কবিতার শবদাহ (শেষ পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১১:০০:১৯ সকাল

রাত এখন সাড়ে নয়টার কাছাকাছি। মানুষ জন একেবারে কমে গেছে। অনেকক্ষণ পরপর দু’একটা গাড়ি আসছে যাচ্ছে। দানার মতো শিশির কণাগুলো আরো বেশি করে ঝরতে লাগলো। শীতল হাওয়ায় আরো বেশি ঠাণ্ডা অনুভূত হতে লাগলো। গায়ে একটা পাতলা শাল হলে মন্দ হতো না। কিন্তু এখানে শাল পাবো কই? নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউর গান আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে বাজতে লাগলো। দিনের চেয়ে রাতের কর্ণফুলি দেখতে অনেক বেশি সুন্দর, অনেক বেশি মনোহর। রাতে নদী দেখা আর নদীর গান শোনার মজাই আলাদা। ইশ্ একটা ছোট্ট নৌকায় করে কিছু দূর যেতে পারলে অনেক ভালো লাগতো! কিন্তু এতো রাতে নৌকা?

আমরা তখনো নিরব। হাত দুটা বুকে জড়িয়ে আমরা বসে আছি। মামুন সাহেবও কেমন একটা নির্বাক ভাবনায় ডুবে আছে। সিহাব কথা বলে উঠলো- ঠাণ্ডা লাগছেরে খূব, আরেকবার চা হলে মন্দ নয়।

আমিও সম্মতি দিলাম। খুব খরা করে তিনটা চায়ের অর্ডার হলো। কিছুটা ক্ষুধার গানও করুন হয়ে বাজতে লাগলো। এবার চায়ের সাথে আমরা একটা ফিট বিস্কুটও নিলাম।

চা এলো, আমরা চা শেষ করলাম। কিছু বিস্কুট বাকি ছিল। বাসায় ফেরার তাড়াও অনুভব করতে লাগলাম। আমি আর সিহাব দুজনে কথা বলা শুরু করি। মামুন সাহেবকে দ্রুত ওনার কাহিনী শেষ করার জন্য অনুরোধ করলাম।

একটা ফিট বিস্কুট মুখে দিতে দিতে ওনি বলতে শুরু করলেন-

‘নিঝুকে নিয়ে যে দিন আমি নেভালে আসি সেদিন ঠিক এই দোকানে বসেই আমরা নাস্তা করেছিলাম। এখানকার পুরাতন দোকানগুলোর মধ্যে এটি একটি। দোকানের অবয়ব অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মালিকও আগের জন নাই।

সে দিন রাত প্রায় সাড়ে ৭ টার দিকেই আমরা এখান থেকে ফিরে ছিলাম। রিক্সায় করে গিয়েছিলাম। এখান থেকে বাসা বেশি দূরে না। ১৮/ ২০ মিনিট মতো লাগে।

তারপর এভাবে অনেক দিন কেটে গেল। আমাদের প্রেমও আপন ছন্দে আনন্দে প্রবাহিত হতে লাগলো। তবে নিঝুকে নিয়ে এটাই ছিল আমার প্রথম এবং শেষ বেড়ানো।

এভাবে পাঁচ ছয় মাস যেতে না যেতেই আসে আমাদের প্রেমের ট্রাজেডি। নিঝুর দূর সম্পর্কের কোন এক মামাতো ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে হয়ে যায়। দুবাই প্রবাসী ছেলেটা ছিল এইট পাশ। তাহিয়ার কাছ থেকে শোনেছিলাম এই বিয়েতে নাকি নিঝুর পূর্ণ সম্মতি ছিল।

সেদিন আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। আপনাদের কিভাবে বুঝাবো? হঠাৎ যেন হৃদয় সমুদ্রে ভয়ঙ্কর এক সুনামির শুরু হয়ে গেল। বিশাল এক ঢেউ এসে হৃদয় নিভৃতের সেই দ্বীপটি ভেঙে দিল। তিলে তিলে গড়া এই দ্বীপটি চোখের সামনে চুরমার হয়ে গেল। বিরহের জোয়ারে তলিয়ে গেল প্রেমের সৌধ। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি। আর অঝরে কেঁদেছি। নিঝুর সাথে আমি অনেকভাবে দেখা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু দেখা করা হয়নি।

সে দিন ছিল ১৮ সেপ্টেম্বর। নিঝুর বিয়ে দিন। স্কুলের প্রায় সব টিচার বিয়েতে গিয়েছিল। আমি যাইনি। আমি সেদিন আমার সব ডায়রী নিয়ে এখানে চলে এসেছিলাম। এবং এই দোকানে এসে অনেক ক্ষণ একা বসেছিলাম। কারন এই দোকানেই আমি নিঝুকে নিয়ে প্রথম এবং শেষ অন্তরঙ্গ মুহুর্তটুকু কাটিয়েছিলাম। রাত ঠিক ৮ টার দিকে এখানে বসে নিঝুকে নিয়ে লেখা আমার অনেকগুলো কবিতা পোড়িয়ে ফেলেছিলাম।’

একটা গম্ভীর এবং ভাবওয়ালা কণ্ঠে সিহাব বলে উঠলো- তাইলে এই ব্যাপার।

আমিও কিছু একটা বললাম। সিহাব বললো কিন্তু আপনি কিছুক্ষণ আগে সেগুলো কি পোড়িয়েছিলেন?

আমরা বুঝতেই পারছি মামুন সাহেব এখন অনেক কষ্ট পাচ্ছে। টিস্যু দিয়ে চোখগুলো মুচ্ছে বারবার। অনেক জোরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ওনি বললেন-

‘আমি এখনো বিয়ে করিনি। ফ্যামিলি থেকে অনেকভাবে চাপ দিয়েছিল। কিন্তু আমি যে কোন ভাবেই তাকে অগ্রাহ্য করেছি। নিঝুর বিয়ের পর ভেবেছিলাম স্কুলের চাকরী ছেড়ে এখান থেকে চলে যাবো। কিন্তু ওকে আরেকবার দেখতে খুব ইচ্ছে, তাই এখান থেকে যাইনি। এখনো রয়ে গেছি। ওর কাছ থেকে একটা প্রশ্ন খুব জানতে ইচ্ছে করে- সে কেন আমার সাথে এমনটা করলো? কেন আমার ভালোবাসাটাকে পশ্রয় দিয়েছিল?

তার মানে আপনি কখনোই নিঝুকে ভুলতে পারবেন না? সিহাব বললো।

আপনি কি নিঝুকে এতো ভালোবাসেন। কিন্তু মেয়েটা তো আপনাকে একটুও ভালোবাসেনি। আমি বললাম।

ওনি কেমন একটা রহস্যের হাসি দিয়ে বললেন-

‘হুম, আমি এখনো নিঝুকে ভালোবাসি। কখনোই তাকে ভুলতে পারবো না। কারন সেই আমার প্রথম এবং শেষ প্রেম। তাই প্রতি বছর আমি নিঝুকে নিয়ে ১২ টা কবিতা লিখি। আর ১৮ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ নিঝুর বিয়ে বার্ষিকির দিন সেই কবিতার পাণ্ডুলিপিগুলো নেভালের এই দোকানে এসে পোড়ে ফেলি। আজকে প্রায় পাঁচ বছর আমি এই কাজটা করে চলছি।

আপনারা হয়তো ভাবছেন এগুলো নিছক কিছু কবিতা এবং কবিতার পাণ্ডুলি ছাড়া আর কিছুই না।

না না সেটা মোটেও না। এই কবিতাগুলোতে মিশে থাকে আমার প্রেম-ভালোবাসা, আমার আবেগ, আমার বিশ্বাস। এই কবিতাগুলোকে পোড়ানোর মধ্য দিয়ে আমি আমার হৃদয়কে পুড়ে ফেলি। হৃদয়ের সব বিরহ-আবর্জনা-কষ্টগুলো আগুনে সপে দিয়ে আমি একটু শান্তি পেতে চাই। কিন্তু শান্তি কই? প্রেম যে চির বিরহের।’

২৩.১০.২০১৪

আনোয়ারা, চট্টগ্রাম

বিষয়: সাহিত্য

১৩০১ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

292652
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৫৪
পুস্পগন্ধা লিখেছেন :

আগের পর্ব গুলি পড়ি নাই, তবে আমার মনে হয় লোকটার এখন স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া উচিত, ঘটে যাওয়া ঘটনাকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না..


লোকটার অনুভুতির প্রতি সহানুভুতি জানাচ্ছি..
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:০০
236470
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : আমার কাছে সত্যি ভালো লাগছে যে আপনার এটাকে বাস্তব কোন ঘটনা মনে করেছেন। এই গল্পের একটা দিকও বাস্তব না। পুরোটাই আমার কল্পনা প্রসূত। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে মন্তব্যের জন্য Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck
292683
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:১৯
নোমান২৯ লিখেছেন : ফেবুতে পড়েছি! Happy Happy
তবে কবিতার শবদাহ উচিত হয়নি|
হয়ত উনি এ কবিতাগুলোকে নিয়ে রবি Surprised Surprised-নজরুল পরবর্তীজন হতে পারতেন!? Happy) Happy)
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:০৪
236471
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : ওনি একজন কাল্পনিক জীব! বাস্তবে ওনার কোন অস্থিত্ব নাই। সো নজরুল রবীঠাকুর হওয়ার কোন উপায় নাই। আপনি ফেবুতে আছেন আমার সাথে! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে Good Luck Good Luck Good Luck
292697
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:১৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : কবিতার দোষ টা কি সেটা বুঝলাম না!!!

নারি মাত্রই সুবিধাবাদি!!!
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:০৪
236472
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : হয়তো হেতিরে নিয়ে লিখছে তো তাই! নারী আসলেই...
292704
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:৪৭
আফরা লিখেছেন : উনি একটা পাগল--------
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:০৬
236474
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : প্রেমিক মানেই পাগল! তুমিও একটা পাগলী! কারণ পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের মাঝে একটা পাগল বাস করে...
বুবুকে ধন্যবাদGood Luck Good Luck Good Luck Good Luck
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:১৩
236481
আফরা লিখেছেন : ছোটদা--- আপনি আমাকে পাগলী বললেন মনে থাকে যেন !!
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৩৬
236488
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : আরে না! এটা কিন্তু ভালো পাগলী! সবার মাঝে থাকে...
লক্ষীবুবু লাগ (রাগ) করে না।
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৪২
236490
আফরা লিখেছেন : ওকে ছোটদা --- Big Grin Bee Rolling on the Floor
292814
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:৪১
রফিক ফয়েজী লিখেছেন : মামুন সাহেবের প্রতি রইল আন্তরিক সমবেদনা।কাইন্দেন না ভাই এক নিঝু আপনার ভালোবাসার মর্ম বুঝে নাই চলে গেছে।সাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন দেখবেন অনেক নিঝুই আপনার জীবনে ঘুরে ফিরে আসবে। ধন্যবাদ লেখককে সুন্দর একটি লেখার জন্যে।
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:০৭
236476
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : আপনাদের এই কমেন্টগুলো পড়ানোর জন্য কাল্পনিক মামুন স্যারকে কিভাবে আনবো সেটাই ভাবতেছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকেGood Luck Good Luck Good Luck
292850
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:২৪
শয়নে তুমি স্বপনে তুমি লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৩৬
236489
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : আপনি না পড়েই কমেন্ট করলেন, আমার যতটুকু মনে হয়। ভুলও হতে পারে!
292961
১০ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:২৯
লজিকাল ভাইছা লিখেছেন : ভালইতো লাগছে, এই !!!! ১ম থেকে শুরু করতে যাইতেছি--------- Rose Rose Rose Rose
১০ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:১১
236638
আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ লিখেছেন : আপনার যাত্রা শুভ হোক!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File