পাশ্চাত্যে পারিবারিক সংকট:
লিখেছেন লিখেছেন দিকভ্রান্ত নাবিক ১৭ মার্চ, ২০১৩, ০৮:৪০:৩১ রাত
বর্তমান তথ্যযুগে পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেট, রেডিও ও টেলিভিশনের মতো বিভিন্ন গণমাধ্যম নানাভাবে পরিবার ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে শিক্ষা, বিনোদন ও শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মিডিয়ার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। পারিবারিক সংস্কৃতির ওপরও মিডিয়ার অনস্বীকার্য প্রভাব রয়েছে।
বর্তমানে প্রচলিত পরিবার ব্যবস্থায় ক্রমেই পরিবর্তন আসছে। সন্তান নেয়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কে সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের সঙ্গে আচরণের ধরণও। এসব ক্ষেত্রে গণযোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। আজকের শিশু-কিশোররাই ভবিষ্যতের কর্ণধার। কাজেই তাদেরকে সঠিক জ্ঞান ও শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলার ওপরই ভবিষ্যতের শান্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করছে। আর সবাই জানে পরিবার হচ্ছে শিশুর প্রথম শিক্ষালয়। পরিবারেই ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক রীতি-নীতির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। আর পাশ্চাত্যের পরিবার ব্যবস্থাকে এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করছে গণমাধ্যম। টেলিভিশন ও ইন্টারনেট এখন প্রতিটি পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমেরিকার কাইসার ফেমিলি ফাউন্ডেশনের ২০০৫ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৮ থেকে ১৮ বছরের মার্কিন তরুণরা প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ছয় ঘন্টা গণমাধ্যমের প্রভাবে থাকে। এর মধ্যে টেলিভিশনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তবে টেলিভিশন, পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়ায় অনেক বিশেষজ্ঞই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আমেরিকার বিশিষ্ট লেখক ও তাত্ত্বিক নেইল পোস্টম্যান তাদেরই একজন। তিনি লিখেছেন, শিশুরা গণমাধ্যমে ডুবে থাকায় তারা নিজেরাসহ গোটা সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি শিশুদেরকে বেশি বেশি টিভি না দেখতে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। টেলিভিশনে বক্তব্যের সঙ্গে ছবি প্রদর্শিত হওয়ার কারণে তা সূক্ষ্ম ও মনস্তাত্ত্বিক কৌশলে জনমতের ওপর প্রভাব ফেলে । এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, জাদুর বাক্স নামে খ্যাত টেলিভিশন সঠিক তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে সমাজে সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। এ কথাও সত্য যে, রেডিও-টেলিভিশন অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিকে সামাজিক হিসেবে গড়ে তুলতে এবং শিশু-কিশোর ও তরুণদের মেধা বিকশিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, গণমাধ্যম বিশেষকরে টেলিভিশন পরিবারের ভিত্তিকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে বরং আরো দুর্বল করে দিচ্ছে।
শিশুরা সব কিছুই অতি দ্রুত আয়ত্ত করে। আর তা যদি দৃশ্যসম্বলিত হয়,তাহলেতো কথাই নেই। শিশুরা যা দেখে তাই অনুকরণের চেষ্টা করে। টিভিতে সম্প্রচারিত বিভিন্ন নাটক-সিনেমা থেকে শুরু করে কথাবার্তা-অঙ্গভঙ্গি, এ সব কিছুই তাদের ওপর প্রভাব ফেলে। মি. পোস্টম্যান পর্দায় কিছু দেখার চেয়ে বই পড়ার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। নেইল পোস্টম্যানের মতে, বই পড়ার জন্য শিশুকে কিছু বিষয় আয়ত্ত করতেই হয়। পড়ার মাধ্যমে শিশু একটি বিষয়কে গভীর ও সূক্ষ্ম ভাবে উপলব্ধি করতে পারে। আর এর ফলে রুচি ও কাজের মান বেড়ে যায়।
সবাই এটা স্বীকার করেন যে, সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোকে ভুলভাবে ব্যবহার করা হলে সমাজে মেধা বিকাশের পরিবেশ বিনষ্ট হয় এবং সৃষ্টিশীলতা ধ্বংস হয়ে যায়। মার্কিন লেখক মেরি উইন মনে করেন, নতুন নতুন গণমাধ্যম শিশুদেরকে আরো বেশি পরনির্ভরশীল করে তুলছে এবং মেধা বিকাশ ও আত্মনির্ভরশীলতার অনুভূতিকে হ্রাস করছে।
রেডিও ও টিভির নানা অনুষ্ঠান পরিবারে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। ইরানের পরিবার বিষয়ক গবেষণা ইনস্টটিউটের সদস্য ড. শারিফি এ সম্পর্কে বলেছেন, 'অতীতে বাস্তব অর্থেই প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা একটি ছাদের নিচে বসবাস করতো। এখন পরিবারের সদস্যরা আলাদা আলাদা বাস করেন। টেলিভিশনের মতো কিছু গণমাধ্যম পরিবারের ভিত্তি নষ্ট করার ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক ভূমিকা রাখছে। টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যমগুলো শুধুমাত্র পরিবারের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও রীতি-নীতির ওপরই প্রভাব ফেলছে না বরং পরিবারের সদস্যদের ওঠবসের পদ্ধতিটি পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিচ্ছে। বিভিন্ন নাটক ও সিনেমা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে।'
টিভি বিনোদনের একটি নেতিবাচক দিক হলো, এটা বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে মমতাপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করে। বড় শহরগুলোতেই এটা বেশি লক্ষণীয়। নীল পোস্টম্যানের মতো মিডিয়া গবেষকদের মতে, টেলিভিশন মানুষের চিন্তা ও উপলব্ধি ক্ষমতা হ্রাস করে। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় চাহিদা সৃষ্টি করে এবং রুচির পরিবর্তন ঘটায়। টিভি অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে মানুষের রুচিতে পরিবর্তন আসছে। জন্ম হচ্ছে নতুন নতুন ইচ্ছে ও আকাঙ্ক্ষার। আর টিভির মাধ্যমে পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হওয়ার পর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ওই পণ্য দিয়ে বাজার ভরে ফেলছে। এর ফলে পাশ্চাত্যের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লাভবান হচ্ছে। এভাবে পরিবারগুলোর খরচ দিন দিন বেড়ে চলেছে। পারিবারিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে পরিবার গঠনের আগ্রহও কমে যাচ্ছে।
বর্তমানে গণমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রে সমাজে সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, সহিংসতা বৃদ্ধিতে কোনো কোনো গণমাধ্যম মারাত্মক নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। অপরাধ বিষয়ক এবং সহিংসতাপূর্ণ সিনেমা সমাজে সহিংসতার মনোভাব, অন্যায় আচরণ ও অপরাধ প্রবণতা উস্কে দিচ্ছে। শিশু-কিশোররা সহিংসতাপূর্ণ সিনেমা দেখে সহিংস হয়ে উঠছে। বিনষ্ট হচ্ছে পারিবারিক শান্তি ও শৃঙ্খলা। সমাজ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, যেসব শিশু সহিংসতাপূর্ণ দৃশ্য দেখে, তাদের আচরণে এর প্রভাব পড়ে। তারা সহিংস আচরণ শুরু করে। কারণ টেলিভিশনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহিংস ও অপরাধ কর্মকাণ্ডকে স্বাভাবিক হিসেবে তুলে ধরা হয় এবং এর ফলে অপরাধমূলক আচরণের বিষয়ে ঘৃণা ও স্পর্শকাতরতা কমে যাচ্ছে।
আমেরিকার কলম্বিয়ান স্কুলের দুঃখজনক ঘটনায় দেখা গেছে, স্কুলের একজন কিশোর কীভাবে টিভির সহিংস দৃশ্যের একজন খলনায়কের স্থানে নিজেকে কল্পনা করতে থাকে। কল্পনার জগতে ভাসতে ভাসতে সে ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর গুলি চালায়। এতে বহু ছাত্র-শিক্ষক হতাহত হয়। অবশ্য আমেরিকায় এ ধরনের ঘটনা এখন ঘনঘনই ঘটছে। সহিংসতাপূর্ণ ও অশ্লীল সিনেমা শিশু ও কিশোরদের মন-মেজাজ ও আচরণের ওপর দ্রুত প্রভাব ফেলে। শিশু-কিশোর ও তরুণরা টিভিতে প্রদর্শিত দৃশ্যের অভিনেতাদের সঙ্গে নিজেদের গুলিয়ে ফেলে। 'শৈশবকালের বিলুপ্তি' নামক বইয়ে নেইল পোস্টম্যান এ সম্পর্কে লিখেছেন, 'সহিংসতাপূর্ণ নাটক ও সিনেমা দেখে বড়দের সম্পর্কে শিশুদের খারাপ ধারণা সৃষ্টি হয়। তারা মনে করে, বড়দের জীবন অসহিষ্ণুতা, মূর্খতা ও ঝগড়া-বিবাদে পরিপূর্ণ এবং সেখানে প্রেম-ভালোবাসার স্পর্শ নেই।'
শিশুদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও চিন্তা-বিশ্বাস গঠনে গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তবে নতুন প্রজন্মকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ শিশুরা ভালো বিষয়গুলোকে খুব সহজেই গ্রহণ করে এবং তারা সত্যকে দ্রুত মেনে নেয়। এ কারণেই ইসলামী বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনি (রহ.) রেডিও-টেলিভিশনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করে ঐশী ও নৈতিক শিক্ষা ও জ্ঞান প্রচারের জন্য এই মাধ্যমকে কাজে লাগাতে বলেছেন। কাজেই পাশ্চাত্য যদি মিডিয়াকে পরিবারের ভিত্তি ধ্বংসের কাজে ব্যবহার না করে সৎ লক্ষ্যে পরিচালনা করতো,তাহলে তাদের পারিবারিক সংকটের সমাধান করা সহজতর হতো নিঃসন্দেহে।#
বিষয়: বিবিধ
১৫৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন