ইবনে সিনা "দ্য প্রিন্স অব ফিজিশিয়ানস"
লিখেছেন লিখেছেন The Sword of Allah খালিদ বিন ওয়ালিদ ১৭ মার্চ, ২০১৩, ০৮:৪১:৪২ রাত
শারীরিক সুস্থতার জন্য রোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজন। আর সে জন্য সব যুগেই চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ব্যাপক চেষ্টা ও গবেষণা চালিয়ে গেছেন। বর্তমানে বিশ্বে গুটিকয়েক রোগ ছাড়া প্রায় সব রোগেরই চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। চিকিৎসা শাস্ত্রের এ উন্নতির পথে যার অবদান সবচেয়ে বেশী তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। তার গ্রন্থ "আল কানুন ফিল থিব" চিকিৎসা শাস্ত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাঠ্য পুস্তক হিসেবে প্রায় পাঁচশ বছর ধরে গণ্য করা হতো । তিনিই প্রথম মানব চক্ষুর সঠিক এনাটমি করেন। যক্ষ্মা রোগ নিয়ে তিনি অভিমত দেন যে, যক্ষ্মা একটি ছোঁয়াচে রোগ। ইবনে সিনার মৃত্যুর পর পশ্চিমা চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ অভিমত প্রত্যাখ্যান করলেও পরে তা সঠিক বলিই প্রমাণিত হয়। ইবনে সিনা এতই খ্যাতিমান চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন যে, পশ্চিমা বিশ্বে তিনি "দ্য প্রিন্স অব ফিজিশিয়ানস" নামে পরিচিত।
ইবনে সিনা ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই বোখারা শহরটি সে সময় ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন। আর ইবনে সিনার বাবা আব্দুল্লাহ ছিলেন পারস্য তথা ইরানের খোরাসান প্রদেশের শাসক। ইবনে সিনার আসল নাম আবু আলী আল হোসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা। তবে তিনি ইবনে সিনা, বু-আলী সিনা এবং আবু আলী সিনা নামেই বেশী পরিচিত।
ইবনে সিনা শৈশবে অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্ত করে ফেলেন। কোরআনের পাশাপাশি তিনি তিনজন গৃহ শিক্ষকের কাছে ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ্â, তাফসীর, গণিত শাস্ত্র, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি প্রভৃতি বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি তখনকার দিনে প্রচলিত প্রায় সকল জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। এ সময় তিনি 'হাকিম' অর্থাৎ বিজ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান উপাধিতে ভূষিত হন।
সকল বিষয়ে জ্ঞানার্জন করার পর ইবনে সিনার শিক্ষক বিখ্যাত দার্শনিক আল নাতেলী তাকে স্বাধীনভাবে গবেষণা করার পরামর্শ দেন। ইবনে সিনা তখন চিকিৎসা বিজ্ঞানে পারদর্শীতা অর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি চিকিৎসার মাধ্যমে দুঃস্থ মানবতার সেবা করার জন্য মনস্থির করেন। অল্পদিনের মধ্যেই একজন বিখ্যাত চিকিৎসক হিসেবে তার নাম সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় বোখারার বাদশাহ ছিলেন নূব বিন মানসুর। তিনি একবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। কোন ডাক্তারই তার রোগ সারাতে পারছিল না। এসময় বাদশাহ ইবনে সিনাকে ডেকে পাঠালেন। ইবনে সিনা বাদশাহকে ভালভাবে পরীক্ষা করে রোগ সম্পর্কে অবহিত হলেন। পরে মাত্র কয়েকদিনের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠলেন। বাদশাহ ইবনে সিনার ওপর খুব খুশী হলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন-আপনি কি পেলে খুশী হবেন? ইবনে সিনা বললেন, আমি আপনার কাছে তেমন কিছুই চাই না। আপনার লাইব্রেরীর বইগুলো পড়ার সুযোগ দিলেই আমি বেশী খুশী হবো। বাদশাহ তা-ই করলেন ৷
ইবনে সিনা লাইব্রেরীতে পড়ার সুযোগ পেয়ে রীতিমত অধ্যয়ন শুরু করলেন এবং লাইব্রেরীর সব বই মুখস্থ করে ফেললেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিত, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদাতত্ত্ব, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কাব্য ও সাহিত্য বিষয়ে অসামান্য পান্ডিত্য অর্জন করেন। ২১ বছর বয়সে তিনি আল মুজমুয়া নামে একটি বিশ্ব কোষ রচনা করেন। এতে তিনি গণিত ছাড়া সব বিষয় লিপিবদ্ধ করেন।
ইবনে সিনার বয়স যখন ২২ বছর তখন তার পিতা আব্দুল্লাহ ১০০১ সালে ইন্তেকাল করেন। এ সময় তিনি সকলের অনুরোধে খোরাসানের শাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি বেশী দিন খোরাসানের শাসনকর্তার পদে থাকতে পারলেন না। কারণ গজনীর সুলতান মাহমুদ খোরাসান দখল করে নেন। ফলে ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি খাওয়ারিজমে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সময় খাওয়ারিজমের বাদশাহ ছিলেন মামুন বিন মাহমুদ। ইবনে সিনা সেখানে ১০১০ সাল পর্যন্ত নির্বিঘ্নে কাটান।
ইবনে সিনার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে গজনীর সুলতান মাহমুদ তাকে তাঁর রাজসভায় আনতে চাইলেন। তিনি খাওয়ারিজমের বাদশাহর কাছে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে একটি পত্র পাঠালেন। ইবনে সিনা ছিলেন অত্যন্ত আত্ম মর্যাদাবান একজন মানুষ। তিনি ভাবলেন, গজনীতে গেলে হয়তো স্বাধীনতাভাবে চলাফেরা করতে পারবেন না-তাই তিনি খাওয়ারিজম ছেড়ে প্রথমে আবিওয়াদি, পরে তুস, নিশাপুর ও শেষে গুরগাঁও যান । কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এক জায়গায় বেশী দিন থাকা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তিনি এরপর কাজভীন ও হামেদান শহরে যান। হামেদানে ইবনে সিনা তার বিখ্যাত গ্রন্থ আশ শিফা ও আল আনুন লেখায় হাত দেন। হামেদানের বাদশাহ শামস্â-উদ-দৌলা সে সময় মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হন। ইবনে সিনা ৪০ দিন চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। খুশী হয়ে বাদশাহ তাকে মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ইবনে সিনা তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতার কারণে তিনি রাজ দরবারে অনেকের ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হন।
বাদশাহ শামস্â-উদ-দৌলার মৃত্যুর পর ইবনে সিনা ইস্ফাহানে চলে যান। সে সময় ইস্ফাহানের শাসক ছিলেন আলা-উদ-দৌলা। তিনি ইবনে সীনাকে পেয়ে ভীষণ খুশী হন। ইবনে সিনার জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি করে দেন। ইবনে সিনা তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ আশ-শিফা ও আল কানুনের অসমাপ্ত লেখা সেখানেই শেষ করেন।
এবার আমরা আল কানুন ও আশ-শিফা সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করবো।
আল কানুন গ্রন্থটি তৎকালীন বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। পাঁচটি বিশাল খন্ডে বিভক্ত গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৪ লাখেরও বেশী। সে যুগে এতবড় গ্রন্থ আর কেউই রচনা করতে পারেনি। বইটিতে ৭৬০টি জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। ইউরোপের মেডিকেল কলেজগুলোতে এই গ্রন্থটি বহুকাল পাঠ্য ছিল। সম্ভবত এসব কারণেই পশ্চিমা পন্ডিত ড. উইলিয়াম ওসলের 'আল কানুন'কে মেডিকেল বাইবেল' বলে ঘোষণা করেন। আরবী ভাষায় লেখা 'আল কানুন' গ্রন্থটি ল্যাটিন, ইংরেজী হিব্রু প্রভৃতি ভাষায় অনূবাদ করা হয়।
শারীরিক রোগ নিরাময়ের জন্য তিনি যেমন আল কানুন লিখেছেন তেমনি আত্মার রোগ নিরাময়ের জন্য দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ 'আশ-শিফা' লিখেছেন। বিশ্ববিখ্যাত এ গ্রন্থে তিনি আত্মানর রোগ নিরাময়ের দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। বিশ খন্ডে বিভক্ত এই বইটিতে রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রাণীতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব সহ জগৎ ও জীবনের প্রায় সকল বিষয়কেই অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে৷ এ দুটো বিখ্যাত গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তিনি প্রায় শতাধিক মূল্যবান বই লিখে গেছেন।
ইবনে সিনা একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। তিনি নিজেকে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও একনিষ্ঠ মুসলিম বলে দাবী করতেন। তিনি রীতিমত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন। তিনি কোন বিষয় যখন বুঝতে পারতেন না তখন দু'রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন। কান্নাকাটি করে বলতেন, "হে আল্লাহ! তুমি আমার জ্ঞানের দরজা খুলে দাও।" কান্নাকাটির পর তিনি যখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেন তখন স্বপ্নের মধ্যে অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো তার মনের পর্দায় ভেসে উঠতো। তার জ্ঞানের দরজা খুলে যেত। ঘুম থেকে ওঠে তিনি সমস্যার সমাধান করে ফেলতেন।
বিষয়: বিবিধ
২১৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন