এক্ষেত্রে নারীরা সচেতন না হলে করার কিছু নেই-

লিখেছেন লিখেছেন FM97 ০৮ মে, ২০১৩, ০৫:৪৫:১২ বিকাল



একটি সরিষার তেলের বিজ্ঞাপনে বৃষ্টি হয়তো প্রাসঙ্গিক। কিন্তু বৃষ্টিতে যে মেয়ে মডেলটি সাদা জর্জেটের শাড়ি পরে ভিজল সেটি কতটা প্রাসঙ্গিক? যিনি বিজ্ঞাপনটি তৈরি করলেন তার হয়তো এই বোধই নেই যে, সরিষার তেলের সাথে নারীর শরীরের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু যিনি মডেল হিসেবে এলেন তিনি কি ভেবে দেখেছেন কথাটি?

অথবা হয়তো দেখানো হচ্ছে নতুন বউ ও স্বামী ঘুরতে যাচ্ছে ট্রেনে করে। স্ত্রী আমলকী খেতে চাইলে স্বামী ট্রেন থেকে নেমে আমলকী কিনতে যায়। এমন সময় ট্রেন ছেড়ে দেয়। স্বামী আমলকী নিয়ে ট্রেনের পেছনে ছুটতে থাকে। এক সময় স্ত্রী ছুটন্ত স্বামীর হাত থেকে শুধু আমলকীর প্যাকেটটি নিয়ে নেয়। ট্রেনে উঠতে পারে না স্বামী। স্ত্রী দাঁড়িয়ে থাকা স্বামীর কাছে রাগান্বিতভাবে চিৎকার করে জানতে চায়, ‘লবণ কোথায়’? আসলেই একজন নারী এমন? তাহলে কি চিরাচরিত নারীর অবয়ব মমতাময়তা এখন আমাদের সমাজ থেকে বিতাড়িত? নাকি আমরা নিজেরাই চেষ্টা করছি নারীর মধ্য থেকে মমতাকে তাড়িয়ে দিয়ে নিষ্ঠুরতাকে প্রতিস্থাপন করতে? পাঠক আপনি যদি একজন নারী হয়ে থাকেন, একটু ভেবে দেখুন তো আপনি আপনার আপনজনের ক্ষেত্রে এমনটি করবেন কি না? অবশ্যই না। কিন্তু আমাদের নারীকে আজকাল এভাবেই চিত্রায়িত করা হচ্ছে বিজ্ঞাপনে। হয় আমরা নারীকে ব্যবহার করছি সরাসরি পণ্য হিসেবে। অথবা এমনভাবে নারীকে উপস্থাপন করছি যে, যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

হয় ভেজা শাড়িতে নারীর শরীরকে পণ্য হিসেবে দেখাচ্ছি অথবা একটি সাবান মেখে একজন নারী হয়ে উঠছে ‘সোনার চেয়েও অপরূপা’ কিংবা নারী মানেই হলো স্বার্থপর নিষ্ঠুর একটি চরিত্র। আসলেই কি তাই? আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে আমরা বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞাপনধারাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি। বিশেষ করে ভারতীয় অপসংস্কৃতির ধারাই নারীদের মানসিক এই বিকার হওয়ার অন্যতম কারণ। ভারতীয় একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখা যায়, বডিস্প্রে'র ঘ্রাণে মোহিত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নারীরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সেই ছেলেটির বাড়িতে এসে হাজির হচ্ছে অথবা তার পেছনে ছুটছে। আর ছেলেটি প্রাণ বাঁচানোর চিন্তায় বিহ্বল কিংবা সেও ছুটে পালাচ্ছে। আসলেই কি একটি বডিস্প্রে সমগ্র নারী জাতিকে এতটা উত্তেজিত করার মতা রাখে? রাখে না। তারপরও নারীকে এখানে উপস্থাপন করা হলো কামুক হিসেবে

এক দিকে আমরা নারীরা নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন নিয়ে ভীষণ সচেতন। সভা-সেমিনারে অপছন্দের বিধি-বিধানের তীব্র সমালোচক। অন্য দিকে আমরা নারীরাই নারীদের চিত্রায়িত করছি নিষ্ঠুর-অশ্লীলভাবে। সচেতনতা আনা প্রয়োজন নিজস্বতায়। স্বকীয়তায়। যিনি বিজ্ঞাপনটিকে চিত্রায়িত করছেন শুধু টাকার জন্য নিজেকে যদি তিনি এমনভাবে উপস্থাপন করেন, বিজ্ঞাপন প্রস্তুতকারকের দোষ কতটুকু? একটি বিষয় অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। নারী মাত্রই সুন্দর। কিন্তু সে শুধু সৌন্দর্যগুণে গুণমণ্ডিত নয়। অপ্রত্যাশিত কোনো বিষয় উপস্থাপনের জন্য নারীকে নিষ্ঠুর হিসেবেই কেন দেখাতে হবে? বডিস্প্রেটি একজন ছেলের জন্য কেন প্রয়োজন তা জানানোর জন্য মেয়েদেরকে কেন অশ্লীল বানাতে হবে? কেন আমাদের গ্রহণ করতে হবে অপসংস্কৃতি?

অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের শিল্পগুলো নারীর সামনে স্বাধীনতার মুলা ঝুলিয়ে তাদের বানিয়ে দিচ্ছে পণ্য। আর আমরা নারীরাও সেই মুলার পেছনে ছুটছি। ভেবে দেখছি না এতে নারী হিসেবে বা মানুষ হিসেবে আমাদের কতটা অপমান করা হলো।

চিত্রগ্রাহক মোমেনা জলিলের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন। তার মতে, ‘মিডিয়া খুব স্বার্থপর একটা জায়গা। সেখানে এত কম্পিটিশন যে আপনাকে টিকে থাকতে হলে নির্মাতা বা অর্থদাতার ওপর অনেকখানি নির্ভর করতে হবে। আমাদের ব্যক্তিগত অভিমত হয়তো একজন নারীকে এভাবে চিত্রায়িত করার বিপরীতে কিন্তু পণ্যের প্রচারণা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়। এবং একটি বিষয় তো আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এসব বিজ্ঞাপন আমরা অপছন্দ করলেও সংশ্লিষ্ট পণ্য ক্রয় কিন্তু আমরা বর্জন করছি না। তাহলে বলতেই হবে যে, বিজ্ঞাপন চিত্রটি ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে হলেও আমাদের মনে দাগ কাটতে সম হয়েছে।

আবার অনেক ক্ষেত্রে হয়তো আপনি বলে থাকবেন, যে মেয়েটি এই ধরনের বিজ্ঞাপন চিত্রায়িত করছে সে হয়তো এই বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত না। এর একটি কারণ হতে পারে মিডিয়াতে তার দাঁড়াতে হলে প্রাথমিক অবস্থায় এ ধরনের বিজ্ঞাপনই হয়তো তার দাঁড়ানোর মাধ্যম। আবার আর একটি কারণ বলা যায়, যারা এ ধরনের বিজ্ঞাপন করছে তারা ভাবছেই না যে, তারা নারী জাতির প্রতিনিধি। আমাদের দেশে শতকরা ৯৫ জন মেয়েই কিন্তু তার নিজ গৃহে স্বাধীন নয়। ফলে কোনো মায়ের কন্যা যদি কালো হয়, হয়তো বাড়ির শাশুড়িও মা-মেয়েকে কটা করবেন। অর্থাৎ আমাদের মেন্টাল সেটআপটাই হয়ে গেছে সুন্দর মানেই ফর্সা। ফলে বিজ্ঞাপনে যখন সাবান মেখে সোনার চেয়ে অপরূপা হয়ে যায় তখন সেটা এই নারীদের মনে কিছুটা হলেও দাগ কাটবে। সামাজিক এই অবস্থার বিরুদ্ধে কিভাবে আপনি রুখে দাঁড়াবেন?

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের কমপে আরো দু-তিন জেনারেশন লাগবে। যারা নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করবে না এবং যারা তাদের বর্জন করবে। এই পরিস্থিতি কি এই মুহূর্তে তৈরি করা সম্ভব? আমাদের যে সোস্যাল মুভমেন্ট প্রয়োজন সেটা করার মতো কোনো সংগঠন কি আমাদের আছে? আমাদের দেশে মেয়েরা এখন অনেক বেশি সিরিয়াল দেখে। সেসব সিরিয়ালে নারীরা যে পোশাকে থাকে বা যে মেকআপ নেয়, তারা তা দেখে প্রভাবিত হবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে শুধু নির্মাতা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নয়, সবাইকে নিজ নিজ মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। ’

নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতারের মতে, ‘বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তো চাইবেই নারী এবং পণ্যকে এক করে দেখাতে। সেখানে একজন নারীর বিবেচনাই বড়। যে মেয়েটি এ ধরনের বিজ্ঞাপনচিত্রে অংশ নিতে নিজের স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্যতা জলাঞ্জলি দেয় আমি মনে করি দোষটা অনেকাংশে তার। কারণ মেয়েটি একই সাথে সমগ্র নারী জাতিকে উপস্থাপন করছে। সে এতটা নির্বোধ নয় যে বুঝবে না, তাকে এই চিত্রটিতে কিভাবে উপস্থাপন করা হলো। একইভাবে বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের অনেকেই নারী। তারা এমন বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করবেন কেন যাতে নারীকে হেয় করা হচ্ছে?’

বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নারীকে হয় দেখাচ্ছে পণ্য হিসেবে অথবা নিষ্ঠুর কিংবা তাদের ইচ্ছামতো করে। অর্থাৎ এখানে দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বিবেচনা করে নারীকে প্রকাশ করা হচ্ছে বিজ্ঞাপন নির্মাতার ইচ্ছামতো। নারীকে এভাবে প্রকাশ না করার েেত্র সরকারের একটি সুষ্ঠু নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। এই নীতিমালায় জেন্ডার সেনসেটিভিটির বিষয়টি অবশ্যই আসতে হবে। এবং একইসাথে বিজ্ঞাপন নির্মাতারাও যদি এ ধরনের কোনো নীতিমালা গ্রহণ করে, নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না তাহলে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হবে তাদের নীতি বদলাতে। এই নীতিমালা যদি মিডিয়াগুলোও পালন করে তাহলে নারীকে এসব অদ্ভুত রূপ উপস্থাপন করা কোনোভাবেই সম্ভব না।

প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের প্রচার করবেই। কিন্তু সবাই একযোগে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে শুধু প্রতিষ্ঠানগুলো কত দিন তাদের বিজ্ঞাপন না দিয়ে থাকতে পারবে? ফলে তারা তাদের নীতি বদলাতে বাধ্য হবে। তবে এসবের ওপর যে শক্তি সবচেয়ে বড় তা হলো ভোক্তা। তারা এ ধরনের বিজ্ঞাপনের পণ্য যদি বর্জন করে তাহলেও নারীর এই অযাচিত বা অপ্রাসঙ্গিক উপস্থাপন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

আবার যিনি এই ধরনের বিজ্ঞাপনচিত্রটিকে চিত্রায়িত করছেন, তিনি কেন একজন নারী হয়ে এ ধরনের বিজ্ঞাপন চিত্রে অংশ নেবেন। এখানে নিজের স্বকীয়তা বিকিয়ে ক্যারিয়ার গড়া কতটা যুক্তিযুক্ত? এক দিকে তিনি নিজের স্বকীয়তা নষ্ট করছেন, অন্য দিকে নারী জাতিকে অপমান করছেন। এদের প্রতি সহানুভূতির কোনো অবকাশ নেই।

এসব ক্ষেত্রে পরিবারও বেশ নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। যেমন- একজন মা তার সন্তানকে গান শেখাবেন। তিনি তাকে মৌলিক গান শেখানোর বদলে যেসব গান নেচে-গেয়ে নিজেকে উপস্থাপন করা হয় সেগুলো বেশি শেখাচ্ছেন। শিশুটির হয়তো সেই বোধ নেই। কিন্তু মায়ের বা পরিবারের আছে। ফলে আমাদের প্রত্যেকের মানসিক সেটআপ প্রয়োজন। আমার সন্তান নিজেকে উপস্থাপন করবে তার স্বকীয়তায়, স্বাতন্ত্র্যে, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শরীর প্রদর্শন করে নয়। আমরা নারীর স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছি। নারীকে মানুষ বানাতে চাইছি। কিন্তু নারীকে বানিয়ে রাখছি আমাদের ইচ্ছার দাস হিসেবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, কৃত্রিমভাবে নয়, ওপরে উঠতে হয় নিজের জ্ঞান ও বিবেচনা দিয়ে।

সংগৃহীত

বিষয়: বিবিধ

১৪১২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File