অনাগত সন্তানের জন্য মায়ের ভালবাসা এবং অপেক্ষার প্রহর!!!
লিখেছেন লিখেছেন সাইদ ২৭ জুন, ২০১৩, ০৯:১৪:৩৯ সকাল
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।আসসালামুআলাইকুম।
বিদেশে না আসলে হয়তো এই লেখাটা আমার হতো না।দেশে ছোটবেলায় কতজনকে তো মা হতে দেখলাম কিন্তু মায়ের অনুভুতি কখনো বোঝার সামর্থ্য হয়নি। হ্যা,হতে পারে ছোটো ছিলাম বলে হয়নি,কিন্তু আমার কেনো যেনো মনে হয় দেশের অনেক বাবারই মায়ের অনুভুতিটা পুরোপুরি বোঝার সৌভাগ্য হয়না।মায়ের পাশে অগনিত আত্বীয় স্বজন বাবাকে সেই অনুভুতি থেকে কিছুটা হলেও দেওয়াল সৃষ্টি করে রাখে।আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া এই প্রবাস জীবনে নিজের থেকে উপলদ্ধী করা সেই দিনগুলোর কথা শেয়ার করে সমগ্র নারী জাতীর প্রতি এই অধম বান্দার ভালবাসার কথা প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য।
কয়েকদিন ধরে বউ এর শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা দেখে অফিস ছুটি নিয়ে বৌকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম।দুইজনই যখন বাচ্চার হার্টবিট দেখতে পেলাম, মনেমনে আল্লাহ আকবার বললাম।নিজের কাছেই অবিশ্বাস লাগছে মাত্র ৭সপ্তাহে হার্টবিট দেখে।ডাক্তার আমাকে চার সপ্তাহ পরে আসতে বললো।চার সপ্তাহ মনে হচ্ছিলো অনেক লম্বা সময়।ডাক্তারকে রিকোয়েস্ট করলাম দুই সপ্তাহ পরপর চেক করতে আসি।ডাক্তার মুচকি হেসে বললো ঠিক আছে শুধু তোমার জন্য এলাও করলাম।এই সময়টা ডেঞ্জারাস পিরিয়ড বলে আমাকে টেককেয়ার করার পরামর্শ দেওয়া হলো।এই প্রবাস জীবনে আমি কি পারবো সব সামলাতে ভাবতে ভাবতে একধরনের চাপা সুখ আর টেনসন নিয়ে বাসায় ফিরলাম।সবকিছুতেই তার খাওয়ার অরুচি,আর তীব্র গন্ধ।সাথে ঘন ঘন বমি।আমার শরীরের গন্ধও নাকি অসহ্য!কি ভয়াবহ ব্যাপার!অনেক পরিপাটি করেও কাজ হলো না।আরও ভয়াবহ ব্যাপার কারোর সাথে কথা বলতে অনীহা।মুখে কাপড় গুজে সবসময় শুয়ে থাকা।রাতে ঠিকমতো ঘুম আসেনা।মাঝরাতে মাঝে মাঝে দেখতাম জেগে আছে।নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো।আমার কিছুই এখানে করার কোনো ক্ষমতা নেই।পরিচিত এক ভাবীর সাথে আলাপ করে আমাকে টেনসন কম করতে বললো।বুঝতে পারলাম অনেকের তুলনায় তার সমস্যার মাত্রাটা একটু বেশী।তবে এর থেকেও নাকি আবার বেশী আছে।এর থেকেও বেশী শুনে তো আমার মাথায় আর কিছুই ঢুকছেনা।অগত্য, অফিসে যাওয়ার আগে খাবার রেডি করে বিছানার পাশে রেখে যেতাম।অফিস থেকে এসে দেখতাম বেশীরভাগ খাবারই পড়ে আছে। নিজের আত্বীয় স্বজনকে দেখে তো কখনই এরকম সমস্যার কথা বুঝতে পারিনি।নাকি এসব সমস্যা তারা চক্ষুলজ্জার ভয়ে নীরবে আড়াল করে প্রতিনিয়ত সহে বেড়িয়েছিল?
বাইশ সপ্তাহর দিকে কিছুটা স্বাভাবিক বোধ করায় স্বস্তি ফিরে পেলাম।গত তিনটা মাসের কথা মনে হলেই আৎকে উঠতাম।এতোদিনে পুরো শরীরের গঠন হয়ে গেছে।ফোরডি ছবি দেখেদেখে দুজনে কল্পনার জগতে হারিয়ে যেতাম।নাকটা কি আমার মতো?দেখে তো মনে হচ্ছে ফেস টা তোমার মতো।এ যেনো এক অন্য রকম ভালবাসা।এখনও দুনিয়াতে আসেনি কিন্তু তাকে নিয়ে আমাদের ভাবনার শেষ নেই।এ যেনো আল্লাহর অপার মহিমা।দুষ্টটা এখন মাঝে মাঝে নড়ে।পেটের উপর থেকে স্পস্ট বুঝা যেতো।আমি কথা বললে নাকি বেশী নড়ে?একটা জীবন্ত মানুষের মধ্যে আরেকটা জীবন্ত মানুষ।ভাবতেই শিহরণ জাগতো।দুষ্টটার নড়ার কথা মনে হলেই অফিস থেকে বাসায় ছুটে যেতে ইচ্ছা করতো।আস্তে আস্তে দুষ্টটার ওজন বাড়তে লাগলো।যতই ওজন বাড়ে ততোই যেনো মায়ের কষ্টটা বেড়ে যায়। এখন তো হাটতেও কষ্ট।শ্বাস প্রশ্বাস নিতেও কষ্ট।এই বুঝি পড়ে যাবে।বাসায় কেউ যে একজন সাহায্য করবে তাও তো নেই।যতই দিন যেত ততই যেনো নিজের স্ত্রী,মা সমগ্র নারী জাতীর উপর ভালবাসা,শ্রদ্ধা বেড়ে যেতো।একদিন বাবা মার ক্লাসে আমার পেটে ৮kg ওজনের একটা পাথর বেধে দিয়ে আমাকে হাটতে বলে অনুভুতি বোঝার জন্য।১০-১২kg ওজন বেড়ে গেছে।২৪ঘন্টা এই বাড়তি ওজন নিয়ে চলাফেরা করা, ঘুমানো,যে কি যন্ত্রণা তা আমি কিছু সময়ের জন্য পেটে পাথর বেধেই বুঝে ফেলেছি।কিন্তু আমার তো শুধু ভালবাসার কথা বলা ছাড়া আর কিছুই আজ করার নেই।একজন মা প্রতিনিয়ত কিভাবে এটা মেনে নেই।মায়ের এতো কষ্ট দেখে বলতাম একটা বাচ্চাই আমাদের যথেষ্ঠ।
দিন ঘনিয়ে আসলো।কিন্তু প্রসব বেদনা আসেনা।ব্যথা আসে আবার একটু পরেই চলে যায়।অফিস থেকে কতোবার যে বউ এর ব্যাথার কথা শুনে বাসায় চলে এসেছি তার ঠিক নেই।দুষ্টটা আমাদেরকে নিয়ে নতুন খেলা পেয়েছে।ডাক্তার বললো বেশী হাটতে এবং সিড়ি ভেঙ্গে উঠানামা করতে।ডাক্তারকে বললাম সিজার করতে।কিন্তু এখানকার ডাক্তার নরমাল ডেলিভারী প্রিফার করে।সিজার হচ্ছে ডাক্তারের শেষ অপশন।কি যন্ত্রণা নিজে যে হাটতে পারেনা তাকে সিড়িভেঙ্গে বেশী বেশী উঠানামা করতে হবে!নিজের চোখে না দেখলে এই কষ্টের অনুভুতি গুলো উপলদ্ধী করা সম্ভব না।আল্লাহ মাকে কেনো এতো গুরত্ব দিয়েছেন বুঝতে আমার বাকী থাকে না।কোনো কিছুতেই দুষ্টটা বের হতে চাইলো না।আমাদের সাথে তার এত আড়ি করার কারণ বুঝলে না হয় মান ভাঙানো যেতো!
ক্লিনিকে ভর্তি হলাম।কৃত্তিম ভাবে ব্যাথা উঠানোর চেষ্টা করা হলো।আমি জুম্মার নামাজের জন্য তাকে ক্লিনিকে রেখে মসজিদে গেলাম।আল্লাহর কাছে দোআ করলাম। নামাজ থেকে এসে বউ এর মুখে কৃত্তিম শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্র দেখে তো আমি থ হয়ে গেলাম।ডাক্তার বললো জরুরী ভাবে অপারেশন করতে হবে।বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।আমি কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না শুধু বললাম যেটা ভালো মনে হয় করো।অপারেশন এর পাশের রুমের বেঞ্চে একা বসে আছি।কাটাকাটি আমি ছোটকাল থেকেই খুব ভয় পেতাম।মাথায় শুধু কাজ করছে বউ এর কথা।হে আমার রব তুমি তাদেরকে হেফাজত করো।একটা ঘন্টা যেনো শেষ হচ্ছিলো না। তারপর একটা বাচ্চার কাঁদার শব্দ শুনলাম।একটু পরে নার্স এসে বাচ্চাকে আমার কোলে তুলে দিলো।আমার তখন চিন্তা বাচ্চার মাকে নিয়ে।মা কেমন আছে জিজ্ঞাসা করতেই বললো ভালো আছে,মুখের কাছে বাচ্চাকে ধরতেই একটু হাসি দিলো।আল্লাহকে শুকরিয়া জানিয়ে বাচ্চার কানে আজান এবং ইকামত দিলাম। সবচেয়ে বিস্স্বয় লাগে যখন দেখি এই মায়েরাই তার আগের সব কষ্টের কথা ভুলে গিয়ে আবার দ্বিতীয় বাচ্চা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে।এ এক আল্লাহর কুদরত।এর সঠিক ব্যাখ্যা হইতো সর্বশক্তিমান তিনিই ভালো জানেন।
আল্লাহ হাফেজ
বিষয়: বিবিধ
২৫০৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন