূর্ব অভিজ্ঞতাহীন তারপরও ডুবন্ত লোক যেমন খড়কুটো আগলে ধরে তেমনি বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আর এদিকে আমার অবস্হা কেরোসিন, বুকে ড্রামের শব্দ আর সেই নান্দনিক শব্দ শুনে আমার দারুণ সমাঝদার পদদ্বয় ব্রেক ড্যান্সের তালিম নিচ্ছে কিন্তু তাই বলে তো আর অসহায় মানুষকে ফিরিয়ে দিতে পারিনা, তাই নেপোলিয়নের মতো বিশ্বজয়ীর ভাব নিয়ে বললাম আরে বেটা যা, এটা কোন ব্যাপারই না! মাহফুজ রূমের ভিতর গেলো আর আমি হাফ ছেড়ে বাইরে সোফায় বসলাম।কিন্তু ওর গুণধর ভাগ্নি দু-এক মিনিট পর পরই কানের কাছে প্যানপ্যানানি শুরু করলো মামা তুমিও ভিতরে যাও ছোট মামা নার্ভাস,কিছু কথা বলতে পারবেনা। ওর ঠেলায় ভিতরে যেতে হলো, গিয়ে দেখি একপাশে কনে গভীর মনোযোগে শাড়ির আাচলের রং দেখছে এবং তার ছোট বোন টুথপেস্টের মডেলের মতো হাসিমুখে ওয়ালপেপার মুডে বসে আছে আর আমার বন্ধু বিছানায় ১৯৭১ সালের সিনেমার কলেজ স্টুডেন্ট মুডে বসে আছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলামনা। রূমের মধ্যে ঢুকেই আমি হরবর করে বলতে লাগলাম- আমি ইয়াহ্ইয়া,মাহফুজের বন্ধু আর ও মাহফুজ আমার বন্ধু। আমার বলার ধরনে সবাই হেঁসে উঠলো আর এক নিমিষেই সব টেনশন উধাও।
লেখাটা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের মতো, শেষ হইয়াও হয়না শেষ। শুরু করেছিলাম ২০১২ তে আর প্রকাশ করছি ২০১৩তে। এর ভিতর কতো কিছু ঘঠে গেলো। সাদি সবাইকে অবাক করে ইংল্যান্ডে উপস্থিত তাও IELTS দিয়ে।আমার সাথে একরুমেই উঠেছে। মাহফুজের সাথে তেমন দেখা হয়না, সব বন্ধুরা ও আগের মতো নাই, যার যার কাজে সবাই ব্যাস্ত। তারপর ও মাঝে মাঝে যখন নিয়ন লাইটের আলোয় লন্ডনের রাস্তায় হাটি আর তাঁরা ভরা আকশের দিকে তাকাই মনে হয় সবইতো আগের মতো, হয়তো জীবন এতো খারাপনা যতোটা আমরা মনে করি!
বিষয়: বিবিধ
১৫৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন