"আমাকে শয়তান বলে গালি দেয়"
লিখেছেন লিখেছেন FM97 ১২ জুলাই, ২০১৩, ১২:২০:০৫ দুপুর
৯ জুলাই এক দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটি পড়ে বেশ দুঃখ অনুভব করলাম। শিরোনাম ছিলো-“নকলের সুযোগ না পেয়ে ঢাকা কলেজের অধ্যাপক লাঞ্ছিত”। সেই স্যারটি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোঃ আলাউদ্দিন সরকার। আলাউদ্দিন স্যারের নাম শুনে উনার চেহারা চোখে ভেসে উঠলো। কিছুটা খাটো, মুখে দাঁড়ি, চোখে চশমা। স্যার, ঢাকা কলেজে ট্রান্সফার হওয়ার আগে আমাদের ইডেন কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। জানা যায়, ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের নেত্রী ঢাকা কলেজ কেন্দ্রে নকল নিয়ে এসেছিল। পরে স্যার তার হাতে নকল দেখে তা কেড়ে নেন, এতে সেই নেত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে পরে বিষয়টি ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের দুই নেতা সাগর ও রনিকে জানায়। পরে সাগর ও রনি সেই স্যারকে লাঞ্ছিত করে। এদিকে তদন্ত্র কমিটি গঠন করে সেই দুই ছাত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানা গেলেও আমার মনে হয় না, কিছু হবে। কারণ আমাদের দেশে নিত্য-নতুন অপরাধ হয় তবে সুষ্ঠ বিচার হয় না। আর আমরা এটাও জানি, বেশ করেক মাস আগে নকল ধরতে গিয়ে এক শিক্ষককে প্রাণও দিতে হয়েছিলো, যার বিচার আজও হয়নি। তাহলে কি করে মেনে নেই যে এই লাঞ্ছনার বিচার হবে?
মনে পড়ে, আমি যখন প্রথম ইডেন কলেজে ভর্তির পর বিষয় সিলেক্ট করতে যাই- তখন দেখলাম যেসব বিষয়ে সিট খালি নেই তার একটা লিস্ট ব্ল্যাক বোর্ডে বড় করে লেখা। তার মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানের নামটিও ছিলো (পদার্থবিজ্ঞান- সিট খালি নেই)। এদিকে যেসব বিষয়ে সিট খালি ছিলো সেগুলোতে আমার পড়ার ইচ্ছা ছিলো না। সেদিন শিক্ষকদের সারিতে যারা বসে ছিলেন, তার মধ্যে আলাউদ্দিন স্যারও ছিলেন। স্যাররা এক এক করে সবাইকে ডাকছেন আর শিক্ষার্থীর পছন্দমত বিষয় দিয়ে নাম অন্তর্ভুক্ত করছেন। এবার আমার পালা। ডাক পড়তেই স্যারদের সামনে গেলাম। আলাউদ্দিন স্যার বললেন- (তিনি যে পদার্থবিজ্ঞানের স্যার , তা আমার জানা ছিলো না)- “কোনটা নিবা”? আমি বললাম- “স্যার পদার্থবিজ্ঞান নিবো”। স্যার- (একটু ধমকের সাথে) এই মেয়ে, তুমি কি দেখো না, বোর্ডে লেখা আছে, ফিজিক্সে সিট খালি নেই, তাহলে কি করে দিবো”? ইচ্ছা ছিলো ফিজিক্স নেয়ার, অন্য কোনো অপশান ছিলো না, তাই নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। স্যার বললেন-“আচ্ছা, দেখি, তোমার মার্কশিট দেখাও…….”। মার্কশিটে দেখলো ফিজিক্সে A+ । তখন স্যার একটু নরম সুরে আরেক স্যারকে বললো- “স্যার মেয়েটার তো রেজাল্ট ভালো, নিয়ে নিই”। তখন অন্য স্যার বললেন—“কি বলেন আপনে? সিট নাই, কেমনে নিবেন”? তখন আলাউদ্দিন স্যার বললেন- “থাক, মেয়েটা চাচ্ছে, দিয়ে দিই। ওই একটা দুইটা বেশি হলে কিছু হয় না……”। এই বলে সিলেক্টেড কপিটা আমাকে দিয়ে বললেন- “যাও তোমাকে ফিজিক্সই দিলাম”। ১ম ও ২য় বর্ষে স্যারের ক্লাস পেলেও পরবর্তীতে তিনি ঢাকা কলেজে ট্রান্সফার হয়ে যান। অনেক দিন পর স্যারের নাম দেখে আমার ফিজিক্সের জগতে ঢুকার স্মৃতি মনে পড়লো। আফসোস! একটা অন্যায় করতে না দেয়ায় আজ তিনি শিক্ষার্থী দ্বারা লাঞ্ছিত।
পরীক্ষা হলে দেখাদেখি বা নকল করা এক দিকে যেমন দূর্নীতি তেমননি মহাপাপ। পাপটা যেন নিজের জীবনের সাথেই করে চলা। কারণ, আমরা সবাই জানি- পরীক্ষা হচ্ছে নিজেকে যাচাই করার জায়গা। অন্যের খাতা যদি দেখেই পরীক্ষায় লেখি তবে আমাদের মেধার পরীক্ষা হলো কোথায়? জানি, এসব নীতি-নৈতিকতার কথা মানুষ শুনতে চায় না, কারণ আমাদের দেশের পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষার হলে দেখাদেখি কিংবা নকল করা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পরীক্ষা শুরুর আগে তার ফ্রেন্ডকে বলে রাখে-‘এই, আমাকে দেখাইস’। এদিকে বড়ই হাস্যকর বিষয় হলো, কোনো বন্ধু যদি তার খাতা দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করে- তাহলে আবার দুই বন্ধুর মধ্যে মনোমালিণ্যেরও সৃষ্টি হয়। আর পরীক্ষার হলে যদি প্রশ্ন কঠিন কিংবা কড়া গার্ডের কারণে যদি দেখাদেখির সুযোগ না হয় তাহলে তো কথায়ই নেই, পরীক্ষার্থীরা নিজের অপারগতা অনূভব না করে উল্টো পরিদর্শককেই দূষে। সম্প্রতি মাস্টার্স পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমার পাশে সিট পড়ে সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থীর। তাদের প্রশ্নপত্র বেশ কঠিন হওয়ায় মেয়েটি প্রশ্নকর্তা স্যারকে গালমন্দ করা শুরু করে। আর আগে পিছে যতভাবে পারে দেখাদেখি শুরু করে। এদিকে গার্ড দেয়া ম্যাডাম যখনই তাদেরকে শাসাচ্ছে, তখনই বিড় বিড় করে সেই ম্যাডামকেই বকা দিচ্ছে। এই হলো শিক্ষার্থীদের অবস্থা, যারা তাদেরকে বিদ্যা শিক্ষা দেয়- তাদেরকেই গালমন্দ করে।
এদিকে আমাদের দেশে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা শুধু রেজাল্ট ভালো করার জন্য পড়ে, জানার জন্য পড়ে না। তাই তারা সব সময় সেই চিন্তায় থাকে কি করে কম পড়ে প্রাতিষ্ঠানিক গন্ডি পাড় করা যায়। তাই পড়াশুনাও মেপে মেপে হয়। এদিকে প্রশ্নপত্রে খানিকটা এদিক সেদিক করে প্রশ্ন দিলে, কিংবা নিজের জানার বাইরে প্রশ্ন দেখলে-তার উত্তর দিতে গিয়ে আমরা আশেপাশে সহায়তা খুঁজি। আবার লিখতে গিয়ে হয়ত ভুলে গেলাম, তখনই ভাবি-‘ওহ! আটকে গেছি, যাই ওকে একটু জিজ্ঞাস করি’। ফলে পাশের ফ্রেন্ড এর খাতা দেখি। হতে পারে এতে ফলাফল সন্তোষজনক চলে আসলো। আর আমরা রেজাল্ট দেখে মহাখুশি। তবে আমাদের মনে রাখা উচিত, প্রাতিষ্ঠানিক গন্ডি পেরিয়ে আমরা যেখানেই যাই না কেনো- সব জায়গাতেই শুধু রেজাল্ট দেখা হয় না, বরং আমাদের মেধা যাচাই করা হয় মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে। আর মৌখিক পরীক্ষায় নিশ্চয়ই আমাদের কোনো ফ্রেন্ড কানে এসে বলে যাবে না। তাহলে বলতেই হয়- ভালো রেজাল্ট করার জন্য এত দূর এসে আটকিয়ে গিয়ে লাভ কি হলো? এখন অনেকে বলতে পারে-‘মৌখিক পরীক্ষাতে খারাপ হলেও সমস্যা নেই- আজকাল তো সব জায়গায়ই দূর্নীতি, চাচা-মামা ধরে সুপারিশ করে টিকে যাবো’। আসলে আমাদের মধ্যাকার এমন মানসিকতার লোকদের জন্যই দেশ দূর্নীতিতে শীর্ষে। আজ অন্যের খাতা দেখে লিখতে আমাদের খারাপ লাগে না, পরবর্তীতে অন্যেরটা মেরে খেতেও আমাদের বিবেকে বাঁধবে না। তখন আমরাই বলবো-‘যেমন দেশ, তেমন বেশ। এমন না করলে চলা যাবে না’। অথচ সত্য হচ্ছে, দেশটা গিলে খেয়ে আর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছি স্বয়ং আমরাই। অভ্যাস ছোট বেলা থেকেই গড়ে উঠে। আজ যে পরীক্ষার্থী অন্যের খাতা দেখে লিখছে, কিংবা পরিদর্শকের চোখ ফাঁকি দিয়ে নকল করছে, শিক্ষক যাতে না বুঝে তাই নিজের হাতের ওপর লিখে নিয়ে আসছে আর নকল ধরলেই উল্টো নিজের দোষ স্বীকার না করে শিক্ষকের উপর আক্রমণ করছে- এমন পরীক্ষার্থীদের দিয়ে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত আশা করা যায় না। বরং তারা আজকের দূর্নীতিকে আগামীতে বড় বড় দূর্নীতিতে রূপ দেবে।
এক স্যার ক্লাস নিতে গিয়ে বেশ দূঃখ প্রকাশ করে বলেন-“পরীক্ষা শেষের দশ মিনিট আগে এক মেয়ে প্রচন্ড দেখাদেখি করছিলো- যার কারণে আমি তার খাতা না নিয়ে পারলাম না। তার খাতা নিয়ে নেয়ায়-আমাকে শয়তান বলে গালি দেয়। আমি অবাক হয়ে যাই, আমি তার শিক্ষক আর সে আমাকে গালি দিলো! মানুষ কি কখনো শয়তান হয়”? তাই বলতে হয়- দিন দিন আমাদের শিষ্ঠাচার ও শালীনতার মাত্রা যেমন কমে যাচ্ছে তেমনি আমরা অন্যায়কে ন্যায় ভাবা শুরু করেছি। ভাবছি- এটাই তো ফ্যাশন, এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু নকল নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, তাই বলবো- আমাদের উচিত নিজেদের স্বার্থে নিজেকে যাচাই করা। স্যাররা আমাদের গুরুজন। তারা আমাদের অন্যায় করা থেকে রক্ষা করেন আমাদের স্বার্থে, এতে তাদের কোনো লাভ বা ক্ষতি নেই। এই ব্যাপারটাই আমাদের বুঝতে হবে। মেধা যাচাই করার জন্য নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছোট ছোট ক্লাস টেস্টে না দেখে লেখার অভ্যাস গড়তে হবে। যাতে ভুলে যাওয়া কিংবা কম পড়ে আসার অভ্যাসে সেসব টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টে খারাপ আসলেও নিজেকে যাচাই করে শুধরে নেয়ার সুযোগটা আমরা পাই। কিন্তু দেখাদেখি বা নকল করে দূর্নীতির ধারা অব্যাহত রেখে আমরা কি আগামী দিনে নিজেকে ‘দূর্নীতিবাজ’ হওয়ার পথে ঠেলে দিচ্ছে না? আশাকরি, আমরা শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের অসম্মান ও নিজেদের অন্যায় পথ থেকে দূরে রাখবো।
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন