শেকড়ের সন্ধানে
লিখেছেন লিখেছেন আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ ০৫ মে, ২০১৩, ০১:২৯:১৬ রাত
(গহিরা ভেড়ী বাঁধের পাথরের উপর দাঁড়িয়ে ক্যামরা বন্দী ছোট চাচা ও মিনহাজ)
আমার আজ সেখানে যেতে ইচ্ছে হয় যেখানে আছে আমার মা। আছে আমার ছোট্ট বোনটি। আরো আছে আমার অনেক দিনের পরিচিত-অপরিচিত সব মুখ। যেখানে মানুষের প্রতি মানুষের রয়েছে অপত্য স্নেহ, অকৃত্রিম ভালবাসা। সব মানুষ যেখানে এক অদৃশ্য মায়ার সূতোয় গাঁথা। আমার আজ সেখানে যেতে খুব ইচ্ছে হয়! যেখানে শীতল মাটির নিচে পরম সুখে চোখ মুদে আছে আমার বাপ দাদারা! আছে আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর লতাপাতারা। আমি সেখানে যেতে চাই। শীতল মাটির কোমল স্পর্শে পেতে চাই!
(স্কুল ভিটা থেকে আমাদের বাড়ি)
যেখানে কেবল সবুজ আর সবুজ, যেন সবুজ শাড়ি পড়ে আছে গাঁয়ের লক্ষী বউটি-প্রতিটি পল্লী! বাউল বাতাসে খেলা করে মাঠ ভরা সোনালি ধান, শুনা যায় হাজারো গাছের পাতার ভীড়ে ভীড়ে অচিন পাখিদের মিষ্টি গান আর চপল হাওয়ার নায়ে চড়ে ঢেউ-এ ঢেউ-এ আসে নাম না জানা অসংখ্য ফুলের মিষ্টি সুঘ্রাণ। চারদিক সুরভিত করে তোলে! সজীব নিঃশ্বাসে সতেজ হয়ে উঠে প্রাণ! এ মন আজ চঞ্চল-ব্যাকুল হয়ে উঠে সেখানে যেতে! যেখানে অথৈ দিঘীতে দোল খেয়ে যায় কলমি লতা। রক্ত-পদ্মগুলো হেলে দোলে যেন করে যায় এক গোপন আহ্বান! আমি সেখানে যেতে চাই। অথৈ দিঘিতে সাতার কেটে ক্লান্ত হয়ে রক্তপদ্ম তোলে আনতে চাই!
{আমাদের উঠোনে হাসান(ভাগিনা)}
আমি আর থাকতে চাই না -ইট পাথরের এই মায়া-মমতাহীন পাষাণ শহরে! এখানে পৌর ভাগাড়ের পঁচা দুর্গন্ধে দূষিত বাতাস! কাকের কর্কশ কা কা রব! এক্সপেয়ার ডেইডহীন যন্ত্রযানের কালো ধোয়া, দীর্ঘ যানযট, গাড়ির ভ্যাঁ বুঁ-তে অতিষ্ট জীবন! ইটের দালানে থাকতে থাকতে পিছঢালা পথে হাটতে হাটতে একানকার মানুষগুলোও কেমন ইট পাথরের মতো- কৃত্রিম! একেকটা মানুষ যেন রক্তে মাংসে গড়া একেকটা প্রাকৃতিক রোবট! কিসের প্রতিবেশী? কিসের আত্মীয়? এখানে মানুষ নিজেকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, ‘অন্ন চিন্তা অর্থ চিন্তা ছাড়া অন্য চিন্তা তাদের মাথায়ও আসে না’! রক্ত সম্পর্কও এখানে ম্লান! অশুদ্ধ জীবনাচরণের জন্য এখানে প্রতিটি মানুষ এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত!
(খোদ্র্দ গহিরা সরকারী প্রাঃ বিদ্যালয়ঃ যেখানে কেটেছিল আমার শৈশক কৈশোরের অনেগুলো উচ্চল দিন)
আমি আর থাকতে চাই না এখানে। আমি সেখানে ফিরে যেতে চাই- যেখানে ভোর বিহানে দূর হতে ভেসে আসে মুয়াজ্জিনের ‘আস্সালাতু খায়রুম মিনান্নাওম’ বলে ডেকে উঠা -সেই পরিচিত সূর। যেখানে গেলেই পাব মোরগ ডাকাভোর, শুনতে পাবো দোয়েলের মিষ্টি শিস টুনটুনির টুন টুন! আমি সেখানে ফিরে যেতে চাই! যেখানে শ্রান্ত দুপুরে বটের ছায়ায় বসে রাখাল বাঁশি বাজায়। অবশেষে সন্ধ্যা নেমে আসে। রোমান্সকর গোধূলি ছড়িয়ে দিনের ক্লান্ত সূর্যটা ডুবে যায়। ক্লান্ত চাষীরা লাঙল কাঁধে করে ঘরে ফিরে যায়।
(গহিরা বালুচরে কোন একসময় আমরা ক’জন)
আস্তে আস্তে রাত্রি নেমে আসে ঘন গাছের চায়ার মতো কালো আঁধারে ঢেকে যায় চারদিক। অন্ধকারে ডুবে যায় পুরো গ্রাম। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠে মিটি মিটি প্রদীপ। উঠোনে বসে কিচ্ছা কাহিনী কিংবা পুঁথি পাটের আসর। ঝিঁ ঝিঁরা ঘুমের নুপুর বাজাতে শুরু করে, জোনাকিরা উড়ে বেড়ায়, শুরু হয় নিশাচর পাখিদের চেঁছামেছি। সারা গ্রাম ঘুমের ঘুরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। চারদিকে নিরব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। বয়ে যায় প্রকৃতির শীতল সমীরণ। গাছের পাতাগুলো শির শির করে উঠে। আমি সে গ্রামে ফিরে যেতে চাই। একা একা রাত জেগে স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারী চাঁদ দেখে পুলকিত হতে চাই। জোনাকির উড়ে বেড়ানো দেখতে চাই। নিশাচর পাখিদের চেঁছামেছি শুনতে চাই। শীতল সমীমরণে মন ভরাতে চাই!
(সাগরে তলিয়ে যাওয়া গ্রামের কিছু অংশ)
এক কথায় আমি আমার সেই জন্মস্থান পল্লী গাঁয়ে ফিরে যেতে চাই! আমার দাদির মুখে শুনা সেই সোনার বাংলায় ফিরে যেতে চাই! যেখানে গোয়াল ভরা গরু আছে, আছে গোলা ভরা ধান। যেখানে বাটা ভরা পান আছে আছে মুখ ভরা গান। আমি সেখানে ফিরে যেতে চাই!
(গহিরার সবুজ ধানের মাঠ ছেড়ে হেঁটে যাচ্ছে পথিক)
বিষয়: সাহিত্য
৩১৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন