তাদের উপরে আকাশ আছে কিন্তু কার যেন ছায়া নেই
লিখেছেন লিখেছেন আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ ২১ এপ্রিল, ২০১৪, ০৩:৫২:৪৪ দুপুর
'প্রিয় বাবা' প্রতিযোগিতার জন্য বড় বড় ব্লগাররা বাবাকে নিয়ে দারুন দারুন সব লেখা লিখেছেন। সবার লেখা পড়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে যতগুলো পড়েছি তার সবটা প্রায় বাস্তব সম্মত, বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক। প্রায় সুখে থাকা এসব ব্লগাররা বাবার ধুসর স্মৃতিসব চারণ করতে গিয়ে পাঠকদেরও ক্ষণিকের শোকে ভাসিয়েছেন, অতৃপ্ত করুণ রসে পাঠকদের হৃদয়কে সিক্ত করেছেন। সবাইকে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ সুন্দর সুন্দর লেখাগুলোর জন্য। এবার আসি আসল কথায়। মাকে নিয়ে গল্প প্রতিযোগিতায় লিখতে আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। অনেক দিন চেষ্টা করে আমি মাকে নিয়ে লিখেছিলাম-
'মা, আমি তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখি না
কোন শব্দমালায় আমি তোমারে গাঁথব?
তুমি তো সহজ শব্দমালার অন্তহীন মহাকাব্য!
মা, আমি তোমাকে নিয়ে ছন্দ বুনি না
কোন ছন্দ মানাবে অঙ্গে তোমার?
তুমি তো অনন্ত ছন্দের মোহময় ঝংকার!'
এবার বল, এই লেখা দিয়ে কি প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করা যায়? অবশ্যই না। সো যা হবার তাই হল। অনেক দিন পর আজ যখন আব্বুকে নিয়ে লিখতে বসলাম -আমার সমগ্র সত্ত্বা জুড়ে কি যেন বয়ে যেতে লাগল। ভয় শ্রদ্ধামাখানো আব্বুকে ভাবতে ভাবতে আমি কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। পৃথিবীর সবটুকু আবেগ এসে আমাকে নির্বাক করে দিচ্ছে। কেমন যেন আদেশ-নিষেদ, আদর, ভালোবাসার মোহ আমাকে বিভোর করে দিচ্ছে। আমার সব ভাষাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে আর দু'চোখ বুজে আমি সেই আদর ভালোবাসাকে উপভোগ করে চলছি। হঠাৎ আমার মোহ কেটে যায়, সারাটা শরীর কাঁপিয়ে চোখ থেকে টপ টপ করে ঝরে পড়লো কয়েক ফোটা জল, আব্বুর প্রতি ভালোবাসার জল।
হয়তো পৃথিবীর সব মানুষের ক্ষেত্রে এমনটা হয়। মানুষের মুখ যখন কথা হারিয়ে ফেলে তার চোখ তখন এক অবুঝ ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। আর চোখের এ ভাষা মুহূর্তেই শত শত হৃদয়ে অনন্ত মায়ার শান্ত-অশান্ত মহাসমুদ্র রচনা করে। দু'এক ফোটা চোখের জলের এই ভাষাকে শত কলমের কালি দিয়ে সহস্র শব্দেও ব্যক্ত করা অনেকটা দুঃসাধ্য বলা যায়। অব্যক্ত থাকার মধ্য দিয়েই এই ভাষা অন্যভাবে ব্যক্ত হয়ে উঠে। মন দিয়ে তা বুঝে নিতে হয়। তাছাড়া মানুষ কোন কিছুতে গভীর ভাবে বিভোর থাকলে, কেমন একটা আবেশ তাকে জড়িয়ে রাখে। আমার আব্বুর আদর ভালোবাসা আমাকে এতটা নিবিড় ভাবে জড়িয়ে রেখেছে, ওনাকে নিয়ে কিছু লেখার খেই হারিয়ে ফেলেছি। তবে একটা ছোট্ট ঘটনা বলেই আমি শেষ করবো-
২০০৯ সালের শেষের দিকের কথা, আমি তখন অনার্স ফাস্ট ইয়ারে। পতেঙ্গা আলীয়ার সামনেই ছিল আমাদের বাসা। আমরা তিন ভাই, দুই চাচতো ভাই মিলে ব্যাচেলর থাকতাম। এক দিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা রেস্ট নিচ্ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ দুলাভাই এসে আমাকে বলে- 'ছালু (আত্মীয় স্বজনের কাছে আমি ছালাউদ্দিন নামে পরিচিত, সংক্ষেপে ছালু) জলদি রেডি হ, মেডিকেলে যেতে হবে, সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে।' দুলাভাই ডাক্তার তাই আমি ভাবলাম হয়তো কোন রোগিকে দেখতে যাবে। ঝটপট রেডি হয়ে বের হলাম। বাইরে এসে দেখি সিএনজিতে বসে আপু কাঁদছে। আমাকে দেখে বোরকার ওড়নায় চোখ মুছে কান্না লুকানো ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
নিশ্চয় আমাদের ঘরের কারো কিছু হয়ছে -আমার বুঝতে দেরি হল না। জিঙ্গেস করলাম কি হয়ছে? আপু দুলাভাই দু'জনেই নিরব। তাদের নিরবতা আমার অনুমানকে আরো দৃঢ় করে দিল। গাড়িতে উঠে বসলাম। কাঠগড় থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম চট্টগ্রাম মেডিকেলে। ১২ নং ইউনিটে গেলাম। হার্ট বিভাগ। দরজার সামনে দেখলাম গম্ভীর মুখে সবুর মামা, আকতার মামা, বড় ভাইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরকে দেখে আপুর কান্না আরো বেড়ে গেল। আমি তখনো বুঝতে পারিনি আসলে কার কি হয়ছে। দরজার সামনে গেলাম, গ্লাসের এ পাশ থেকে দেখলাম- নিথর হয়ে শোয়ে আছে আমার আব্বু, নাকে মুখে অক্সিজেনের ইয়েটা লাগানো।
আমার সারাটা হৃদয় তখন হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। মুহূর্তেই মনে হতে লাগলো আমার উপর থেকে কার ছায়া যেন সরে যেতে লাগলো, সমস্ত আকাশটা টুকরো টুকরো হয়ে আমার উপর ভেঙে পড়তে লাগলো। এই পৃথিবীতে নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগলো। চোখ থেকে ততক্ষণে ঝরঝর করে ঝরতে লাগলো অশ্রু। পাঞ্জাবীর হাত দিয়ে চোখকে আটকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কে শোনে কার বারণ। আমার সব বারণকে উপেক্ষা করে চোখ তার আপন ভাষায় অনর্গল কথা বলে যেতে লাগলো। বাড়ি থেকে ফোন করে আম্মুর কান্না, ছোট বোনদের কান্না, কে থামাবে?
অবশেষে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর আব্বুর হুশ এল। ডাক্তাররা জানালেন হার্ট এটাকের মাত্রা এত বেশি হলে সাধারণত রোগি বাঁচে না। কিন্তু আল্লাহর রহমতে ওনার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটলো। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে আমার আব্বু বেঁচে গেলেন। আলহামদুলিল্লাহ। হয়তো আমাদের এই এলোমেলো সংসারটার জন্য আল্লাহ ওনাকে বাঁচিয়ে দিলেন। হয়তো আমাদের এলাকার অগোছালো ইসলামী আন্দোলনের জন্যই আল্লাহ ওনাকে বাঁচিয়ে দিলেন। ইয়া আল্লাহ -'রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানি ছাগিরা'। তবে সে দিন বুঝেছিলাম- যাদের আব্বা নাই তাদের উপরে আকাশ আছে কিন্তু কার যেন ছায়া নাই।
আমার আব্বুর জন্য সবাই দোয়া করবেন প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
বিষয়: Contest_father
২২৪৮ বার পঠিত, ৬৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তোমার বাবার জন্য দোয়া রইলো ,,আমার বাবার জন্য ও দোয়া কর।
আমার মত একজন নগণ্য ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মীর ডাটা পর্যন্ত বর্তমান জাহেল জালেম সরকারের গোয়েন্দাদের লিষ্টে আছে।
কোন শব্দমালায় আমি তোমারে গাঁথব?
তুমি তো সহজ শব্দমালার অন্তহীন মহাকাব্য!
মা, আমি তোমাকে নিয়ে ছন্দ বুনি না
কোন ছন্দ মানাবে অঙ্গে তোমার?
তুমি তো অনন্ত ছন্দের মোহময় ঝংকার!'
প্রাণ ছুঁয়ে গেলো লেখাটা
আল্লাহ আপনার আব্বাকে সুস্থতা দিন।
তাই আমি পোষ্টের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করছি না । শুধু একটা কৌতুহলের বিস্ময় প্রকাশ করছি যা হল সালাহ্উদ্দীন এবং সালু দুটিই আমার নাম ।
পুরুষ্কার পাওয়ার আশায় এটি লিখিনি। আর আমার সন্দেহ যে আমি যত ভালোই লিখি পুরুষ্কার পাবো না। সন্দেহের অনেকগুলো কারণও আছে...যাই হোক দোয়া রাখবেন আমার আব্বুর জন্য -এটাই কামনা! মাআসসালাম
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানী সাগীরা।
(আমার পিতার মৃত্যুর সময় তার মুখে আমরা পানি দিতে পারিনি,আইসিইউ-তে ছিলেন, আমাদের প্রবেশাধিকার ছিলনা, কাচের ভিতর দিয়ে তার চলে যাওয়া দেখতে হয়।)
আপনার আব্বা-আম্মাকে নেক হায়াত ও সবসময় সুস্থ রাখুন ভালো রাখুন.....
আমিন
রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানি ছাগিরা!
রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানি ছাগিরা!
আমারটাও পড়তে পারেন-
null
মন্তব্য করতে লগইন করুন