চিঠিতে চিঠির গল্প এবং ডটডট
লিখেছেন লিখেছেন আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ ০৪ অক্টোবর, ২০১৬, ০১:০৮:৪৭ দুপুর
৩০.০৯.১৬
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
প্রিয়...
বন্ধু মতিকে লেখা নজরুলের শেষ চিঠিটি পড়বার পর আমারও একটি চিঠি লিখবার ইচ্ছে জেগেছিল। ভীষণ। কিন্তু সেই ইচ্ছেটা কখন যে, হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মনের গহীনে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো তা আর মনে নেই। চাচ্ছিও না মনে করতে।
নজরুলের সেই চিঠিতে কী লেখা ছিল জানো? আচ্ছা একটু পরে বলছি। তুমি কেমন আছো জানতে না চেয়েই বকবক করতে শুরু করলাম। তুমি তো জানো যে, আমি কথা একটু বেশি বলি। কেমন আছো পরে, আগে আরো কিছু কথা বলে নি।
আচ্ছা, তোমাদের টবের গাছে কি এখনো ফুল ফোটে? আমাকে দেবার জন্য কি কখনো ভুল করে তুমি আর ফুল ছিড়ো না? কখনো ছিড়ে ফেললে সেটা কী করো? জানো একবার তোমার দেওয়া একটা ফুলকে আমি অনেক দিন পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। সেটা শুকিয়ে একেবারে কুৎসিত হয়ে গিয়েছিল। সারি সারি সাজিয়ে রাখা পাতাবাহারের পাতাগুলো কেমন আছে? তারা কি এখনো আগের মতোই সতেজ? নাকি ঝরে গেছে? তারা হয়তোবা আমাকে চিনে না। আমি তাদেরকে খুব চিনি। খুব। এই, একটা কাজ করতে পারবা? কোন এক রাতে চুপিচুপি বের হয়ে তুমি তাদেরকে আমার কথা বলবা। বলবা যে, আমি তাদেরকে খুব ভালোবাসি। খুব। এ কথা শুনলে তারাও হয়তোবা তোমার মতো লজ্জ্বা পাবে। আর মনে মনে হাসবে।
ধুর, কোত্থেকে কোথায় চলে গেলাম। তুমি বৌর ফিল করছো নাতো?
আলিমের বাংলা বইয়ে 'বই কেনা' প্রবন্ধে বারট্রান্ড রাসেলের একটা বাণী পড়েছিলাম— “ সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভেতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয় ”
এই বাণীটা উল্লেখ করে প্রাবন্ধিক বলছেন মনের ভেতরে আপন ভূবন সৃষ্টি করার প্রধান উপায় হচ্ছে বই পড়া। তুমি তো জানো, বই পড়ার হালকা অভ্যাস আমার আছে। কিন্তু 'আপন ভূবন' বিষয়টার সাথে সেই প্রথমই আমি পরিচিত হই। তখন থেকেই শুরু হয় আমার 'আপন ভুবন' গড়ে তুলবার প্রচেষ্টা।
আজ অনেক দিন হয়, বাসায় নতুন কোন বই আসে না। 'আপনার সাথে আর দেখা হবে না' বলে তুমিও অদৃশ্য হয়ে গেলে। আর আসো না। বুকের ভিতরে কতোটা যন্ত্রণা আসন গেড়ে আছে তুমি হয়তোবা তার কিছুটাও অনুভব করতে পারো না। এ বিরহ এতোটা মারাত্মক যে, প্রত্যেকটা মুহূর্তকে উইপোকার মতো দংশন করে। কাউকে বোঝানো যায় না, ভোলাও যায় না। নিরব ঘাতক এ যন্ত্রণা। ভিতরটাকে শেষ করে দেয়। কারো ভিতরটাকে এভাবে ভেঙ্গে দেওয়াতে কোন বীরত্ব নেই জানি কিন্তু অনুশোচনার এক তিল দহনও কি তাতে থাকে না?
আমার কথা কি তোমার মনে পড়ে? আমার স্মৃতিগুলো? হুয়াইট বোর্ডে ব্ল্যাক মার্কার দিয়ে লেখার পর আবার মুছে ফেলোর মতো তোমার কল্পনা থেকে চিরতরে মুছে দিয়েছো? ছোট্ট বেলায় খেলা শেষ হয়ে গেলে দিনশেষে খেলাঘর ভেঙ্গে দিতাম। তচনচ করে দিতাম। তোমার পৃথিবীতে আমার অবস্থান কি এখন সে রকম? লণ্ডভণ্ড খেলাঘরের মতো? শুরু না হতেই তুমি সমাপ্তি এনে দিলে। তোমার কি তবে খেলা শেষ? বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ে তুমি হয়তোবা লন্ডনে চলে যাবে। আমার এই উদ্ভট প্রশ্নগুলোর উত্তর লেখার সময় কখনো কি তোমার হবে না?
বারট্রান্ড রাসেলের কথাকে মেনে নিয়ে সেদিন অনেকগুলো বই কিনে আনলাম। বইয়ের ভিতরে ডুব দিয়ে একটানা অনেক দিন ভালো থাকা যাবে। তোমার হারিয়ে যাবার যন্ত্রণা কিছুটা হলেও তো প্রশমিত হবে।
সেদিন বই কিনতে গেলে তানবীর "একাত্তরের চিঠি" শিরোনামে মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা চিঠির একটা সংকলন কিনবার পরামর্শ দেয়। কিনলামও। সে বলে দিয়েছে রাতের বেলায় ঘুমোতে যাবার আগেই যেন চিঠিগুলো পড়ি। কান্না না করে নাকি থাকতে পারবো না। যার দু–চোখে এখন কান্নার সমুদ্র, তার জন্য কান্নাটা আর এতো কঠিন কিসের?
তানবীরের কথা মতো কয়েকটি চিঠি প্রথম দিনেই পড়ে ফেললাম। যুদ্ধের পরিস্থিতি, কঠিন সময়ে যোদ্ধাদের মনোবল, নিজের খবর, দেশের খবর প্রভৃতি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের স্বজনদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। বিশেষ করে মায়ের কাছে। কয়েকটা চিঠি আমার এতো ভালো লেগেছে, বলবার মতো। ৪১ পৃষ্টায় অনুকে লেখা চিঠিটি সত্যি দারুণ, নষ্টালজিক করে দেবার মতো। খুনসুটি জাগানো। এছাড়া ২১, ৩৩, ৩৬, ৩৯, ৪৮, ৫১ পৃষ্টার চিঠিগুলো বারবার পড়বার মতো।
কখনো যদি বইয়ের সাথে সখ্যতা গড়বার ইচ্ছে জাগে, তোমার কাঙ্ক্ষিত বইয়ের সাথে এই সংকলনটিও কোন একদিন কিনে নিয়ো। ঘুমোতে যাবার সময় পড়িয়ো। তোমার কান্না কতোটা সহজ জানি না। কান্না না আসলে চুপটি করে এক মুহূর্ত কল্পায় হারিয়ে যেয়ো।
ঘুমোতে যাবার সময় 'একাত্তের চিঠি' পড়তে পড়তে আমার ভিতরে পুরনো ইচ্ছেটা আবার জেগে ওঠে। চিঠি লিখতে হবে। চিঠি। এমনিতেই অনেক দিন কবিতার সাথে নেই। লেখালেখি থেকে অনেক দূরে। মনের ভিতরে ভাবের প্রচন্ড তোলপাড়ে আর না লিখে পারলাম না। তোমাকে লিখতে বসলাম। তুমি হয়তোবা হাসতে পারো, নয়তোবা পাগলামী ভাবতে পারো। ফেইসবুক, হুয়াটসএ্যাপের এই যুগে আবার চিঠি!
আচ্ছা, কথা তো অনেক হয়ে গেলো। নজরুলের সেই চিঠিতে কী লেখা ছিলো শোনবা না?
ইদানীং মনটা সব সময় খারাপ থাকে। পরিচিত পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। চেনা সব কিছু বাদ দিয়ে অচেনা কোথাও লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। নিজেকে ভীষণ আড়াল করে রাখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব? এই যাপিত জীবন থেকে পালানোর কোন পথ নেই, মৃত্যু ছাড়া। জীবনের এই শাশ্বত পরিণতির কথা এখন বেশি বেশি মনে পড়ে।
আজ আর বলতে ইচ্ছে করছে না। মনটা ভীষণ আবেগী হয়ে উঠছে। সেই দিনগুলোকে মনে পড়ছে খুব। তোমার মনে পড়ে না? থাক আর বলবো না। নজরুলের চিঠিটা গুগুলে সার্চ দিলে পাওয়া যায়। ইচ্ছে হলে সেখান থেকে ডাউনলোড করে পড়ে নিয়ো। মনের বেতারে উত্তুরে হাওয়ার মতো হুঁ হুঁ একটা সুর সত্যি বেজে উঠবে।
ইতি
সিরাজ
বিষয়: সাহিত্য
১৬৯৯ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অদ্ভুত ভালোলাগা আর আবেগ মিশানো লিখাটি পড়ে অন্নেক কষ্টের উপলব্ধি নিদারুণ ভাবে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। নিয়মিত লিখুন ছোট ভাই।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
এককালে মাসে ৪০টার বেশী চিঠি লিখতাম!! তাও কমপক্ষে দু'পৃষ্ঠা+মার্জিন..
মন্তব্য করতে লগইন করুন