সত্যবাণী- কাজী নজরুল ইসলাম
লিখেছেন লিখেছেন জ্ঞান পিপাসু ৩০ মে, ২০১৩, ০৮:২৫:৫০ সকাল
ইসলাম! জাগো!মুসলিম জাগো! আল্লাহ তোমার একমাত্র উপাস্য, কোরআন তোমার সেই ধমের, সেই উপাসনার মহাবাণী, সত্য তোমার ভূষণ,সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা তোমার লক্ষ্য-তুমি জাগো! মুক্ত বিশ্বের বন্য শিশু তুমি, তোমায় পোষ মানায় কে? দুরন্ত চঞ্চলতা, দুর্দমনীয় বেগ, ছায়ানটের নৃত্য-রাগ তোমার রক্তে, তোমাকে থামায় কে? উষ্ণ তোমার খুন, মস্ত তোমার জিগর, দারাজ তোমার দিল, তোমায় রুখে কে? পাষাণ কবাট তোমার বক্ষ, লৌহ তোমার পঞ্জর, অজেয় তোমার বাহু, তোমায় মারে কে? জম্ম তোমার আরবের মহামেরুতে, প্রাণ প্রতিষ্ঠা তোমার পর্বত গুহায়, উদাত্ত তোমার বিপুল বাণীর প্রথম উদ্বোধন কোহ-ই-তুরের নাঙ্গা শিখরে, তুমি অমর, তুমি চির জাগ্রত, তুমি অজেয়। বীর তুমি, তোমার চিরন্তন মুক্তি, শাশ্বত বন্ধনহীনতা, আজাদীর কথা ভূলায় কে? তোমার অদম্য শক্তি, দুর্দমনীয় সাহস, তোমার বুকে খঞ্জর চালায় কে? ইসলাম ঘুমাইবার ধর্ম নয়, মুসলিম মাথা নত করিবার জাতি নয়, তোমার আদিম জম্মদিন হইতে তুমি বুক ফুলাইয়া, শির উচ্চ করিয়া দুর্লঙ্ঘ, মহা পর্বতের মত দাঁড়াইয়া আছ, তোমার গগণচুম্বী শিখরে আকাশ ভরা তারার আলো, অর্ধ চন্দ্রের উদীপ্ত প্রশান্ত জ্যোতিঃ তোমার সে মহাগৌরবের কথা বিশ্বে চির মহিমান্বিত, মনে পড়ে কি, তোমার সেই রক্ত পতাকা যাহা বিশ্বের সিংহদ্বারে উড়িয়া ছিল- তোমার সেই শক্তি যাহা দুনিয়া মথিত- আলোড়িত করেছিল? বল বীর, বল আজ তোমার সেই শক্তি কোথায়? বল ভীরু, তোমার সে উগ্র মহাশক্তিকে কে পদানত করিল? উত্তর দাও! তোমায় আমি আল্লাহর নামে আহবান করিতেছি, উত্তর দাও! তোমার অপমান কেহ কখনও করিতে পারে নাই, ইসলাম অবমাননা সহে নাই, তুমি সত্য, ইসলাম সত্য, তোমার আমার বা ইসলামের অপমান যে সত্যের অপমান। তাহা যে সহ্য করে, সে ভীরু-সে ক্ষুদ্র। যেদিন তুমি তোমার উদার বাণী মহাশিক্ষা ভূলিয়া স্বাধীনতার বদলে অধীনতার ছায়া মাড়াইতে গিয়াছ সেই দিনই তোমার শিরে মিথ্যার, দুশমনের ভীম প্রহরণ বাজিয়াছে। ইসলাম এক মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কাহারও নিকট শির নোয়ায় না, তোমার চির উচ্চ চির অটল ঋজু সেই শির আনত করিতে উদ্যত হইয়াছিলে, তাই আজ তুমি আঘাত পাইয়াছ; তাই তোমার বক্ষে বজ্রবেদনা, শক্তি শেল বাজিয়াছে। যদি আঘাতই পাইয়াছ, যদি আজ এমন করিয়া গভীর বেদনাই তোমার মর্মে বাজিয়াছে, যদি এই প্রথম অবমানিত হইয়াছ, তবে তোমার লাঞ্চিত সত্য, ক্ষুব্ধ শক্তি আবার উত্তাল সমুদ্র তরঙ্গের মত উদ্বলিত হইয়া উঠুক। বল, ইসলাম ভিক্ষা করে না, যাঞ্চা করে না। বল,-দূর্বলতা আমাদের ধর্মে নাই; বল, আমাদের প্রাপ্য আমাদের মুক্তি আমরা নিজের শক্তিতে লাভ করিব।….. তোমার বাঁধে ভাঙ্গন ধরিয়াছে, তোমাকে ইহা হইতে রক্ষা পাইতে হইবে। তাই আজ আমরা আমাদের সারা বিশ্বের লাঞ্চিত বিক্ষুব্ধ শক্তি লইয়া এই মুক্ত মহা গগন তলে দাঁড়াইয়া বলতে চাই,‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।’ এই মুক্ত গগনতলে তোমার মহাতীর্থ স্থান- আরাফাতের ময়দান অপেক্ষাও পবিত্র। এইখানে গৃহহীন পথহারা নিপীড়িত মুসলিম সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব পাইয়াছে, ঈদের দিনের মত পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করিয়াছে, বুকে বুক জড়াইয়া ধরিয়াছে। এই উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়াইয়া মুসলিম আবার বল,‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।’ যদিও তুমি সবস্ব হারা হও, কোথাও তোমার মাথা গুঁজিবার ঠাঁই না থাকে, কুচ পরোয়া নেই, তোমার মাথা নত করিও না-আবার সকলি পাইবে। মুসলিম হীন, এ ঘৃণার কথা শুনিবার পূবে কর্ণরন্ধ্রে সীসা ঢালিয়া বধির হইয়া যাও। তোমাদের এই “ইখওয়াৎ”কে কেন্দ্র করিয়া আমাদের অন্তরের সত্য, স্বাধীন শক্তিকে যেন কোনদিন বিসর্জন না দেই। তোমার বীর ভাইগুলি ঐ যে তোমার দক্ষিণ পাশ্বে ইসলামের এই শাশ্বত সত্য রক্ষার জন্য হেলায় প্রাণ বিসর্জন দিতেছে সেই শহীদানের নব্য তুর্কী তরুণদের দেখ, আর গৌরবে তোমার বক্ষ ভরিয়া উঠুক, তাহাদের পানে তাকাও, তাহাদের অস্ত্র-ঝঞ্জনা শোনো-তাহাদের হুংকারে তোমার হিম-শীতল রক্ত উষ্ণ হইয়া বহিয়া যাক তোমার শিরায় শিরায়। মেঘমুক্ত প্রাবৃট-মধ্যাহ্নের রক্ত ভাস্কর হইয়া তোমার বিপুল ললাটের ভাস্বর রাজটিকা হউক। তুমি অমর হও। তুমি স্বাধীন হও। তোমার জয় হউক।
উৎস পরিচিতিঃ কাজী নজরুল ইসলামের ‘সত্যবাণী’ প্রবন্ধটি ১৩২৮ সালের ভাদ্র সংখ্যা –সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বতমানে বাংলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী ৩য় খন্ড এর অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
বি.দ্র. প্রবন্ধে উল্লেখিত কোহ-ই-তুর মূলতঃ হবে কোহ-ই-নুর।
বিষয়: বিবিধ
৩৩৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন