এক ঝাঁক সাদা কবুতর
লিখেছেন লিখেছেন আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:১০:২১ রাত
সে আমাকে বলেছিল, চলো আমরা বীচেই দেখা করি। কোন একটা ঝুপটিতে মুখোমুখি বসে পিঁয়াজু খেতে খেতে দুজনে মজার আলাপ জমাবো। চোখে চোখ রেখে ডুবে যাবো অতলে, কল্পনায়। তারপর খালি পায়ে ভেজা বালুতে হাঁটবো আর সমুদ্রের জলে পা ভেজাবো। দারুণ মজা হবে। এই চলোনা।
আমি সোজা বলে দিলাম, না।
কেন? তাহলে নেভালে চলো। পাকা বাঁধের উপর বসে দুজনে তাকিয়ে থাকবো ঐ দূরে। যেখানে বঙ্গোপসাগর আর কর্ণফুলি মোহনা পেতেছে। আমি তোমার কাঁধে মাথা রাখবো। তুমি এক হাত দিয়ে পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে রাখবে। তারপর অজানা সুখের ঢেউয়ে ভাসবো দুজন। যেন কর্ণফুলির শান্ত ঢেউ ভেসে চলা এক জোড়া ডিঙি-নাও।
মিলি খুব সুন্দর করে কথা বলতে জানে। গল্প-টল্প পড়ে হয়তো। তার এসব কথা আমাকে একটু নাড়া দিল। আমাকে কেন? একজন তরুণীর এমন রোমান্টিক আহ্বান পৃথিবীর তাবৎ তারুণ্যে ঢেউ তুলতে বাধ্য। কিন্তু আমি এবারও বলে দিলাম, না।
কেন? তাহলে কোথায় দেখা করবা?
ফ্রি পোর্টের মোড়ে।
ধ্যাৎ ওখানে কেউ দেখা করতে যায়?
কেউ কখনো যায় কিনা জানি না। আমরা দুজন যাবো। যখন গার্মেন্টস ছুটি হবে তখন। পথের একপাশে দাঁড়িয়ে দুজন সিইপিজেড়ের গেইট দিয়ে আসা যন্ত্রমানবের স্রোত দেখবো। জীবনের চাকাকে সচল রাখার জন্য তাদের সংগ্রাম। সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততার পর ক্লান্ত মানুষগুলোর চেহারা তেলতেলে হয়ে যায়। পথের দুপাশের নিয়ন আলোয় এদের মুখ আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অন্ধকার বাড়ার সাথে সাথে বাইরের পাঠ চুকিয়ে তাদের নীড়ে ফেরার তাড়া -পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে? সো আমরা ফ্রি পোর্টেই দেখা করবো।
হুম!
আমি জানতাম আমার এই প্রস্তাবে মিলি রাজি না হয়ে পারবে না। কারণ আমাদের দেখা করার ব্যাপারে আমার চেয়ে সে বেশি আগ্রহী। তাছাড়া মিলি জানতো যে, আমার ভিতরে একটা পাগল আছে। এমন অদ্ভুদ সিন্ধান্ত নিয়ে আমি মূলত চেয়েছিলাম, আমার সেই পাগলটার সাথে তার সরাসরি সাক্ষাত করিয়ে দিতে।
কিভাবে তার সাথে দেখা করতে যাবো?
আমার আটপৌরে পাঞ্জাবী। হালের কাটিং বিহীন এলোমেলো চুল। সময়কে অতিক্রম করে নিজেদের অসময় জানান দেওয়া বড় বড় দাড়ি আর গোফ। সব মিলিয়ে দারুণ অগোছালো আমি।
আধুনিক জিন্স আর রঙিন পাঞ্জাবীটা বাদ দিয়ে একটা সাদা ধূতি আর একটা সাদা পাঞ্জাবী গায়ে জড়ালেই যেন কাজ শেষ, এক্কেবারেই রবি ঠাকুর।
আমি জানতাম এভাবে দেখা করতে গেলে মিলি আমাকে কখনোই পছন্দ করবে না। মিলি কেন? কোন মেয়েই না। কারণ এ সময়ের তরুণীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত পুরুষদের মাঝে বলিউডী নায়কোচিত কিছু একটা প্রত্যাশা করেন। সেটা চলন বলন অথবা পরনেও হতে পারে। এটা যুগের পরিবর্তনের ফলে সংস্কৃতির আদান প্রদানের প্রভাব নাকি আমাদের বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গির স্বকীয়তা বিসজর্নে অগ্রগতি, কে জানে?
তারপরও এই অগোছালো বেশ নিয়েই আমি তার সাথে দেখা করতে যাই। আমি মূলত দেখতে চেয়েছিলাম, আমার উপরের বেশ ভূষার আড়ালে লুকানো ভিতরের মানুষটাকে সে কতোটা খোঁজে। আমার বাহ্যিক সাজ সজ্জার পরিবর্তে আমার কাজ, আমার চলন-বলনকে সে কতোটা গুরুত্ব দেয়।
এসবের পিছনে মূল কারণ আমার বাস্তববাদী দৃষ্টি ভঙ্গি। মানিকের (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) সাথে পরিচিত হবার পর থেকে বাস্তববাদ (রিয়েলিজম) আমাকে ভীষণভাবে পেয়ে বসে। রিয়েলিজম সম্পর্কে দুয়েক পৃষ্টা পড়ার পর আমি হয়ে উঠি আরো বেশি বাস্তববাদী। জীবনের প্রতিটি দিক বিভাগকে বাস্তবতার নিরীখে বিশ্লেষণ অতপর গ্রহণ বর্জন করাটাই যেন হয়ে ওঠে আমার স্বভাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
নির্দিষ্ট সময়। নির্দিষ্ট দিন।
অবশেষে মিলি এলো। আমাকে ফোন দিয়ে বললো, মিহির আমি বে-শপিংয়ের সামনে, তুমি কই? আমি পাশেই ছিলাম। মিলিকে রিসিভ করে দুজনে চলে আসি মোড়ের দক্ষিণ পাশে ওভার ব্রীজের উপর।
গার্মেন্ট ছুটি হয়। শুরু হয় যন্ত্রমানবের স্রোত। মিলিকে আমি পরিচয় করিয়ে দি জীবনের অন্য রকম স্রোতের সাথে। ভিন্ন এক ছোটগল্পের সাথে। শেষ হয়েও কখনো শেষ হয় না এই স্রোত। কেউ আসে কেউ যায়। একেক শিফটের একেক টাইম। জীবন এখানে বিরতিহীন।
দুজনে অনেক ক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর এসব দেখলাম।
ফ্রি পোর্ট। ওভার ব্রীজের উপর। কোলাহল অনেকটা কমে আসে। অন্ধকার তার স্বকীয়তা বৃদ্ধি করে চলছে ক্রমাগত। আমরা দুজন মুখোমুখি দাঁড়ায়। আমি আর মিলি।
আমার আপাদমস্তক একবার দেখে মিলি বললো, কবি! তুমি তো পুরাই একজন কবি। একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমি তার প্রতিক্রিয়া জানালাম। একটু ফান করে তাকে আগোগোড়া দেখে আমি বললাম, সাদা কবুতর!
মানে?
মানে তুমি অনেক সুন্দরী। তুমি একটা সাদা কবুতর।
তাকে এমন নাম দেওয়াতে সে ভীষণ খুশি হয়ে আমার হাতটা একটু করে ছুঁয়ে দিলো। সে আমার আরো পাশে এসে দাঁড়ালো। একেবারে আমার বাহুর সাথে তার বাহু লাগিয়ে।
আমি তার কাছ থেকে অনেক কিছু জেনে নিলাম, সেও আমার কাছ থেকে। সে জানতে চেয়েছিল, তোমার বাবা কী করে?
আমি নিঃসঙ্কোচে বলে দিয়েছি, বাবা গার্মেন্টেসে চাকরী করে।
মা?
আমার মা নেই! আমার বয়স যখন সাত, মা আমাদের ছেড়ে ঐ আকাশের তারা হয়ে যায়। আমি, ছোট বোন আর বাবা, আমাদের তিনজনের সংসার। কাছের আত্মীয় স্বজনরা বাবাকে অনেক বুঝিয়েছে, আরেকটা বিয়ে করার জন্য। কিন্তু বাবা করে নি। আমি কি পাগল, বাবা আমার চেয়ে আরো বড় পাগল। মায়ের জায়গায় অন্য কাউকে তিনি কল্পনা করতে পারেনি।
আমার এসব কথা শোনার পর মিলির চোখে পানি আসে নি। কিন্তু করুণ একটা মেঘ এসে তার চেহারায় ছায়া ফেলেছে, আমি স্পষ্ট তা দেখতে পেয়েছি।
এভাবে অনেক কথা হলো আমাদের। অনেক কথা। মনের মধ্যে জমানো সব কথা।
অবশেষে মিলি বিদায় নিলো। যাওয়ার সময় সে আমাকে বলে গেলো, মিহির যাচ্ছি, বাই, ভালো থেকো। আমি তাকে বলেছিলাম, পাশে হোটেল জামান, আমার পকেটে অনেক টাকা নেই তাই তোমাকে খাওয়াতে পারছি না। সে ফ্যাকাশে একটা হাসি দিয়ে বললো, না, থাক লাগবে না।
মিলি চলে গেলো। আমি তাকে এগিয়ে দেই নি। ব্রীজ থেকে নেমে একটা রিক্সা নিয়ে সে চলে গেলো। আমি অনেক ক্ষণ তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাগরিক অন্ধকারে আস্তে আস্তে হারিয়ে গেলো মিলির রিক্সা। আরো কিছু মুহূর্ত একাকী পাস করে আমি চলে এলাম বাসায়।
কিন্তু কি আশ্চর্য, সেদিনের পর থেকে মিলিকে আমি আর পাইনি। এফবিতে সে আমাকে ব্লক দিয়েছে। তার নাম্বারে ফোন দিলে বলে, আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে...
কেন এমন হলো?
মিলির কি আমাকে একটুও পছন্দ হলো না? কীভাবে হবে? যার সামনে জীবনকে গোছানোর হাতছানি, আমার মতো একজন অগোছালোকে সে কেনইবা পছন্দ করবে? যার সামনে সুখের জীবন, শান্ত ঢেউয়ের প্রবাহিত নদী, সে কেন এলোমেলো ঢেউয়ের স্রোতে তার তরীকে ডুবানোর মতো বোকামী করবে?
মিলির এভাবে হারিয়ে যাওয়া আমাকে অনেক বিরহভারাক্রান্ত করেনি। কারণ আমি জানতাম এমন কিছু একটা ঘটবে। তবে একটু বিরহ এসে উড়কু রোহিঙ্গার মতো আমার হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়ে নিলো।
এসব বিরহ নিয়ে অনেক দিন কেটে গেলো। আমি আমার মতোই আছি। সেদিন চলে যাওয়ার সময় মিলি আমাকে বলে গিয়েছিল, ‘মিহির ভালো থেকো’ তাই নিজেকে ভালো রাখার জন্য একদিন বিকেলে সল্টগোলা ক্রসিং গিয়ে আমি অনেক কবুতর নিয়ে আসি। সাদা কবুতর।
দোতলার ছাদে তাদেরকে ছোট ছোট বাসা বানিয়ে দি। এখন অবসর পেলেই আমি ছাদে উঠি। কবুতরদের সাথে খেলা করি। ছাদে দানা ছিটিয়ে দি। দানা পেয়ে কবুতরদের পাখা ঝাপটানি দেখি। ডানা প্রসারিত করে কবুতররা উড়ে।
আমি ছাদের এক কোণে গিয়ে রেলিংয়ের উপর বসি। রিয়েলিজমের সেই আমাতে এসে ভর করে রোমান্টিসিজম। আমি হয়ে উঠি কাল্পনিক।
তখন বাসার ছাদটা হয়ে যায় আমার হৃদয়। আমার হৃদয়ে সাদা কবুতর, যেন সাদা শাড়ি পরা মিলি। পায়ে নুপুর, কোমরে বিছা। মিলি নাচে। ধ্রুপদী নাচ। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। সে হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকে। তাকে ছুঁয়ে দিতে আমি হাত বাড়ায়। কিন্তু মিলি নেই।
একটা কবুতর এসে আমার ঘাড়ে বসে। তাকে ধরে আলতু করে আদর করে আমি আকাশে উড়িয়ে দি। সে উড়ে যায় ঐ দূরে। নিঃসীম আকাশ। আমি উপরের দিকে তাকায়। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলি, মিলি তুমি নেই তাতে কি হয়েছে? আমার আছে বিকেল। আছে বিকেলের ছাদ। আর আছে এক ঝাঁক সাদা কবুতর।
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ
বিষয়: সাহিত্য
১৮১৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যদিও তাই করা উচিৎ!
অন্নেক সুন্দর হয়েছে!
অফুরন্ত ভাল লাগা রেখে যাচ্ছি..........।
মিলি, ছাদ, কাহিনী সবটা কাল্পনিক। রং মেশানো।
অনেক ধন্যবাদ ভাই সুন্দর কমেন্টের জন্য।
(মোবাইল থেকে রিপ্লাই দেওয়া যাচ্ছে না। তাই কমেন্টে দিলাম)
রিপোর্ট করুন
মিলিকে বোঝাতে পারতেন যে , টাকা দিয়ে কি সুখ কেনা যায় ? আমি তোমাকে যেরকম ভালবাসবো সেরকম ভাবে কি কোন পয়সাওয়ালা তোমাকে ভালবাসবে ?
সংসারে যদি শান্তি না থাকে , ভালোবাসা না থাকে তাহলে টাকা দিয়া কি হইবে ?
বলে দেখতেন পারেন , চিড়ে ভিজতেও পারে।
মিলি, ছাদ, কাহিনী সবটা কাল্পনিক। রং মেশানো।
অনেক ধন্যবাদ ভাই সুন্দর কমেন্টের জন্য।
(মোবাইল থেকে রিপ্লাই দেওয়া যাচ্ছে না। তাই কমেন্টে দিলাম)
এখন মিহির যদি মিলিকে এসব বুঝাতে চায়, জানতে চায়, তবে একটা নাটকীয়ভাবে তাদের আবার সাক্ষাত ঘটাতে হবে। আরেকটা গল্পে।
এখন সেরকম আরেকটা থিম মাথায় আসবে কিনা জানি না। অথবা আবার তাদের সাক্ষাত ঘটালে ব্যাপারটা কেমন হবে, ভাববার বিষয়।
আপনার কেমন হবে বলে মনে হয়?
রিপোর্ট করুন
মিলি, ছাদ, কাহিনী সবটা কাল্পনিক। রং মেশানো।
অনেক ধন্যবাদ ভাই সুন্দর কমেন্টের জন্য।
(মোবাইল থেকে রিপ্লাই দেওয়া যাচ্ছে না। তাই কমেন্টে দিলাম)
এখন মিহির যদি মিলিকে এসব বুঝাতে চায়, জানতে চায়, তবে একটা নাটকীয়ভাবে তাদের আবার সাক্ষাত ঘটাতে হবে। আরেকটা গল্পে।
এখন সেরকম আরেকটা থিম মাথায় আসবে কিনা জানি না। অথবা আবার তাদের সাক্ষাত ঘটালে ব্যাপারটা কেমন হবে, ভাববার বিষয়।
আপনার কেমন হবে বলে মনে হয়?
সুন্দর!!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন