সোনালি ধানের সরু পথ দিয়ে...
লিখেছেন লিখেছেন আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০১:০০:৪২ দুপুর
চপলা হাওয়ার তালে তালে দোলছে ধানের চারাগুলো। সোনালি ধানের মাঠ ছিড়ে যাওয়া সেই সরু কাচা পথটি যেন ‘সরু পথখানি সুতোয় বাঁধিয়া দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া’র মত আমাকে টানছে। সরু পথের দু’পাশে সবুজ ঘাস। মূল পথ ছেড়ে সে পথে পা রাখতেই এক অজানা শিহরণে নেচে উঠল সারাটা শরীর। উদাসী হাওয়ার সতেজ ছোঁয়ায় মনটা কেমন উড়্উড়ানি হয়ে গেল। ইচ্ছে করছিল পায়ের জুতাজোড়া ফেলে গায়ের জামাটা খোলে কোমরে বেঁধে পল্লী গাঁয়ের দামাল ছেলেদের মত উদাম গায়ে দৌঁড়াতে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কোন এক গাছের ছায়ায় বসে পড়বো, হাত দিয়ে কপাল থেকে ঘাম ঝেড়ে গাছের সাথে হেলান দিতেই মিষ্টি বাতাসে মোহ চলে আসবে আবার হঠাৎ করে মোহ ভেঙ্গে যাবে, হাতের খোসায় পানি নিয়ে পুকুরজলে তৃষ্ণা মিটিয়ে ধুলো মাখা পায়ে আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরে যাব। কিন্তু না, যেমন খুশি তেমনটা করতে পারলাম না। ইচ্ছেটা ইচ্ছেই রয়ে গেল। হাওয়ার তালে দোলতে দোলতে ধানের চারাগুলো সাঁ সাঁ করে আমাদের কি যেন বলছে। হয়ত ওরা আমাদের বলছে-
‘এসো হে পথিক, এসো আমাদের মাঝে
তোমায় নিয়ে মাতবো খেলায় সকাল বিকাল সাজে’
আমরা ছিলাম পাঁচ জন। আমি আলা উদ্দিন ভাই, শামসুদ্দিন আর বোরহান, সাইফু। আমাদের সবার পোষাক এক রকম হওয়ায় রাস্তায় হাটার সময় সব লোকেরাই আমাদের দিকে তাকাচ্ছে, কেউ কেউ হাসছেও। আমরাও খুব মজা পাচ্ছি। বিলের ওপাশে বাড়িথেকে দাড়িয়ে কয়েকজন পল্লী বধু আর ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আমাদেরকে দেখছে। ছোট ছেলেরা হাত নাড়িয়ে আমাদেরকে ডাকছে আমারাও তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ালাম। তারা খুশিতে আরো বেশি করে হাত নাড়াতে শুরু করল। কেউ কেউ চিৎকার করে আমাদেরকে বলতে লাগলো- ‘ওই ওই, ওবা তোঁয়ারা হত্তোন আইসতে লাইগ্গদে? এ্যাঁ, তোঁয়ারা হারু বারিত যাইবাদে?’ (হেই হেই আপনারা কোত্থেকে আসতেছেন? হ্যাঁ, আপনাারা কাদের বাড়িতে যাবেন?)
আলতো ভাবে হাত দিয়ে ধানের চারাগুলোকে ছোঁয়ে দিয়ে আমরা হেটে চললাম আমাদের গন্তব্যে কিন্তু কিছুতেই তারা আমাদের ছাড়তে চাচ্ছেনা। তাদের প্রতিও আমার মনটা কেমন দুর্বল হয়ে গেলো। সবাই দাড়িয়ে তাদের সাথে কয়েকটা ছবি তোললাম আর কণ্ঠ ছেড়ে গেয়ে চললাম- ‘ওমা অগ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কি দেখেছি? আমি কি দেখেছি- মধুর হাসি সোনার বাংলা।’ এ যেন সত্যি বিশ্বকবির অগ্রাণের সোনার ধানের মধুর হাসি! মাঠের উত্তর পূর্ব পাশে লতায় পাতায় ঘেরা উঁচু উঁচু গাছগুলো যেন বিশাল সবুজের পাহাড়। এই সবুজ পাহাড়ের ভিতর লুকিয়ে আছে বাংলা মায়ের সেই চির চেনা গ্রামগুলো। দূর থেকে বুঝার কোন উপায় নাই এর ভিতরে যে ঘর বাড়ি আছে। কি অপরূপ! মহান আল্লাহ মনের মাধুরি মিশিয়ে এক একটি গ্রামকে সাজিয়েছেন এক একভাবে। ‘কোন সে শিল্পীর জল রঙে আঁকা ছবি অনুভব তনুমন ভরিয়ে তোলে?’ মুখ দিয়ে অস্পষ্টভাবে বেরিয়ে পড়বে- সুবহান আল্লাহ!
শরৎ পরী গুটিয়ে নিয়েছে তার মেলা দেওয়া শুভ্র আঁচল। এখনো সকালে হালকা হালকা ঝরেছে ঘাসের বুকে রূপালি শিশির। পুকুর পাড়ের শুভ্রকাশফুল গুলো শুকিয়ে ঝরে পড়েছে তবে ঠান্ডা হাওয়া এখনো গায়ে হালকা পরশ দিয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতির পরতে পরতে চলছে রূপের পালাবদল। ধানের চারা গুলোর সোনালি রঙ-ই বলছে- এইতো হেমন্ত! আর কিছু দিন পরে হয়ত চাষিরা পাকা ধান ঘরে তোলবে। নতুন ধানের বানে মেতে উঠবে চাষিনির হৃদয়। এই সেই কত ব্যস্তময় দিন কাটাবে বাড়ির ছোট বড় সবাই। মৌ মৌ গন্ধে ভাসবে সারা গ্রাম। শুকনো ধান গোলায় তোলে শুরু হবে চারিদিকে পিঠাপুলির উৎসব, নতুন ধানে ধানে হবে নবান্ন! ভাবতে ভাবতে আমরা আমন ধাননের মাঠ ছেড়ে চলে এলাম মস্তবড় এক দিঘির পাড়ে।
‘ধল- দীঘিতে সাঁতার কেটে আনব তোলে রক্ত- কমল,
শাপলা লতায় জড়িয়ে চরণ ঢেউ- এর সাথে খাবযে দোল।
হিজল ঝরা জলের ছিটায় গায়ের বরণ রঙিন হবে
খেলবে দীঘির ঝিলিমিলি মোদের লীলা কালোৎসবে!’
(যাব আমি তোমার দেশে -জসীম উদ্দীন)
দীঘির পাড়ে আম জাম কাঁঠাল হরেক রকম গাছের সারি। দিনের বেলায়ও এখানে আঁধার-আঁধার। একা থাকলে কেউ সত্যি সত্যি ভয় পাবে। আগের দিনে সন্ধ্যা বেলায় গাঁয়ের বধূরা দীঘির ঘাটে গট ভরতে যেত। আমর মনে পড়ে গেল অনেক আগে আমাদের বাড়িতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা, তখন আমরা অনেক ছোট। ভাতের মউ দেওয়ার জন্য সন্ধ্যায় সবাই ‘বুইজ্জে পুকুর’-এ পানি আনতে যেত। একদিন মাগরিবের সময় আমাদের বাড়ির লুনার মা পানি আনতে গেলে ফিরে এসে তিনি কেমন অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। বাড়ির বুড়াবুড়িরা বলতে লাগল ওনাকে নাকি আচরে ধরেছে। অনেকক্ষণ ঝাড়ফুকের পর তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এই ভয়ে অনেক দিন কেউ ঐ পুকুর আর থেকে পানি আনতে যায়নি। এখনো রাতের বেলায় ঐ পুকুরের পাশ দিয়ে হেটে যেতে ভয়ে পথচারীদের গা শিউরে উঠে। তবে ভাতের মউ’র জন্য পানি আনতে এখন আর ঐ পুকুরে যেতে হয় না।
যাক, সে অন্য কথা। হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এলাম দীঘিটির উত্তর পুর্ব পাড়ে। এই দীঘিটি দেখতে একেবারে আমাদের বাড়ির বুইজ্জে পুকুরের মত। আমার দাদির শ্বাশুড়িও নাকি জানত না এই পুকুরটি কখন খনন করা হয়েছিল। অনেক পুরানো হওয়ায় সবাই এই পুকুরকে বুইজ্জে পুকুর বলে। দীঘিটির উত্তর পাড়ে মাঝারি আকারের একটি জামে মসজিদ। পূর্ব পাশে কিছু কবরও আছে। করবগুলো দেখে হঠাৎ মৃত্যুর কথা মনে পড়ে গেল। শামসুদ্দিনের নানা- নানির কবরও এখানে। বলায় হয়নি- আমাদের যাত্রা ছিল শামসুদ্দিনের নানুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। উত্তর পরুয়া পাড়ার এক নিভৃত পল্লীতে ওর নানুর বাড়ি। আমরা ওর নানা নানির কবর যিয়ারত করে অবশেষে পৌঁছে গেলাম ওর নানুদের ঘরে। এখনো আমার মন বলে আবার কখন আমন ধানের মাঠ ছিড়ে যাওয়া সেই সরু পথ দিয়ে এঁকে বেঁকে হেটে হেটে দীঘির পাড়ের গাছের ফাঁক দিয়ে তার নানুর বাড়িতে যাব!
(অপ্রকাশিত ভ্রমন)
বিষয়: বিবিধ
১৪৪৭ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খেজুর রস খেতে ইচ্চে কোরচে
খালে সাতার কাটতে ইচ্চে কোরচে
শাপলা ফুল তুলতে ইচ্চে কোরচে
গাভীর কাচা দুধ খেতে ইচ্চে করচে
পোষ্টটি পড়ে কষ্ট পেলুম মাইনাচ [এটা লেখকের প্রতি ভালোবাসার মাইনাচ]
ধন্যবাদ কবি সাহেব সুন্দর ভ্রমন কাহিনী উপহার দেয়ার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন