সৈয়দ আমীর আলী এক অসাধারণ প্রতিভা

লিখেছেন লিখেছেন দিকভ্রান্ত নাবিক ১০ মে, ২০১৩, ০১:১৬:১১ রাত



আধুনিক মুসলিম ইতিহাসে সৈয়দ আমির আলী এক অনবদ্য স্থানের অধিকারী। তাঁর ছিল বহুমুখী প্রতিভা। একাধারে তিনি আইন তত্ত্ব ও চর্চায় প্রসিদ্ধ। ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠনের কাজে সাহসী অগ্রদূত, ইতিহাসবিদ। পাশ্চাত্যে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বিপক্ষে বিশ্বাসের প্রতিরক্ষক। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নীতির বিজ্ঞ সমালোচক। একজন অসাধারণ প্রতিভাবান প্রভাবশালী লেখক, দক্ষ পণ্ডিত। সে সময় তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না।

সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন আল্লাহপ্রেমিক, যাঁর জীবন ছিল কুরআনের আলোতে আলোকিত। তিনি ইসলামকে দেখিয়েছেন উন্নয়নের ধর্ম হিসেবে। ধর্মকে নিয়েছেন জীবনপদ্ধতি হিসেবে।

তিনি স্যার সৈয়দ আহমদ ও আল্লামা ইকবালের দলভুক্ত ছিলেন। ভারতীয়দের ইসলামের মুখোমুখি করেছিলেন এবং তাদের গন্তব্য সম্পর্কেও অবহিত করেছিলেন। আইনে শিক্ষিত একজন ভারতীয় মুসলমান, তিনিই প্রথম সর্বোচ্চ বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তিনি ন্যায়পরায়ণতা আইনের প্রতি অন্তর্দৃষ্টি, মানবিকতা, সুবিচারের মনোভাব এবং ইসলামের বৈধ পদ্ধতি নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করেছেন।

রাজ দরবারের সর্বোচ্চ প্রতিভাবান ব্যক্তি হিসেবে অবস্থান করেছেন এই প্রাজ্ঞ পুরুষ। তাঁর বিশাল দক্ষতা ও সাহিত্য বিষয়ক নৈপূণ্যের দ্বারা সম্যক ব্যক্তিদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তিনি দেশ এবং জাতিকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তিনি লেখক হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী। আনন্দদায়ক, স্পষ্ট ও স্বাচ্ছন্দ্য লেখনীতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ইংরেজি ভাষায় তাঁর ছিল আধিপত্য। এ থেকেই তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য এসেছিল, জন্ম নিয়েছিল স্পষ্ট সঠিক চিন্তাভাবনা। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তাঁর প্রথম বই “A Critical Examination of the Life and Teachings of Muhammad” প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ সালে এবং এই বইয়ে তিনি ইংরেজিতে সুনিপুণ দক্ষতা প্রকাশ করেছেন।

একজন চব্বিশ বছরের ভারতীয় যুবকের লেখা ইংরেজি বাগধারার উপর যে অস্বাভাবিক দখল পরিলক্ষিত হয় তা লোকমাত্রই ঈর্ষার বিষয়। ইসলামের ইতিহাসের উপর তাঁর অসংখ্য বই রয়েছে। তাঁর প্রধান দু’টি বই A Short History of Saracens এবং The Spirit of Islam. এই অসাধারণ বই দু’টি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে এবং দিন দিন পাঠকের চাহিদা বেড়েই চলছে, যা আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে দেয়।

সৈয়দ আমীর আলীই সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যাকে কেন্দ্র করেই ভারতবর্ষের মুসলমানরা সংগঠিত হয়েছিলেন। এই সংগঠন সমগ্র উপমহাদেশে সংবাদ প্রচার করতে থাকে এবং এভাবেই তিনি মুসলমান নেতাদের অল ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগে আসার পথ করে দেন।

১৯০৪, ১৯০৫ ও ১৯০৬ সালে তিনি মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক দলের কথা বক্তৃতায় ও লেখনীতে প্রচার করেন এবং মুসলিম লীগ গঠিত হলে স্বাগত জানান তখন তিনি লন্ডনে মুসলিম লীগের শাখা প্রতিষ্ঠা করে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

যে সময় ইংরেজি ভাষার প্রতি মুসলমানদের অনিহা ছিল সেই সময় সৈয়দ আমীর আলী অতি আগ্রহ সহকারে ইংরেজি ভাষা ভালো করে আয়ত্ব করেন। তাঁর বয়স যখন মাত্র বার বছর তখনই তিনি ঐতিহাসিক গীবনের মহাগ্রন্থ Decline and Falloff the Roman Empire অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। ঔষধ শাস্ত্র ছাড়াও তাঁর আরবি ও ফার্সি ভাষায় অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল।

সে সময় ব্রিটিশরা মুসলিম দেশগুলোর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতো। ইসলাম সম্পর্কে তাদের ছিল অনেক ভুল ধারণা। তিনি ব্রিটিশ সংসদ ও ইংরেজি সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় ও প্রচুর আর্টিকেল লিখেছেন। পাশ্চাত্যে ইসলামের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছেন। সমালোচনার উত্তর দিয়েছেন পাণ্ডিত্য ও বিজ্ঞতার মাধ্যমে। এভাবে পাশ্চাত্যের অনেক ভুল বোঝাবুঝি দূর করেন। ইসলাম শান্তির ধর্মÑ এর পক্ষে তাঁর যুক্তিগুলো ছিল বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্য। তিনি The Sprits of Islam গ্রন্থে মহানবীকে (সা) মানবীয়পুণ্যের ধারক ও মহান উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি প্রমাণ করে দেখান যে, সমগ্র মানবজাতির আদর্শ হযরত মুহাম্মদ (সা) এবং তাঁর প্রচারিত আদর্শ মানব-কল্যাণের।

সৈয়দ আহমদ খানের মত আমীর আলী ছিলেন ইংরেজি শিক্ষার একজন প্রচারক এবং নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে মহা বিশ্বাসী। তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপনকারী।

এই অসামান্য প্রতিভাবান বিখ্যাত মনীষী, ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষক, সমাজ বিষয়ক লেখক ১৮৪৯ সালের এপ্রিল মাসে উড়িষ্যার কটকে জন্মগ্রহণ করেন। ইরানের মেশেদ থেকে আগত শিয়া পরিবারের বংশধর তিনি। আমীর আলীর প্রপিতামহ ১৭৩৯ সালে নাদির শাহের সৈন্যদলের সাথে ইরান থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে আসেন। এবং মোগল ও অযোদ্ধার দরবারে চাকুরি করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ইউনানী চিকিৎসক এবং পাণ্ডিত্যের অনুরাগী।

এ সময় মুসলমান পরিবার ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজ সরকারের শিক্ষাগত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সৈয়দ আমীর আলীর পিতা সা’দত আলীর অনেক ইংরেজ বন্ধু ছিল। তিনি তার পুত্রদের জন্য তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করেন। সৈয়দ আমীর আলী প্রথমে কলকাতা মাদ্রাসা ও পরবর্তীতে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল ও মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করেন। হুগলি মাদ্রাসায় ব্রিটিশ শিক্ষকদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেখানে প্রতিযোগিতায় মূল বৃত্তি লাভের কারণে পরীক্ষায় ঈর্ষনীয় ফলাফল অর্জন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৬৭ সালে স্নাতক ও ১৮৬৮ সালে ইতিহাসে সম্মানসহ এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৬৯ সালে এলএলবি ডিগ্রি নেয়ার পর তিনি কলকাতায় আইন ব্যবসা শুরু করেন।

তাঁর সমসাময়িক যে ক’জন মুসলমান ব্যক্তি বিশেষ সাফল্য অর্জন করেন, তিনি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন। সাত বছর বয়সে তাঁর পিতা মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মা তাঁকে কুরআন, আরবি, ফারসি শিক্ষার জন্য একজন মৌলভিকে গৃহশিক্ষক নিয়োজিত করেন।

ইসলামী সমাজের উদ্ভব, অগ্রগতি সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয় হুগলি ইমামবারা থেকেই।

সমাজ গড়ার মৌলভি সৈয়দ কেরামত আলী জৌনপুরী তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সাপ্তাহিক আলোচনাসমূহে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করেন। ফলে সতের বছরের আমীর আলী গ্রিক, ইসলামী ও ইউরোপীয় সমাজের মধ্যে জ্ঞানের আদান-প্রদানের উপর লিখিত কেরামত আলীর উর্দু রচনাবলি ইংরেজিতে অনুবাদ করায় সাহায্য করেন এবং পরে এই বিষয়ে নিজেই ইতিহাস বিষয়ক পুস্তক প্রকাশে উৎসাহিত হন।

সৈয়দ আমীর আলী এলএলবি সমাপ্ত করে ব্রিটেনে পড়াশোনা করার জন্য সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৬৯ সালে লন্ডনে বসবাসের সাথে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডেও অংশ নেন। ভারতীয় মুসলমানদের সমস্যাদির উপর উন্মুক্ত বক্তৃতা দেন এবং পরবর্তীতে তা বই আকারে প্রকাশ করা হয়।

সৈয়দ আমির আলী ১৮৭৯ সালে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট থেকে হাইকোর্টের জজ পদে উন্নীত হন এবং অতিদ্রুত তাঁর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পরে। এই সুনাম শুধু আইন ব্যবসায়ী হিসেবে নয় একজন শিক্ষক, বিচারক, ইতিহাস লেখক এবং সমাজ সংস্কারক হিসেবেও।

সৈয়দ আমীর আলী ১৮৭৭ সালে ন্যাশনাল মোহামেডান প্রতিষ্ঠা করেন এবং একাধারে পঁচিশ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক ছিলেন। ঊনিশ শতকের আশির দশকে তিনি ভারতীয় মুসলমান জাগরণের উদ্যোক্তা ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানÑ তিনি ব্রিটিশ ও ইংরেজি জানা ভারতীয়দের মধ্যে প্রচ্ছন্ন মতামত প্রচারের জন্যে সংবাদপত্রকে যথাযথ কাজে লাগাতে সক্ষম হন।

সৈয়দ আমীর আলী লন্ডনে ১৮৮৪ সালে ইসাবেল ইভা কনস্ট্যামকে বিয়ে করেন এবং ১৯০৪ সালে ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে যান।

আমীর আলী প্রকাশনা জগতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থে ইসলামের স্বর্ণযুগের প্রশংসা করা হয়েছে। ইসলামের অর্জনসমূহ চোখের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। অন্যান্য সংস্থাসমূহের ত্র“টি-বিচ্যুতিকে নিন্দা করা হয়েছে।

ইতিহাসের এই মহান পণ্ডিত ব্যক্তি ১৯২৮ সালের ৩ আগস্ট ইংল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি স্ত্রী ও দুই পুত্র রেখে যান।

আধুনিক মুসলিম ভারতের ইতিহাসে আমীর আলী সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত। ইসলামের নবজাগরণে তিনি শীর্ষ স্থানে- সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

বিষয়: বিবিধ

৩৬৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File