বাবা তুমি নেই এই পৃথিবীতে তবুও মনে পড়ে তোমায় সব কিছুতে।
লিখেছেন লিখেছেন মুহছিনা খাঁন ১৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০৫:১৭:০৪ সকাল
বি ডি টু ডেতে বাবাকে নিয়ে গল্প লিখার প্রতিযোগিতা চলছে।
বাবাকে নিয়ে গল্প লিখবো এ যেন এক মহা কাব্য রচনা।
অথচ বাবাকে পেলাম মাত্র ক'টা বছর। ১০ বছর বয়সে যে মেয়ে তার বাবাকে হারালো সে আবার লিখবে বাবাকে নিয়ে। তবুও যেনো দেরী সইছেনা।
আব্বার বড় এলোপ্যথিক ফার্মেসী ছিলো আমাদের বাজারে। এবং হোমিওপ্যথিক ও জানতেন।কোরআনে হাফিজ ও ছিলেন।
নাম ছিলো বশির আহমেদ।
কিন্তু কেউ নাম ধরে ডাকতনা।হাফিজসাব বলে ডাকতেন সবাই।
যখন ক্লাস ফোরে ছিলাম মামার বাড়িতে বেড়াতে গেলাম এক খালার বিয়েতে। মাশা আল্লাহ আমার আব্বা সুঠাম সুন্দর দেহের অধিকারী ছিলেন। তার চেয়ে ও হাসিটা ছিলো সবচেয়ে মধুর ঠোটের কোনে হাসি লেগেই থাকতো।
তো নানা বাড়ি জল চকিতে বসে আছরের নামাজের ওজু পড়ছেন এমন সময় আমার মামার ১০ বছরের শালী আব্বাকে জিগ্যেস করলেন দুলাভাই আপনার নাম কি? আববা বশির আহমেদ বলে পায়ে পানি ঢালছেন আর অঝরে কাঁদছেন
সে আবার কান্নার কারন জিগ্যেস করতেই বলছেন, আমি কি সুসংবাদ পাবো আল্লাহর কাছ থেকে এই জন্য কাঁদছি। কারন বাশির নামের অর্থ সু সংবাদ। আমরা ছোট দুটি মেয়ে এই সবের কিছুই বুঝলামনা সেদিন।
আমাদের পাশের মাদ্রাসায় যখন ওয়াজ মাহফিল হতো আব্বা সভাপতি থাকতেন। ছোট ছাত্ররা যখন তেলাওয়াত করতো তখন অঝর ধারায় চোখের পানি ফেলতেন। ছোট ছিলাম তাই দৌড়ে যেতাম সেখানে। কোনদিন দেখিনি আমার আম্মাকে ধমক দিয়ে কথা বলতে।
মেঝ আপাকে সৎমা বলে ডাকতেন ওর একটু আব্দার বেশি থাকতো এবং কিছু দিয়ে বুঝ দিতে পারতেননা। অনর্গল কথা শুধু বলেই যেতো নিজেরটা।
বড় আপার জন্ম নাকি দাদি মারা যাওয়ার পর । তাই মাই বলে ডাকতেন।
আমি আমার ছোট ভাইটা নয় ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট ও বেশি দুষ্টমি করতো তাই সবাই শাষনের চোখে দেখতো ।
কিন্তু আমি ছিলাম বেশ অভিমানী কি হয়েছে? কেন না খেয়ে বসে আছি? সামনে খাবার নিয়ে কিসের জন্য কারো সাথে কথা বলছিনা। দুরে দুরে হাটছি কেউ বুঝতে পারতোনা। কাউকে কিছু বলতেও চাইতামনা।
আব্বা যখন দেখতেন প্লেটএ ভাত নিয়ে বসে আছি অভিমান করে কারন পুরো প্লেটে মাছ উপড়ের অংশে সাজিয়ে রাখা হয়নি তাই। আব্বা তখন দুহাত দরজার ফ্রেমে রেখে দাড়িয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, জুলেখা বাদশার মেয়ে তার ভারি
অহংকার।
এই রকম কথা শুনলে আমি আরো রাগ করতাম।
কখনো কাউকে কটু কথা বলতেননা। ভাইরা বোনদের সাথে কিছু নিয়ে ঝগড়া ঝাটি করলে ভাইদের সাথে খুব রাগ করতেন। মেয়েদের এবং পাশের ঘরের ভাতিজিদের ও খুব আদর করতেন কাছে ডেকে এনে বসাতেন।
প্রতিদিন ধবধবে সাদা পাজামা পান্জাবী এবং ভাঁজ করা কাস্মীরী চাদর হাতের উপড় রেখে ফার্মেসীতে যেতেন এই দৃশ্যটি প্রতদিনের। গরিব পুরুষ মহিলারা সবাই আব্বাকে খুব ভালাসতো ।
আমাদের জেলার বাহিরের যারা খুঁচড়া কাপড় বিক্রেতা তাদের সবার টাকা আব্বার বিছানার নিচে থাকতো আম্মাকে সব সময় জানিয়ে রাখতেন।
বড় ভাই মাষ্টার্স পাশ করে বের হয়ে সোনালি ব্যাংকে চাকরি ধরলেন আর মেঝ ভাইকে বিদেশ পাঠিয়ে দিলেন।
যখন ক্লাস ফাইভে পরতাম তখন আব্বা ক্যান্সার ধরা পড়লো গলায় অনেক চিকিৎসার পর ও কিছুই হলোনা।
মৃত্যুর ৫ দিন আগে উঠোনে বসে দাড়ি ছোট ছোট করে কেটে ক্লিন করছেন। মাটিতে পড়া ছোট কাঁচা পাকা দাড়ি মেঝ আপা একটি কাগজে কুটে কুটে তুলছে মুখটা অসহায়ের মত করে। আব্বা দেখে হেসে বলছেন ব্যাক্কল মেয়ে বাবাই যখন থাকবোনা
তখন এই দাড়ি দিয়ে কি করবে? মেঝ আপা নিরবে কুটছে আর জল ফেলছে।
এর একটু পরেই আমাকে কাছে ডেকে বল্লেন, বাবার মৃত্যুর পর তুমি কি কাঁদবে ? কখনো কাঁদবেনা। যখন মনে হবে তখন পড়বে '' ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
এই কথা শুনে সমানে চোখ থেকে টপ টপ করে পানি মাটিতে পড়ছে আর ধুলোর সাথে মিশে গিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে।
কাছে ডেকে আদর করলেন চোখ মুছে দিয়ে কাঁদতে বারন করলেন।
এতটুকুন একটি মেয়ে সে কি করে হাসি মুখে তার বাবা কে এই পৃথিবীটা থেকে বিদায় দিবে? বাবা হয়তো সেটা বুঝে উঠতে পারেননি।
বাবা আমার যখন কারো উপড় অভিমান করে ভাত খেতে ইচ্ছে করেনা। তখন কেউ আর দরজায় দাড়িয়ে তোমার মতো করে বলেনা। কে মেড়েছে কে বকেছে কে দিয়েছে গাল
তাইতো মেয়ে রাগ করেছে ভাত খায়নি কাল।
তখন আরো মন খারাপ হয় বাবা।
তোমার বাদশার মেয়ে আর অহংকার করেনা। তোমার চলে যাওয়ার পর আমার কোন প্রয়োজনে মাকে কখনো জ্বালাতন করিনি মা সে কথা সবাইকে বলতেন। সে তার সব কি করে ঠিক করে নেয় আমাকে কোন কিছুর জন্য চিন্তা করতে হয়না।
আড়াল থেকে সেই কথা শুনে শুকনো হাসি হাসতাম মনে মনে বলতাম যার কাছে শখের জিনিসের আব্দার করবো সে অনেক আগেই আমার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেছে মা। সেদিনইতো শেষ হয়ে গেছে সব সাধ আহলাদের চাওয়া পাওয়া।
তোমার কাছে চেয়ে তোমার মনে যন্ত্রনা বাড়িয়ে কি লাভ বলো।
তবে আল্লাহর হাজার শুকুর যে আমার বড় তিন ভাই এবং লন্ডনের একমাত্র চাচিমা আমার কিছুই অপুর্ণ রাখেননি তাই বুঝতে পারিনি বাবা নেই বলে কোন কিছুর অভাব হয়েছিলো।আল্লাহ তাদের এই দ্বায়িত্ব পালন করা কে কবুল কুরুন আমীন।
প্রতিদিনের মতো সকালে উঠে মসজিদে গেলাম এসে দেখি সবাই বড় পেরেশান আর আব্বাকে ঘিরে রাখছে আব্বা নিরবে কোরআন তেলাওয়াত করছেন আর হাত এক পাশ থেকে অন্য পাশ করছেন। সবাই সমানে কোরান পড়ছে সেঝ ভাই চোখের জলে সুরা ইয়াসিন পড়ছেন মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগেও আব্বা ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন। চার নং ভাই ও কোরানে হাফিজ জোড়ে জোড়ে তেলাওয়াত করছেন আর কাঁদছেন। আব্বা বললেন দুরে গিয়ে পড়ো আমার পড়তে অসুবিধা হচ্ছে।
এর একটু পর সবাইকে ছেড়ে দুনিয়া থেকে চলে গেলেন।
সবাই মুখটা ও ডেকে দিলো। আত্মীয় স্বজন সবাই আসলেন। যতটুকু কষ্ট পেলাম সেদিন না বুঝে তার চেয়েও বেশি কেঁদেছি।
এখন বাবার অভাব কি টের পাই কিন্তু সেদিনের মত কাঁদতে পারিনা।
আব্বা বলে ডাকতাম অনেকটি বছড় না ডেকে ডেকে এই ডাকটা যেনো সহজে মুখ দিয়ে বের হয়না।
কোথায় হারিয়ে গেলে বাবা তোমার এই ছোট্ব পুতুল মেয়েটাকে ফেলে। যাকে সুন্দর নীল ফ্রকটা এনে দিয়ে বলেছিলে আমার এই মেয়েটিকে দেশের কোন ছেলের কাছে বিয়ে দেবোনা আমেরিকা যে ছেলে থাকে তার কাছে বিয়ে দেবো সেদিনের হাস্যচ্ছোলের কথাটি আল্লাহ কবুল করে নিয়েছিলেন।
সত্যি বাবা তোমার মেয়ের বিয়ের প্রথম আলাপ আমেরিকান ছেলে দিয়েছিলো তার সাথেই আমি এখন তোমার স্বপ্নের আমেরিকায়।
আম্মাকে যখন এখানে এনে নিজে ড্রাইভ করে বেড়াতে নিয়ে যেতাম অথবা নিজের হাতে কিছু কিনে দিতাম
তখন চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি ঝরতো। কিন্তু মাকে দেখতে দিতামনা। মনে হতো তুমি বেঁচে থাকলেতো তোমাকেও কিছু দিতাম।
কাজের জায়গা থেকে যখন সবুজ ডলার পাই তখন আর তোমাদের দুজন থেকে একজনকেও পাইনা এই পৃথিবীতে । অথচ তোমাদের এত কষ্ট হয়েছিলো আমাকে লালন পালনে। এর বিনিময় কিছুই পারিনি দিতে।
বাবা তোমার সেই ছোট্ব পরিটা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে তিন সন্তানের মা। তবুও তোমার কুলে উঠে আদর পাওয়ার আর দোকান থেকে মজার মজার জিনিস গুলো খেতে বড় ইচ্ছে করে।
আমাকে যদি পৃথিবীর সবাই অসুন্দর বলে তবুও বাবা আমার কোন কষ্ট হবেনা। কারন আমি তোমার কাছে ছিলাম বাদশাহর ভারি অহংকারী একটি মেয়ে আর পরির মত সুন্দর এক রাজকন্যা। যেটা তুমি আমাকে প্রায়ই বলতে।
আল্লাহ তোমাকে জান্নাতের উচ্চ আসনে স্থান দিন। আর আমাকে সেদিন তোমার সাথে এক জান্নাতে থাকার যোগ্যতা তাওফিক দান করুন আমীন।
বিষয়: Contest_father
৩৮০২ বার পঠিত, ৩৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার বাবার কথাও এসেছে পোস্টে, আমন্ত্রণ রইল
আল্লাহ যেন তাকে সম্মানের সাথে জান্নাত নসিব করেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন