সাগরের মৃত্যুফাঁদ: রিপ কারেন্ট বা উলটো স্রোত
লিখেছেন লিখেছেন টালের পাখা ১৭ এপ্রিল, ২০১৪, ০৫:৩৪:৪৪ বিকাল
সংগৃহীত: bdlive24.com (বৃহস্পতিবার এপ্রিল ১৭, ২০১৪, ০৪:০০ পিএম.)
আহসানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রের মৃত্যুর পর "রিপ কারেন্ট" (উল্টা/প্রতি খরস্রোত) নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। এটা কিন্তু শুধু সেন্ট মার্টিন দ্বীপের একার কোন সমস্যা নয়। সারা বিশ্বেই এই সমস্যা দেখা যায়।
একটি সতর্কতামুলক খবর ছড়ানো হচ্ছে যে, দ্বীপের কোণায় রিপ কারেন্ট থাকে। কিন্তু এমন কোন কথা নেই। ফ্ল্যাট বিচেও এটি হতে পারে। যেকোনো জায়গায় গভীর লম্বা (সৈকতের সাথে সমকোণে) খাঁজ থাকলে আর পাশে অগভীর সৈকত থাকলে, রিপ কারেন্ট হতে পারে।
পাইপের মুখে চেপে ধরলে যেমন পানির জোর বেড়ে যায়। পানিগুলো উল্টা দিকে খুব চিকন রাস্তা দিয়ে আসার জন্য অনেক দ্রুত বেগে সমুদ্রের দিকে পানির স্রোত বইতে থাকে। আর তাই, ওখানে পড়ে গেলে আপনাকে সে তার গলা পর্যন্ত দ্রুত টেনে নিয়ে যাবে।
আবার রিপ কারেন্ট যে একি জায়গায় স্থির থাকবে, এটাও ঠিক না। বালুময় সৈকতে, যেকোনো স্থানের বালু সরে গিয়ে লম্বা খাঁজ তৈরি হতে পারে। আর এই খাঁজের পানির স্রোত উল্টা দিকে থাকে, আর পানিও নীলচে-শান্ত দেখায়। যা আপাত দৃষ্টিতে সাঁতারের জন্য খুবই লোভনীয় মনে হয়।
অতএব সাগরে গিয়ে পরিষ্কার স্রোতহীন কোন জায়গা দেখলে খুব সাবধান থাকতে হবে। তারচেয়ে সাদা পানির স্রোত অনেক নিরাপদ। এই ভিডিও দেখেলে কিছুটা ক্লিয়ার হবেন পাঠকরা। একটা ভালো পরামর্শ হল, আতঙ্কিত না হয়ে, পাশে কোথায় সাদা পানির ঢেউ দেখা যাচ্ছে, সেদিকে সাঁতরিয়ে যান। সামনের দিকে না। শুধু শুধু শক্তি অপচয় হবে, কারন রিপ কারেন্টের গতি, যে কোন অলিম্পিক সাতারু থেকেও বেশি।
সাদা পানির দিকে গিয়ে গা ভাসিয়ে রাখলে আপনি এমনিতেই নিজে নিজে পাড়ে চলে আসবেন। রিপ কারেন্টের জায়গা খুব চিকন হয়। তাই বিপরীতে সাতার কাটা খুবই বোকামি।
বাংলাদেশের সাথে পৃথিবীর অন্য সৈকতের মানুষ মারা যাওয়ার একটা পার্থক্য হল, ভাটার সময় কোন দেশের বিচে আপনাকে নামতেই দিবেনা। কিন্তু, বাংলাদেশে অনেক মানুষ, ভাটার সময় পানিতে নেমে ভেসে যায়, এই অজ্ঞানতার কারণে অনেক জীবন বিনষ্ট হচ্ছে।
সমুদ্র সৈকতে ৮০% মৃত্যু এই রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোতের জন্যে হয়। এমনকি অস্ট্রেলিয়াতেও প্রতি বছর গড়ে ২২ জন মারা যায় রিপ কারেন্টের কারণে।
আমাদের দেশেও সমুদ্র সৈকতে যেই সব মৃত্যু হয়, তার বেশীর ভাগ এই রিপ কারেন্টের জন্যেই হওয়ার কথা। এবং
সেন্ট মার্টিনের মাথার দিকে যে সরু অংশ তাও রিপ কারেন্টের একটা বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে।
রিপ কারেনট বা উলটো স্রোত কি জিনিষ?
এইটা এক ধরনের ঢেউ যা সমুদ্রের তটে ধাক্কা খেয়ে, উলটো দিকে প্রবাহিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে, এই ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাওয়া ঢেউ বাতাস বা প্রাকৃতিক বিশিষ্টের কারণে চিকন একটা পথ ধরে, একটা ধাক্কা দিয়ে সমুদ্রে ফিরে যেতে পারে। এবং এর ফলে সেই সরু পথে যদি কেউ থাকে তবে তাকে ধাক্কা দিয়ে গভীর সমুদ্রে নিয়ে ফেলতে পারে। এই সরু পথের যে ঢেউটাকেই বলে রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোত।
এইটা যে কোন স্থানে হতে পারে। যে কোন সমুদ্রে হতে পারে, কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় প্রাকৃতিক বিশিষ্টের কারণে নিয়মিত রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোত হতে পারে।
কিভাবে রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোত চিনবেন?
রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোতের একটা ভয়ঙ্কর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এইটা দেখতে মনে হয় খুব শান্ত। এবং উপর থেকে একে গাঢ় নীল দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোতের সময়ে দেখবেন কিছু না কিছু ভেসে সৈকতে না এসে সাগরের দিকে যাচ্ছে বা আসে পাশের ঢেউ এর মধ্যে ঢেউ এর মাথা দেখা যাচ্ছে না।
রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোতে পড়লে কী করবেন?
যারা সাতার জানেন তারা রিপ কারেন্টে পড়লে, উলটো দিকে তীরের দিকে না গিয়ে সৈকতের সমান্তরাল ভাবে উলটো স্রোত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, সাগরের স্রোত যখন টান দিবে তখন শক্তি দিয়ে স্রোতের বিপরীতে ফেরা যাবেনা।
কয় ধরনের রিপ কারেন্ট আছে?
তিন ধরনের রিপ কারেন্ট আছে। একটা ফিক্সড আর একটা হটাৎ আর একটা হেড ল্যান্ড। ফিক্সড টা হয় কিছু কিছু এলাকায় যেমন যেই খানে ব্রিজ আছে, যেই খানে কোন গভির গর্ত আছে। হঠাৎ যেটা হয়, সেটা যে কোন জায়গায় বাতাসের কারণে হতে পারে।
আর হেড ল্যান্ড যেটা আছে, আমাদের সেন্ট মার্টিনের দ্বীপের একটা অংশে। এইটা রিপ কারেন্ট হওয়ার জন্যে টিপিকাল জায়গা।
সেন্ট মার্টিনের এই অংশটা একটা হেড ল্যান্ড বিশিষ্টের এলাকা, যেখানে রিপ কারেন্ট ঘন ঘন হবে প্রাকৃতিক বৈশিষ্টের কারণে। কারণ বাতাসের কারণে দুই দিকের পানি ধাক্কা দিয়ে এর মাথায় একটা রিপ কারেন্ট তৈরি করতে পারে। এটা একটা মৃত্যু ফাঁদ। এখানে প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে অনেক বড় বড় চ্যানেল তৈরি হয়েছে, যেগুলো দিয়ে ঘন ঘন উলটো স্রোত বা রিপ কারেন্ট প্রবাহিত হয়। এবং শান্ত পানি দেখে নামা পর্যটকদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
সেন্ট মার্টিনের এলাকাবাসী জানে এই এলাকায় সাতার কাটতে নেই। তাই সামনে কাউকে দেখলে এরা মানা করে। কিন্তু সেটা সবাই জানার সুযোগ হয় না। এভাবেই সামান্য অসাবধানতার কারণে অনেক পর্যটক মারা যায়।
আহসানুল্লাহ ইউনিভার্সিটির যে ছাত্ররা মারা গেলো, তারা খুব সম্ভব এই এলাকায় ফিক্সড মাস্ট হেড রিপ কারেন্টের কারণেই পানিতে ভেসে গেছে। প্রতি বছর এই এলাকায় অনেকেই ভেসে যায়। বাংলাদেশে এতো বছরে ধরে এই এলাকায় এতো মানুষ মারা গেল, এলাকার লোক জানে যেটার কথা সেই জায়গায় কেন সাঁতার নিষিদ্ধ করছেনা ? এবং জনসচেতনতা সৃষ্টি করছেনা। সেই প্রশ্ন আজ সবাইকে ভাবতে হবে।
রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোত যেকোন সৈকতে হতে পারে। এবং শান্ত অংশ যেখানে মনে হবে, সেখানেই এইটা বেশী দেখা যায়। ফলে এই ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৯০৯ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ।
বন্ধু বান্ধব একসাথে থাকলে অনেক সাঁতার না জানা পোলাপান বীরত্ব দেখানোর জন্য জোয়ার ভাটা বিবেচনা না করে পানিতে নেমে পড়ে ।
ভাটার সময় লাবনী/কলাতলী বীচে পুলিশ চলে আসে ভরা মৌসুমে । তবুও সামলানো যায় না.
সেন্ট মার্টিনের বিচগুলো কক্সবাজারের চেয়ে বেশী অরক্ষিত । দ্বীপের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের বাই রোড কমিউনিকেশনও তেমন ভাল না ।
গত বছর ঠিক এই সময়েই ছিলাম কক্স বাজার ও সেন্ট মার্টিনে । সেখানে হাসপাতাল আছে , বিল্ডিংটা দেখতে খুব সুন্দর । খুব কমই সদর হাসপাতাল আছে ইনল্যান্ডে এরকম দর্শনীয় ।
তবে দূর্ভাগ্যের বিষয় এই হাসপাতালে কোন ডাক্তার , নার্স কেউই নেই । কোন রোগীও নেই । খালি একজন গ্রাম্য ডাক্তার আছে সে এখানে থাকে । অফিস ডে তেও চিকিতসার সাথে জড়িত কোন জনমানব সেখানে দেখা যায় নি ।
এরকম ক্রাইসিস মোমেন্টে সাগর পাড়ি দিয়ে টেকনাফে আসতে আসতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় ।
সবসময়ই লাভ করার চিন্তা মাথায় থাকলে চলে না । লাভ করার জন্য যে ইনফ্রা স্ট্রাকচার দরকার সেটা বোঝার মত ব্রেইন অন্তত বাংলাদেশের এসব ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট লোকদের নেই ।
ফলে এ সিলসিলা চলতেই থাকবে ।
এ পোস্ট কি স্টিকি করা যায় প্রিয় মডারেটর?
মন্তব্য করতে লগইন করুন