পুলিশ কি দেখামাত্রই গুলি চালাতে পারে?

লিখেছেন লিখেছেন জ্ঞান পিপাসু ০৬ এপ্রিল, ২০১৩, ০৬:২২:০২ সকাল

‘নাশকতাকারীদের দেখামাত্র গুলি (!)’। ‘গুলি করার বিধান প্রচলিত আইনেই আছে’—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইত্যাকার সাম্প্রতিক বক্তব্যে সারা দেশ সরগরম। হরতালে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ রোধে সরকারের এরূপ সিদ্ধান্তকে কেউ বলছে সময়োচিত ও যৌক্তিক, কেউ বলছে মানবাধিকার লঙ্ঘন। কেউ বলছে, সভ্য দেশে এ রকম নজির নেই। পরস্পরবিরোধী এ বক্তব্যে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। একই সঙ্গে জিজ্ঞাসা—পুলিশ চাইলেই কি গুলি চালাতে পারে? দেখামাত্র গুলির বিধান আসলেই কি আইনে আছে? থাকলে কেমন তার ধরন বা সীমা-পরিসীমা? চলুন, পুলিশের গুলির ক্ষমতার একটা ‘লিগ্যাল পোস্টমর্টেম’ হয়ে যাক।

Police Regulations Bengal (PRB) হলো পুলিশের জন্য পূর্ণাঙ্গ আচরণ-বিধান। কর্তব্যকর্ম সম্পাদনে পুলিশ বিভাগের সব সদস্য এ আচরণ-বিধান মেনে চলতে বাধ্য। দাঙ্গা ও গোলযোগের সময় পুলিশ কখন, কীভাবে, কতটা গুলি বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবে, সে বিষয়ে PRB বা পুলিশ প্রবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে বিস্তারিত বলা আছে। পাশাপাশি অনুসরণ করা হয় ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর কিছু ধারা।

পুলিশ প্রবিধানের ‘আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার’ শিরোনামের ১৫৩ ধারায় পুলিশকে তিনটি ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে: ১. ব্যক্তির আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগে, ২. বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে এবং ৩. কতিপয় পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার কার্যকর করার জন্য (ধারা ১৫৩-ক)।

দণ্ডবিধির ৯৬-১০৬ ধারাবলে পুলিশ নিজের বা অন্যের জানমাল রক্ষায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবে। তবে সেটা তখনই, যখন ওই জানমাল বেআইনিভাবে ধ্বংসের উপক্রম। সে ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বিকল্প নেই। তার পরও শক্তি প্রয়োগ হবে এখানে ততটুকু, যতটুকু দরকার—এর বেশি নয় (ধারা-১৫৩-খ)।

এ ধারামতে বেআইনি সমাবেশে গুলিবর্ষণ একটি ‘চরম ব্যবস্থা’। এ ক্ষেত্রে প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা নেতৃত্বদানকারী পুলিশ কর্মকর্তা (ম্যাজিস্ট্রেট না থাকলে) দাঙ্গাকারী জনতাকে বারবার ছত্রভঙ্গ হওয়ার অনুরোধ করবেন। কাজ না হলে গুলিবর্ষণের হুমকি দেবেন। দেখা গেল, তাও অকার্যকর। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কোনোভাবে জনতাকে রোধ করা যাচ্ছে না। ওদিকে ‘বেচারা আইনশৃঙ্খলা’ তখন মুমূর্ষু। জনগণের জানমালও যায় যায়। এরূপ পরিস্থিতিতেই কেবল আর কোনো বিকল্প না থাকলে পরে তিনি গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেবেন। ম্যাজিস্ট্রেট বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার (ম্যাজিস্ট্রেট না থাকলে) নির্দেশ ছাড়া কোনো পুলিশ অফিসার বেআইনি সমাবেশে গুলিবর্ষণ করতে পারেন না। আত্মরক্ষার বিষয়টি অবশ্য ভিন্ন (ধারা ১৫৩-গ)। তা ছাড়া গোলাকার প্রকৃতির গুলিই শুধু এ ক্ষেত্রে চলবে—অন্য গোলাবারুদ নিষিদ্ধ (ধারা ১৫০-খ)। উল্লেখ্য, বেআইনি জনসমাবেশ ছত্রভঙ্গে ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৭-১২৮ ধারায়ও প্রথমে ছত্রভঙ্গের আদেশ, অন্যথা বলপূর্বক ছত্রভঙ্গের নির্দেশনা রয়েছে।

অন্যদিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬ ধারার অধীনেও পুলিশের বল প্রয়োগ চলে। শক্তি প্রয়োগে কেউ গ্রেপ্তার, প্রতিরোধ বা এড়ানোর চেষ্টা করলেই কেবল আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। তবে তাতে যেন মৃত্যুর ঘটনা না ঘটে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডযোগ্য কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হলেই এ ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটানো যায় (ধারা ১৫৩-ঘ)।

পুলিশ প্রবিধানে ক্ষেত্রবিশেষে গুলি বা আগ্নেয়াস্ত্র বৈধ হলেও, তার ব্যবহার কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতায় দুষ্ট। যেমন গুলির নির্দেশ বা বর্ষণের আগে এ বিষয়ে সর্বতোভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হবে। গুলিবর্ষণ হবে নিয়ন্ত্রিত। তা কেবল লক্ষ্যপানেই চলবে। তাতে অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি করা যাবে না। কাজ শেষ তো বর্ষণও শেষ ইত্যাদি (১৫৪ ধারা)।

ওই প্রবিধান, গুলির নির্দেশদাতার ওপরও চাপিয়ে দিয়েছে নানা দায়দায়িত্ব। যেমন গুলিবর্ষণকে তিনি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন যাতে ন্যূনতম ক্ষতিতে উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়। গুলিবর্ষণের নির্দেশদানের আগে তিনি তাঁর দূরত্ব-সীমা, লক্ষ্য ও গুলির রাউন্ড সংখ্যা ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে দেবেন। খেয়াল রাখবেন, জনতার মাথার ওপর দিয়ে অথবা তাদের দেহ ব্যতীত অন্য কোনো লক্ষ্যাভিমুখে যাতে গুলিবর্ষণ না হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যতটা প্রয়োজন, এর অতিরিক্ত গুলিবর্ষণ যাতে না হয়, সেদিকেও তিনি নজর রাখবেন। তা ছাড়া গুলি চালানোর জন্য সাধারণত তিনি নির্দিষ্ট ব্যক্তিবিশেষকে বা নির্ধারিত ‘ফাইল’কে নির্দেশ দেবেন। কিন্তু অফিসারদের নিরাপত্তা বা প্রাণহানি ও সম্পত্তি ধ্বংসের আশঙ্কা না থাকলে, দলের অর্ধেকের বেশি সদস্য যাতে একসঙ্গে গুলিবর্ষণ না করে, সে বিষয়টাও তিনি খেয়াল রাখবেন। দাঙ্গাকারী জনতার মধ্যে পশ্চাদপসরণের বা ছত্রভঙ্গ হওয়ার সামান্যতম প্রবণতা বা লক্ষণ দেখলেই তিনি গুলি বন্ধের নির্দেশ দেবেন ইত্যাদি (১৫৫ ধারা)।

পুলিশের গুলি প্রসঙ্গে এবার আমাদের সংবিধানের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ, যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার। আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।

৩২ অনুচ্ছেদ হুঁশিয়ার করছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।

৩৫(৩) অনুচ্ছেদ জানাচ্ছে, ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হবেন।

অন্যদিকে এ বিষয়ে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের অবস্থান আরও কঠোর। ওই ঘোষণাপত্রের ৩ অনুচ্ছেদ বলছে, প্রত্যেকেরই জীবনধারণ, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে।

৭ অনুচ্ছেদ ঘোষণা করছে, আইনের কাছে সকলেই সমান। কোনোরূপ বৈষম্য ছাড়া সকলেই আইনের দ্বারা সমান সুরক্ষা পাবে।

১০ অনুচ্ছেদ জানাচ্ছে, প্রত্যেকেরই তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ এবং তার বিরুদ্ধে আনীত যেকোনো ফৌজদারি অভিযোগ নিরূপণের জন্য পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার-আদালতে ন্যায্যভাবে ও প্রকাশ্যে শুনানি লাভের অধিকার আছে।

১১(১) অনুচ্ছেদের কণ্ঠেও ভিন্নরূপে প্রায় একই সুর—দণ্ডযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হলে প্রত্যেকেরই আত্মপক্ষ সমর্থনের নিশ্চয়তা দেয় এমন গণ-আদালত কর্তৃক আইনানুযায়ী দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে বিবেচিত হওয়ার অধিকার আছে।

অতএব, উপরিউক্ত বিধি-বিধান বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, পুলিশের গুলির ক্ষমতা কোনো সাধারণ বা অবারিত ক্ষমতা নয়। এটা জরুরি অবস্থায় ‘চূড়ান্ত ব্যবস্থা’ হিসেবে চর্চিত একটা ক্ষমতা। তাও আবার বিচিত্র সীমাবদ্ধতায় দুষ্ট বিশেষভাবে সংরক্ষিত একটা ক্ষমতা, যা কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বা জানমাল রক্ষায় ‘শেষ আশ্রয়’ হিসেবে প্রয়োগ করা যায়। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাশকতাকারীকে বিচার ছাড়া ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ কেবল বেআইনিই নয়, এটা একই সঙ্গে অসাংবিধানিক এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের পরিপন্থী।

সূত্র-http://prothom-alo.com/detail/date/2013-04-06/news/342593

আইনের ভাষ্যমতে এই যদি হয় পুলিশের গুলি করার বিধান তবে পুলিশের নিয়ন্ত্রকের এ বিষয়ে নূণ্যতম জ্ঞান এবং তার প্রয়োগ এমন হলে জাতির কপালে কী আছে সেটি একমাত্র সর্বশক্তিমানই জানেন।

বিষয়: বিবিধ

১১৫৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File