ভারতপ্রীতি ও আমাদের ট্যাক্সনীতি
লিখেছেন লিখেছেন FM97 ২৫ মে, ২০১৪, ১০:৪৫:৫৯ সকাল
ব্যবসা খাতে অবাস্তব ট্যাক্সনীতি, বৈচিত্রের সমানুপাতে দেশী-বিদেশী পণ্যের বাজারমূল্যের অদ্ভুত চিত্র--জনগণের মনে বিদেশপ্রীতি জাগিয়ে তোলে। যার ফলে বিদেশী ব্যবসায়ীদের হয় পোয়াবারো অবস্থা আর ভুক্তভোগী খোদ দেশীয় ব্যবসায়ী। ……মার্কেটে শাড়ি কিনতে গিয়ে এমনই অনুভূতি নিয়ে ফিরলাম।
আমার শর্ত ছিলো একটাই- ভারতীয় নয় দেশীয় বুটিক্স থেকে শাড়ি কিনবো। কারণ আমরা যারা ভারতের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে সচেতন (তবে মোদিজি এখন কি পদক্ষেপ নিবেন সেটা অপেক্ষার বিষয়, যদিও কুটনৈতিক সম্পর্কে বিশেষ করে যেখানে ব্যবসায়িক লাভের বিষয় জড়িত- সেখানে নিজ দেশের ক্ষতি করে কিছু করবেন না-এটাই স্বাভাবিক ) তাই আমাদেরকে সজাগ না হয়ে উপায় নেই। তাছাড়া সাংস্কৃতিক আগ্রাসননীতি, আমাদের প্রায় ১৬ কোটির বিশেষ করে মেয়েদের আপাদমস্তক পণ্যের বাজার দখল, সেই সাথে দেশীয় ব্যবসায়ীদের নিজেরই দেশে টিকে থাকার সংগ্রাম সম্পর্কে আমরা যারা ওয়াকিবহাল- তাদেরকে বিকল্প পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি ত্যাগী না হলেও হয় না। তাই প্রায় এক ঘণ্টা এক বুটিক্স থেকে আরেক বুটিক্স ঘুরে অবশেষে ‘রঙ’ থেকে একটা শাড়ি কিনলাম। তবে সত্যি বলতে- আমি যে দামে বুটিক্স থেকে শাড়িটি কিনেছি- সেই দামে কিংবা আরো কমে ভারতীয় বাহারি ডিজাইনের শাড়ি পাওয়া যেতো। তাহলে এবার ভেবে দেখুন, সাধারণ জনগণ কিভাবে তাহলে দেশীয় বুটিক্স থেকে শাড়ি কিনবে? যেখানে তার চেয়ে কমেই ভারতীয় শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে? সুতরাং, পরিস্থিতি এমন বৈষম্যমূলক কেনো?
কারণ প্রচুর। বুটিক্সগুলোর সীমাবদ্ধতা, সরকারি অসহযোগিতা, দেশীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ট্যাক্স এবং সর্বোপরি-সরকারি পরিকল্পনার অভাব। তবে সরকার ও বিদ্যমান বুটিক্সের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের দেশে ভারতের বাজার দখল নিয়ে কিছু বলবো। ভারতের অনুপ্রবেশ সহজ হয়েছে মূলত আমাদের কিছু অসচেতনতার কারণে। প্রথমত আমাদের দেশে ভারতীয় চ্যানেলের অবাধ অনুপ্রবেশ থাকায়- তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপণ, প্রশাধনী-সামগ্রীর ব্যাপক প্রচার, পোশাক-বৈচিত্র খুব সহজেই এদেশের জনগণকে আকৃষ্ট করছে এবং চাহিদা বাড়ছে। এদিকে বর্ডার থেকে চোরাইপথে ভারতীয় পণ্যের অনুপ্রবেশ এবং নিয়মমাফিক ভারতীয় পণ্য আমদানি করলেও দেশীয় পণ্যের বিপরীতে সেসব পণ্যের ওপর কম ট্যাক্স আরোপ- ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ফলে বাজার দখল ও আমাদের জনগণের ওপর ভারতীয় পণ্যের প্রভাব বিস্তার- দুটোই খুব সহজভাবে কাজ করছে। ফলে, ভারতীয় পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। যা সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে আমাদের অর্থনীতিতে।
এবার দেশীয় বুটিক্সের সীমাবদ্ধতা নিয়ে বলতে -
১/ ডিজাইনে বৈচিত্রের অভাব।
২/ এক পিস শাড়ি যে রঙয়ের ওপর কাজ করা ঠিক সেই কাজই অন্যান্য রঙয়ের মধ্যে নেই।
৩/ ভারতীয় অনুকরণে নেটের কাপড়ের ওপর কাজ করা শাড়ি (যদিও এমনটি করার কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখি না)। এসব টাইপ শাড়ি আমাদের মতো ক্রেতাদের হতাশ করে। কারণ, ব্যক্তিগতভাবে মনে করি- নেটের শাড়ি পরা আর শরীরে কাপড় না পরা অনেকটা একই।
৪/ দেখে মনে হবে খুব সাধারণ, তবে দাম দেখে চোখ কপালে উঠে যাবে। একটু কাজ করা থাকলেই ১০,০০০/১৫,০০০ টাকার রেট- যেটা অতিরিক্ত মনে হয়।
সুতরাং ভারতের সাথে আমাদের পণ্য মূল্যের এমন তারতম্য সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় ‘রঙ’ এর এক কর্মকর্তা বলেন- “আমাদের কাপড়ের মান ভালো তাই দামটা বেশি পরে যায়, আর সরকার আমাদের পণ্যে দিয়ে রেখেছে ৫ শতাংশ ট্যাক্স, অথচ ভারতীয় পণ্যে ২.৫ শতাংশ, তাই…”।হ্যা, কাপড়ের মান ভালো, সহজে ছিড়ে না, সেটার প্রমাণ বাস্তবে দেখেছি, তবে ট্যাক্সের অদ্ভুত নীতি দেখে অবাক হলাম। নিজ দেশের পণ্যের ওপর বেশি ট্যাক্স! যদিও চিত্রটা উল্টো হওয়ার কথা ছিলো। কারণ, নিজ দেশে দেশীয় উদ্দ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য। অথচ, আমাদের দেশে একটা লোক যদি ব্যবসায় করতে নামে, প্রথমেই তাকে পরতে হয় চাঁদাবাজির কবলে। তাদের কথা-“হয় টাকা দাও, না হয় ব্যবসা করতে দিবো না”। এদিকে সমাজের আরেক বড় চাঁদাবাজ হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ। এবার তাদেরকে অনৈতিক পন্থায় খুশি করা লাগে। এসব ধাপ পাড় করেও যখন একজন ব্যবসায়ী বাজারে গিয়ে দেখবে - বিদেশী পণ্যের দাম দেশীয় পণ্যের চেয়ে কম- তাহলে কি করেইবা সেই ব্যবসায়ী টিকে থাকতে পারে? ফলে প্রতিনিয়ত আমাদের বাজার চলে যাচ্ছে বিদেশীদের দখলে। যার ফলে বর্তমানে অধিকাংশই ‘made in china’ আর বস্ত্র খাত বিশেষ করে ভারতের কবলে।
এদিকে দাম বাড়ার পিছনে আরেকটি কারণ হলো- আমাদের দেশে তুলা উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল, তাই তুলা-সুতা ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। জানা যায়- বাংলাদেশ প্রতিবছর ৪০ লাখ বেল তুলা আমদানি করে, এর মধ্যে তুলা উৎপাদন ও রপ্তানীতে বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান দেশ ভারত থেকেই আসে ৩০-৩৫ শতাংশ। বাকিটা পাকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা হয়। জানি, নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় ভারত থেকে আমদানিতে পরিবহন খরচ পরে কম, তবে আমাদের দেশ যাতে অতিরিক্ত একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পড়ে, তাই আশেপাশের অন্য কোনো দেশ থেকে যদি তুলা আমদানি করা যায় আর খরচও যদি প্রায় একই পড়ে তাহলে সে দেশ থেকেই নেয়া উচিত। এটা এই কারণে যে- অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, অর্থনীতির ওপর একটা দেশের একক প্রভাব যদি পড়ে, তাহলে রাজনীতির ওপরও সেই দেশের দাদাগিরি শুরু হয়ে যায়। সুতরাং, আমাদের সাবধান হতে হবে।
আমি ওপরে আমাদের বুটিক্সের কিছু সমালোচনা করেছি সমাধানের নিমিত্তে। কারণ- আমরা যদি না বুঝি আমাদের সমস্যা কোথায়, তাহলে সেটা কাটিয়ে উঠতে পারবো না। পরিকল্পনা নিতে পারবো না। এদিকে চিন্তার বিষয় হলো, বিগত বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি দেশ তাদের পোশাক শিল্পে কয়েক দশকের পরিকল্পনা নিয়ে সুফল অনুভব করলেও আমাদের সরকারের সেই দিকে মাথাব্যাথ্যা নেই। আশেপাশের কয়েকটি দেশের পরিকল্পনা উল্লেখ করে বিজিএমইএ’র সভাপতি জনাব আতিকুল ইসলাম-উনার “আমাদের পোশাক শিল্প এবং প্রতিযোগী দেশগুলো” শিরোনামের লেখায় বলেন- “ভারত সরকার আগামী তিন বছরে তাদের পোশাক রফতানি ৩০ বিলিয়ন ডলার করার লক্ষ্যে তাদের ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের বাজেটে পোশাক খাতের ওপর প্রযোজ্য ১২% সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিউটি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছে। তাছাড়া ১২তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় টেক্সটাইল আপগ্রেডেশন ফান্ড স্কিমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে টেক্সটাইল খাতকে আধুনিকায়নের জন্য ১৫ হাজার ৫৮৬ কোটি রুপি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এদিকে ভিয়েতনাম সরকার এ খাতে আয়কর রেয়াতসহ ১০ ধরণের বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে। তাছাড়া চীন সরকার বস্ত্র ও তৈরি পোশাক রফতানিতে ৬৩ ধরণের সাবসিডি সুবিধার মাধ্যমে ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (১৬ শতাংশ) সহায়তা দিচ্ছে। আর পাকিস্তান সরকার তাদের বস্ত্র খাতে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ২০০৯-২০১০ বছরে ৯৭৫ কোটি রূপি ব্যয় করা হয়েছে। কারাচি, লাহোর ও ফয়সালাবাদে তিনটি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে”। সুতরাং, আমাদের আশেপাশের দেশগুলো যেখানে করেক বছরব্যপি পরিকল্পনা নিচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশ পরিকল্পনা তো দূর যেনো নির্ভরশীলতায় ও অদূরদর্শীতায় নিমজ্জিত।
পরিশেষে, আমরা অনেক সময়ই ভারতীয় চ্যানেলের একপেশে চাকচিক্য দেখে তাদের সেই সংস্কৃতি আয়ত্ত্ব করতে চাই এবং সেই আদলের বস্ত্র পরিধান করতে আগ্রহী হই। আর চোখে একবার সেই আদলের মোহ লেগে যাওয়ায় অনেকের কাছেই দেশীয় বুটিক্সের ডিজাইনটাকে মামুলি মনে হয়। তাই চোখ ফিরে মার্কেটের সেই ভারতীয় পণ্যের দিকেই যায়। অন্যদিকে দামও যখন বাজেটের মধ্যে পড়ে যায়- তখন মহানন্দে সেটা কিনে বাসায় আসা হয়। তাই, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বৃহত্তর শক্তির সাথে প্রতিযোগীতায় যেতে বলছি না। কারণ, অসম শক্তির মধ্যে প্রতিযোগীতা হয় না। তবে ভারতের বিপরীতে নিজস্ব বৈশিষ্ট বজায় রাখতে, বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে পরিকল্পনার প্রয়োজন আছে। দেশীয় পণ্যের মান-প্রচারণা বৃদ্ধি, বাজার মূল্য জনগণের নাগালের মধ্যে রেখে বিদেশী পণ্যের চেয়ে কমে নামিয়ে আনা, ট্যাক্স কমানো, অপরদিকে বিদেশী পণ্যে ট্যাক্স বাড়ানো, তাদের অবাধ অনুপ্রবেশ ও প্রচারণা রুখে দেয়াসহ কয়েক বছরের পরিকল্পনা দরকার। তবেই আশা করা যায়- জনগণও দেশীয় পণ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়বে।
বিষয়: বিবিধ
১১০১ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন