‘বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা’: থার্ড ইয়ারে প্রথম ক্লাশ

লিখেছেন লিখেছেন আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ ২৪ জুন, ২০১৩, ০৮:১৫:১৮ রাত

২৪ জুন, সোমবার, ২০১৩ ইং। অনেক দিন পর আজকে কলেজে গেছি। থার্ড ইয়ারে আজকেই আমার প্রথম ক্লাশ। অনেক আগেই ক্লাশ শুরু হয়ে ছিল কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি। কেন যেন আমার ক্লাশ করতে ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে সব ক্লাশ একসাথে শেষ করে নিজেই ক্লাশ নেওয়া শুরু করি! ফাস্ট ইয়ারে ১৩ কি ১৪ দিনের মতো ক্লাশ করেছিলাম আর সেকেন্ড ইয়ারে মাত্র ১ দিন, তাও আবার ৩ ঘন্টার মধ্যে ২ ঘন্টা! যাক সে কথা।

আজকে একটু ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। গোসল করে, নাস্তা সেরে সাড়ে আটটার দিকে বের হলাম কলেজের উদ্দেশ্যে। টমটম থেকে কাঠগড়ে নামতেই ১০ নম্বর মিনি বাস একটা পেয়ে গেলাম। ভাগ্যটা ভালো। সকাল বেলায় কাঠগড়ে ১০ নম্বর গাড়ি পাওয়া যথারীতি ভাগ্যের ফেবার বলতে হবে। অফিস টাইম। যাত্রীরা সবাই ফিটফাট। একেক জনের গা থেকে একেক রকম সেন্টের সুগন্ধি বের হচ্ছে। গাড়ির পরিবেশ একটু মৌঁ মৌঁ করছিল। সূর্যের তেজও কম, মোটামুটি কম্পোরটেবলি বারিক বিল্ডিং এসে পৌঁছলাম। সেখান থেকে টেম্পুতে উঠলাম। চাপাচাপি করতে করতে একজন আরেকজনের সাথে লেগে গেলাম। তারপরও এসিসটেইন্ন্যা বলে কি- ‘দাদা আরেকটু চাপেন, আরেকটু চাপেন।’ আল্লাহর রহমত মাথায় নিয়ে চাপাচাপির ভিতর দিয়ে কোনমতে কলেজে পৌঁছে গেলাম।

আমাদের ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি একজন মেয়ে! আমাদের ক্লাশেরই, আগে থেকেই চিনতাম কিন্তু নাম জানতাম না! সে বললো- ‘হায়, এবার আমাকে চিনতে পারছো?’, ‘মানে?’, সে বললো- ‘আমিই শিমু’। ‘ও আচ্ছা তুমিই শিমু!’ ঘটনা হচ্ছে ফেবুতে আমাদের একটি গ্রুপ আছে- “বাংলা বিভাগ‘০৯-১০”। ও সেখানে নতুন জয়েন দিয়েছে, আমি ওকে চিনতে পারছিলাম না। চ্যাটে ও বলেছিল তুমি আমাকে চিনো কিন্তু নাম জানো না। সত্যি সত্যিই দেখি আমি ওকে চিনি। আজকে আবার নতুন করে চিনলাম। আর কেন যেন ওর সাথেই আমার প্রথম দেখা হয়ে গেলো। যাই হোক আস্তে আস্তে ক্লাশের আরো ছেলে মেয়েরা আসতে লাগলো।

৩০৬ নং রুম, রবীন্দ্র গ্যালারি। এখানেই আমাদের ক্লাশ হবে। ২০-২৫ জনের মতো উপস্থিতি। গ্যালারীতে ডুকতেই আমার মনটা হঠাৎ ধুক করে উঠলো। ফাস্ট ইয়ারে আমাদের যে গ্যালারিটা উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ, কথাবার্তায় মুখরিত থাকতো সেই গ্যালারি আজ কেমন সুনসান, নিরব নিস্তব্ধ, ফাঁকা ফাঁকা! কারো মুখে তেমন কোন কথা নাই। সবার মুখে একটু আধটু সংযত হাসি। চেয়ার টেবিলগুলো কেমন বিষন্ন- ধুলো মলিন। ফাস্ট ইয়ারে সবাই ছিলাম নতুন। কেউ কাউকে চিনতাম না। একে অপরের সাথে কথা বার্তা, ভাব আদান প্রদান চলতো। নতুন ক্লাশ, নতুন ইয়ার, নতুন বন্ধু বান্ধব সব মিলে একটা উচ্ছ্বাস- আনন্দঘন পরিবেশ ছিল।

থার্ড ইয়ারে এসে আজকের এ সময়ে সে পরিবেশটা যেনো কোথায় হারিয়ে গেলো। সকাল বেলার কিচিরমিচির করা পাখিগুলো যেন সূর্যের আলো বাড়তে বাড়তে জীবনের প্রয়োজনে কোথায় উড়ে গেলো। কোন এক অজানা পথে পাড়ি দিলো? সন্ধ্যায় আবার ফিরবে কিনা কে জানে? সবাইকে চিনতাম না, অনেকের সাথে কথাও বলতাম না কিন্তু আজকে সবাইকে যেন হৃদয় থেকে অনুভব করতে লাগলাম। ক্লাশে সবাই কেমন যেন সংযত, সবার মাঝে বেড়েছে আত্মমযর্দাবোধ, একটু একটু আত্মঅহমিকাও!!! ও কে? সে কেমন? তার সাথে কথা বললেও কি না বললেও কি? সব মিলিয়ে সবাই কেমন যেন একটু ব্যস্ত! শুধু কি আমিই সে আমি রয়ে গেলাম?

এরি মধ্যে ১০ টা বেজে গেল। নিদির্ষ্ট সময়ে ম্যাম এসে হাজির। নতুন ম্যাম, আমি আগে কখনো দেখিনি(নিয়মিত গেলেইতো দেখবো)। বয়স ৩০/৩২‘র কোটায়। থ্রি পিচ পড়া। ঠোটে অনুজ্জ্বল লাল লিপস্টিক! চুল মধ্যখানে সিঁথিকাটা, পিছনে কোপা! সাপের মাথার মতো সুন্দর নাক! সব মিলিয়ে দারুন রোমান্টিক একটি চেহারা! ভূমিকা শেষ করে ম্যাম পড়া শুরু করলেন। বিষয় ‘বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা’। লেখক প্রমথ চৌধুরী। ম্যাম যা পড়ালে তা থেকে আমি মুঠামুঠি বুঝলাম যে- আগে সমাজের উচ্চ শ্রেনির লোকেরাই সাহিত্য রচনা করতো। আস্তে আস্তে এই রীতি ভেঙে যায়, সমাজের সব ধরনের লোকেরাই সাহিত্য রচনা শুরু করে।

লেখক নতুন যুগের একটি লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন- মাসে মাসে পত্রিকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিটি পত্রিকায় সাহিত্য বিষয়ক কোন না কোন পেইজ থাকছে। এই বর্ধমান পত্রিকায় লেখা দিতে দিনে দিনে লেখকও বাড়ছে। কিন্তু প্রতিদিন পত্রিকায় চাপানোর জন্য নতুন লেখকরা তড়িঘড়ি করে যা লিখছে তার সাহিত্যিক মান কতটুকু থাকছে? আর পাঠকরাই বা তা কতটুকু গ্রহণ করছে? অল্প সময়ে বড় কোন গল্প, কবিতা বা উপন্যাস রচনা করা সম্ভব না। তাই দিন দিন ছোট ছোট গল্প ও কবিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে!

লেখক প্রমথ চৌধুরী উদাহরণ দিয়েছেন- হাতের বালা একটু ঢিলেঢালা হলে তাতে সমস্যা নাই, তা কারো নজরেও পড়ে না কিন্তু আঙ্গুলের আংটি একটু ঢিলে হলেই তা হাতে বেমানান বেঢ়প লাগে! আর সহজেই তা মানুষের চোখে ধরা পড়ে। কাজেই ছোট ছোট গল্প কবিতা লিখতে গিয়ে নতুন লেখকদের তিনি পরামর্শ দিয়েছেন কবিতার বিষয় বস্তু শব্দ-ছন্দ-ভাব সব যেন আঙ্গুলের আংটির মতো ফিটফাট হয়। আর পাঠকদের কাছে তাই দারুন উপাদেয় হবে! অন্যথায় বর্তমানে যা হচ্ছে- আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি।

আস্তে আস্তে ম্যাম উপসংহারে আসলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে ম্যামের দিকেই চেয়ে রইলাম। ম্যাম দারুন পড়ালেন। আমিও খুব উপভোগ করলাম! ক্লাশ শেষ হয়ে গেলো। আমরা যে যার মতো করো নীড়ে ফেরা পাখির মতো চলে এলাম! তখন সূর্যটা ঠিক মাথার উপরে।

পাদটীকাঃ কোকিলের(উচ্চ শ্রেণি) স্তর ছেড়ে সাহিত্য রচনা আস্তে আস্তে কাকের(সর্ব সাধারণ) স্তরে নেমে আসে। কাকের মতো কবি সাহিত্যিক বেড়ে গেছে, কমে গেছে লেখার মান। আমরা যারা বর্তমান সময়ে লেখালেখি করছি আসুন কাকের স্তর ছেড়ে কোকিলের স্তরে যেতে না পারলেও অনন্ত ময়না-শালিকের(উপরোক্ত দুই শ্রেণির মাঝামাঝি) স্তরে উঠার চেষ্টা করি। তড়িঘড়ি করে না লিখে একটু ভেবে চিন্তে লিখি। হয়ত আমাদের লেখার মান আরো বাড়বে!

বিষয়: সাহিত্য

১৮৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File