বাবুল ভাইয়ের বায়োমেট্রিক ভাবনা
লিখেছেন লিখেছেন আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ ১০ মার্চ, ২০১৭, ০৮:৫৪:১৬ রাত
কাগজের টুকরাটা বাড়িয়ে দিয়ে মোটকা লোকটি বললেন, 'এগুলো দেন তো'।
অংক খাতার ছেড়া পেইজ। কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম, দুইটা ওষুধের নাম লেখা আছে। ইংরেজিতে। ঘাড়টাকে একটু বাঁকা করে জানতে চাইলাম, 'কার জন্য এগুলো?'
'আমার মেয়ের জন্য। আমার মেয়ে পড়ালেখা জানে।'
শেষের বাক্যটা বলার পর ওনার চেহারায় দেখলাম এক ধরনের প্রফুল্লতা। যেন আমার মেয়ে শিক্ষিত। আমি শিক্ষিত মেয়ের বাবা।
এই গল্পটা মোটেও ইন্টারেস্টিং নয়। এখানে হুমায়ুনের মতো কাহিনীর ভেল্কিবাজি কিংবা শরতের মতো কথার জাদু নেই। তবু গল্পটা আমাদের জানা জরুরী।
এই ফার্মেসিতে কাজ করছি প্রায় সাত মাস। আমি, বাবুল ভাই এবং টিপু। তিনজন কর্মচারী। মালিক এই থাকে, এই থাকে না। মালিক না থাকলে ওনার কাজগুলো বাবুল ভাইকে সমাধা করতে হয়। কারণ দোকানের মালিক বাবুল ভাইয়ের আপন চাচা।
বাবুল ভাই বিএ পাশ। চাকরীর পিছনে না দৌড়ে চাচার সাথে এই ওষুধের ব্যবসায় নেমেছেন এক প্রকার ইচ্ছে করেই। পড়ালেখা করে চাকরী করতে হবে এমন কোন থিউরি ওনার ডায়েরিতে নেই। আমি এখনো অনার্সে পড়ছি। টিউশনির পরিবর্তে ছোট এই চাকরীটি করছি। মানুষের ঘরে গিয়ে ছেলেমেয়ে পড়ানো আমার ভাল্লাগে না। এক কাপ চা, তিনটা বিস্কুট, এক গ্লাস পানি—কেমন যেন। অদ্ভুত। স্টুডেন্টের মায়ের মুখ মুছড়ানো ভাব—অসহ্য এসব। আর টিপু এসএসসি ফেইল। আভ্যন্তরীণ কাজের পাশাপাশি আমাদের জন্য চা-নাস্তা আনার কাজও করে।
নিরাময় ফার্মেসি। এটি এখানকার সবচেয়ে বড় দোকান। লাঞ্চের পরে তেমন একটা কাস্টমার থাকে না। আমরা তখন গলির ভেতরের ছোটখাটো দোকানগুলোর পাইকারি অর্ডার পেকেট করে রাখি। নয়তো পত্রিকার অলিগলি চষে বেড়াই। আমি খেলাধুলার পেইজটা নিলেও বাবুল ভাই কলামে ডুবে থাকেন। কখনো মোবাইল গেমস আর ফেইসবুকিং হয়ে ওঠে আমার টাইম পাসের উপলক্ষ। আর টিপু ইয়ার ফোন লাগিয়ে বিভোর থাকে গানে।
ফার্মেসিতে কাজ করার ফলে নাফা, সিনামিন, প্রোলকের সাথে আরো কোন কোন ওষুধ নিরবে বেশি চলে সে সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা আছে। এবং এলাকার কোন কোন নারী-পুরুষ এসব ওষুধের নিরব প্রচলন বাড়িয়ে দিয়েছে তাদেরও একটা তালিকা আমরা চিন্তাহীন করে দিতে পারি। কিন্তু দরকার নেই।
ডি-কটের বাক্সটা খুঁজতে খুঁজতে লোকটার কাছে জানতে চাইলাম, 'আপনার মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে?'
'ইন্টারে।'
'কোন কলেজে?'
'মহিলা কলেজে।'
'আপনাদের বাড়ি কি এখানে?'
'হ্যা, এখানে।'
ওষুধ দুটি প্যাকেট করে দিলাম। মূল্য পরিশোধ করে লোকটি চলে গেলো। আমি আবার আগের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। হঠাৎ দেখি প্যান্থারের বাক্সটির দিকে তাকিয়ে বাবুল ভাই পাথর হয়ে আছেন। কাজ থামিয়ে ব্যাপার কী জানতে চাইলাম। 'কিরে ভাই এভাবে কী দেখেন?'
'কনডম!'
টিপু হেসে উঠলো। আমি জানতে চাইলাম, 'কেন? প্রতিদিনই তো দেখছেন, এভাবে ফ্রিজ হয়ে দেখার কী আছে?'
'আছেরে ভাই আছে। অনেক কিছু আছে।'
'কী আছে?'
চেহারায় গবেষক টাইপের ভাব এনে বাবুল ভাই বলতে শুরু করলেন, 'দেখো, এই কনডম যদি আবিষ্কার না হতো আমাদের দেশে কতো মেয়ে যে অকালে গর্ভবতী হতো আর কতো ছেলে যে বিয়ের আগে বাবা হয়ে যেতো, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তখন দেশের জনসংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটি থেকে ২৪ কোটিতে উঠে যেতো। আর কোরিয়ার মতো জনসংখ্যার বিরাট একটা অংশ হয়ে যেতো বিবাহবহির্ভূত সন্তান। সহজ কথায় জারজ।'
'তাহলে এই ব্যাপার! এতো বিষয় থাকতে আপনি হঠাৎ কনডম নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন কেন?'
'কারণ আছে। আগে বলো, একটু আগে মোটা লোকটি যে ওষুধ নিয়ে গেলো সেগুলোর কাজ কী?'
'একটা মোটা হবার জন্য। আরেকটা গর্ভনিরোধক।'
'ওষুধগুলো কার জন্য বলেছিল?'
'ওনার মেয়ের জন্য।'
'ওনার মেয়ে কী জানে বলেছিল?'
'পড়ালেখা।'
'এই এটাই। এটাই আমার গবেষণার মূল কারণ। ওনার মেয়ের পড়ালেখা জানে! কতো পড়ালেখা আমরা শিখছি? একটা মেয়ে কতো পড়ালেখা জানলে একজন বাবাকে এভাবে পড়িয়ে চলতে পারে?
শুধু ওনার মেয়ে না, এই হিন্দি সিনেমার যুগে আরো কতো পড়ালেখা জানা ছেলেমেয়ে প্রতিনিয়ত তাদের বাবা-মাকে পড়িয়ে চলছে তার খবর আর কে রাখে? তাছাড়া এই মোটা লোকটির মতো আমাদের মাথামোটা অভিভাবকরাও তাদের আইনস্টাইন, সক্রেটিসদের ব্যাপারে কতোটা খোঁজ-খবর রাখেন সেটা তারাই ভালো জানে।'
'তাই তো!' বিস্মিত হয়ে আমি রিপ্লাই দিলাম। টিপুকেও দেখছি ইয়ার ফোন খুলে নিথর শ্রোতা হয়ে আছে। জানতে চাইলাম, 'এই বিষয়ের সমাধান আপনি কীভাবে দেখছেন?
ওনি তাৎক্ষণিক বলে উঠলেন, 'বায়োমেট্রিক।'
আচ্ছা, এবার বলো তো, সিম কিনতে গেলে এখন কী করা লাগে?'
আমি বললাম, 'বায়োমেট্রিক।'
'কী কী দিতে হয়?'
'আইডি কার্ডের ফটোকপি আর পাসপোর্ট সাইজের ছবি।'
'হুম সেটাই। কনডম কিংবা গর্ভনিরোধক ওষুধগুলো কিনতে গেলেও যদি বায়োমেট্রিক করা লাগতো, কাবিননামার ফটোকপি দিতে হতো, ইউরোপের কিছু কান্ট্রিতে ফ্যামিলি নিতে চাইলে ভিসা প্রসেসিঙে যেমন স্বামী-স্ত্রীর যুগল ছবি দিতে হয় তেমনি কনডম কিংবা গর্ভনিরোধক ওষুধ কিনতে গেলেও যদি স্বামী-স্ত্রীর ছবি দিতে হতো, আমি নিশ্চিত কনডমের রাজ্যে এমন নিরব বিপ্লব সাধিত হতো না। জাতিও যেনা-ভ্যাবিচারের মতো মারাত্মক একটা পাপ থেকে অনেকটা রক্ষা পেয়ে যেতো।
বাঁচতে হলে জানতে হবে—যত্তোসব ভণ্ডামী।'
বাবুল ভাইয়ের গবেষণায় আমিও খানিকটা নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম। ওনাকে বললাম, 'এতো কিছু না করে, মানুষকে ধর্ম পালনের প্রতি উদ্বোধ্য করলেই তো হয়। যেনা করা মারাত্মক পাপ। কিয়ামতের দিন নির্ঘাত জাহান্নামী। এবার যার ইচ্ছা মানবে, যার ইচ্ছা না মানবে না। ব্যাস।'
'না, সেটা করা যাবে না। ধর্মের কথা বললে তো দুজনেই মৌলবাদী হয়ে যাবো। তাছাড়া আমাদের হুজুররা নিয়মিত সুদ, ঘুষ, যেনা নিয়ে যে হারে ওয়াজ করে চলছেন, তার সুফল আমাদের সমাজে কোথায়?
এ জাতি উপদেশ দিতে খুব পটু, যতো এলার্জি সব উপদেশ মানাতে।
আমি মূলত বলতে চাচ্ছি, কনডম এবং গর্ভনিরোধক ওষুধগুলো বিক্রিতে সরকার কঠোর আইন করুক।
শয়তান এনজিওগুলো যেভাবে এই উপকরণগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে, আমাদের দেশে এখন অবৈধ রিলেশানটা নিরব মহামারী।
কাউকে যদি ভালোর পথে আনতে না পারো তাকে খারাপ হবার উপকরণ যোগান দেবার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?'
আমি মাথা নেড়ে সম্বতি দিলাম।
'থাক গবেষণা লম্বা হয়ে যাচ্ছে। তুমি বরং আলম মেডিকোর ওষুধগুলো পেকেট করে রাখো।' এই বলে বাবুল ভাই আমাকে একটা লিস্ট ধরিয়ে দিলেন।
আমিও আর কথা না বাড়িয়ে কাজে লেগে গেলাম। বাবুল ভাইকে দেখলাম, প্যান্থারের বাক্সটির দিকে তাকিয়ে আবার কনডমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে। না জানি আবার নতুন কোন বিষয় ওনাকে ভাবিয়ে তুলছে।
০৯, ০২, ২০১৭
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ
চট্টগ্রাম।
বিষয়: সাহিত্য
১৫১৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ঔষধের দোকানগুলো লাভই করে এরকম প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঔষধ বিক্রি করে । ক্রেতাদের কাছে তারা ডাক্তার।
এম.বি.বি.এস পড়া + পাশ করা ছাড়াই তারা ভালই ডাক্তারী করে যায়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন