সাকিবের পায়রা
লিখেছেন লিখেছেন আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ ১২ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৮:৩৬:১০ রাত
(শিশুতোষ ছোটগল্প)
পড়া বলো।
স্যার আমি পড়া শিখিনি।
কেন?
স্যার আমার মন খারাপ।
কেন?
দুচোখে তার কথার সমুদ্র লুকানো। মুখটাও মায়াবী। চোখ আর মুখ দিয়ে যেন ভিতর থেকেই প্রতিভাত হচ্ছে, আজ তার মন খারাপ। আমারও আর বুঝতে বাকি রইলো না।
ক্লাশ সেভেন। অনেক ছাত্রছাত্রী। ক্লাশে সবার ছোট সে। সবার মাঝ থেকে এই পিচ্ছি সাকিবকে আলাদা করা যায় খুব সহজে। তার কম বয়স, মায়াবী চেহারা, দুষ্টমীর রাজাও। মেধাবীও কম না, হাতের লেখাও অসাধারণ, গুড় গুড়। দূরন্ত, ডানপিটে তাই খুব সহজে সে ধরা পড়ে সবার চোখে। আমার চোখেও।
অর্ধ-বার্ষিকী পরীক্ষায়, হলে গার্ড থাকা কালে তার সাথে আমার ভালো একটা বুঝাপড়া হয়। হঠাৎ করে তার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম, সবাই বসে বসে লিখছে আর সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
কিরে তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লিখছো কেন?
স্যার টেবিল উঁচু।
এই বলে সে নিজেই হেসে ফেললো। আমিও হাসলাম। ক্লাস সিক্সের যারা ছিল তারাও হাসলো। সেভেনের যারা ছিলো তারা তো হাসলোই। একটু পরপর বসার চেয়ারে রাখা বোতল থেকে রঙিন পানি পান করছে। আর একেবারে মনোযোগ দিয়েই লিখছে। পাশে গিয়ে জানতে চাইলাম, রঙিন পানি কেন?
স্যার ট্যাঙের শরবত। আম্মু বাসা থেকে করে দিয়েছে। একটু পরপর আমার গলা শুকিয়ে যায় তো তাই।
উপরের পাটির দাত দেখিয়ে শব্দহীন হাসলো। আবার লেখায় মনোযোগ।
সময় শেষ হবার এখনো অনেক বাকি। একটু পর দেখলাম, খাতাপত্র গুচিয়ে বসে রইলো। আমি নড়তে না নড়তেই পিছনের জনের সাথে দুষ্টমি। ধরা পড়ে গেলো, স্বভাবসূলভ হাসলো। আমি চোখ একটু বড় করে মাথা নাড়ালাম না না...
বুঝতে পারলো সেও, চুপ হয়ে গেলো।
বসে আছো কেন?
স্যার লেখা শেষ।
এতো তাড়াতাড়ি?
স্যার তথ্য ও প্রযুক্তি পরীক্ষা। লেখা কম।
ও আচ্ছা।
আবার তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোথায় থাকো?
স্যার ফিসকোতে।
মানে?
স্যার পূর্ব কাটগড়, ফিসকোর ভিতরে কোয়াটারে। আমরা দুই ফ্যামিলি থাকি। কোম্পানীর পক্ষ থেকে দিয়েছে।
ও আচ্ছা। তোমাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?
স্যার দিনাজপুর।
সীমান্ত এলাকা?
জী স্যার। আমাদের বাড়ি একেবারে সীমান্তের পাশে।
বাড়িতে যাও?
না স্যার। আমার জন্ম চট্টগ্রামে। ক্লাশ ফোরে থাকতে একবার মাত্র গিয়েছিলাম।
আর যাওনি কেন?
আব্বুর বেতন কমতো তাই। অনেক দূরে। আমাদের বাড়িতে যেতে অনেক টাকা লাগে।
বলেই মুখটাকে কেমন যেন করে ফেলেলো। মুখের এই ভাব বুঝা যায় কিন্তু ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। আব্বুর বেতন কম হওয়ায় এ রকম আরো কতো সাকিবের প্রতি বছরে বাড়ি যাওয়া হয় না, তার হিসাব কে রাখে? উন্নতি, মানবতা, আধুনিকতার এই যুগে মানবতা, উন্নতি কিংবা আধুনিকতা শুধু সমাজের নিয়ন্ত্রক শ্রেণির মুখেই থাকে, মানুষের না। আব্বু স্কুলের টিচার বলে মধ্যবিত্ত, নিন্ম মধ্যবিত্ত অথবা নিন্মবিত্তের পৃথিবী আমার অপরিচিত নয়।
বাড়িতে কে কে আছে?
দাদি নেই, দাদু আছে। বড় চাচা, মেঝ চাচারা আছেন।
কাজিনরা নেই?
জী স্যার আছে।
কি কি নাম তাদের?
জিসান সবার ছোট। জিহাদ ভাইয়া, ঝিনু আপু আর জিশু।
জিশু কতো বড়?
ও আমার ছোট স্যার।
সুন্দরী নাকি?
মুচকি হাসি দিয়ে একেবারে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো। বাবাহ কী লাজুক। এ যেন ডানপিটে সে না, ভিন্ন এক সাকিব।
এভাবেই সেদিন সাকিবের সাথে আমার বুঝাপড়া হয়ে গেলো। সেই থেকে আমার সাথে সব সময় ফান করবে। স্যার আসসালামু আলাইকুম বলে হাত তুলে সালাম দিবে। মুচিকি হাসি দিবে। আমাদের মাঝে ছোট-খাটো মনের লেনদেন হয়ে গেছে, দুজনার আর বুঝতে বাকি নেই তা।
তো সেদিন ক্লাশের পড়া নিতে গিয়ে দেখি সে পড়া শিখেনি।
এমন আরো অনেকবার সে পড়া শিখেনি। কারণ যাচাই করার পর, যৌক্তিক হলে ছাড় পেয়েছে, অযৌক্তিক হলে সবার মতো সেও শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা সে নিজেই বলে দিয়েছে, স্যার আমার মন খারাপ।
কেন?
সে কেমন নির্বাক।
তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু মনে হয় আবু হুজায়ফা। কখনো জিঙ্গেস করিনি। তবে দুজনে সব সময় একই সাথে বসে। সে হিসেবে ধরে নিয়েছি। আবু হুজায়ফা বললো-
সত্যি স্যার আজকে ওর মন খারাপ।
কী হয়েছে বলবা তো।
স্যার আমার একটা পায়রা মারা গেছে।
পায়রা মারা গেছে! কীভাবে?
স্যার একটা কালো বিড়াল হামলা করেছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম, কাজ হয়নি। রাতেই মারা গেছে। কালকে পায়রাটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম তাই স্কুলে আসতে পারিনি, পড়াও শিখিনি।
একটানে এসব বলে মুখটাকে নিচু করে রাখলো। আসলেই তার মন খারাপ। একে তো ছোট ছেলে তার উপরে শখের জিনিস। ছোটকাল থেকেই নাকি পায়রার সাথে তার সখ্যতা। স্কুল ছাড়া পাশের বাসার মাহমুদ, পায়রা, আব্বু-আম্মু আর ফিসকোর ছোট্ট কোয়াটারই তার পৃথিবী। এই ছোট্ট সুন্দর পৃথিবীতে যদি কেউ বিরহ-বেদনা নিয়ে আসে তবে তার মন কীভাবে ভালো থাকবে?
তাকে একটু হাসানোর ফন্দি খুঁজতে লাগলাম। উল্টো কি যেন কি ভাবতে ভাবতে আমার দুচোখও কখন টলমল করতে শুরু করলো বুঝতেই পারিনি...
১২. ১২. ২০১৫
(পায়রার ছবি নেট থেকে সংগৃহিত)
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ
আনোয়ারা, চট্টগ্রাম।
বিষয়: সাহিত্য
২০৫৫ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গল্প- শুধু গল্পই নয়-
স্বপ্ন- সে তো অল্প-ও নয়,
কিন্তু- বড় কষ্ট ও ভয়..
"তিনটে"- উঁহু- মোটেও তা নয়!!!
অনেক সুন্দর কমেন্ট, খুশি হলাম, অনেক অনেক ধন্যবাদ রইলো ভাইয়া
পোষা কবুতরগুলো প্রায় বাসার ড্রয়িংরুমে উড়ে এসে ঢুকতো । ফ্যান চালু থাকলে নির্ঘাত মারা যাবে এজন্য কবুতরগুলো ঘরে ঢুকলেই নিজে কান বন্ধ করে সবাইকে বলতাম , ফ্যান বন্ধ করো ।
একদিন বিকেলে স্কুল থেকে আসার সময় জানতে পারলাম যে কবুতরটি ফ্যানের সাথে বাড়ি খেয়েছে , একটা পা আলাদা হয়ে গেছে । খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম শুনে। পরে দেখলাম যে আম্মা সেটাকে কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলেন । আল'হামদুলিল্লাহ ! এরপর কবুতরটি লেংড়িয়ে চললেও ঠিক ছিল ।
পরের বছর দেশের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ফিরে এসে সেই কবুতরটিকে আর পায় নি ।
পাখি পোষার প্রতি আবেগ এখন আর সেরকম নেই । মেইনটেইন করাও শহুরে জীবনে বেশ কঠিনই।
আমার কবুতর পাগলামী নিয়ে আরেকদিন লিখবো। অনেক ধন্যবাদ রইলো আপনার স্মৃতি চারণমূলক কমেন্টের জন্য
ছোট্ট গল্পটা অনেক অনেক ভালো লেগেছে। এর বেশি কি মন্তব্য করবো। সুন্দর মন্তব করতেও দক্ষতা লাগে, সেকি আমার আছে!
মন্তব্য করতে লগইন করুন