জোড়া পাথর
লিখেছেন লিখেছেন ফেনীর কণ্ঠ ১১ মার্চ, ২০১৩, ০৫:৩১:০৫ বিকাল
কানে একটি কথা বেশকিছু দিন ধরেই আসছে দুইটি পাথর নাকি আছে যা রহস্যময়। গ্রামজুড়ে এমনকি পাশের গ্রামগুলোতেও নাকি এ জোড়া পাথর সম্পর্কে বেশকিছু অলৌকিক বিশ্বাস রয়েছে। আর সেই বিশ্বাসে জোড়া পাথর দিন দিন আরও রহস্যের ধূম্রজাল তৈরি করছে। সকালে বের হয়ে গেলাম। কেননা বগুড়া শহর থেকে আরও ৩৫ কিমি. ভেতরে সোনাতলা উপজেলা আর উপজেলা থেকে আরও ১০ কিমি. ভেতরে গেলেই কাবিলপুর গ্রাম, সেই গ্রামেই এ রহস্যময় জোড়া পাথরের অবস্থান। বাসে করে গ্রামের খড় ছড়ানো আঁকাবাঁকা রাস্তায় সকালের মনোরম দৃশ্য সবাইকে মুগ্ধ করে। এক সময় বাসের হেলপার বলল, আপনারা কাবিলপুর এসে গেছেন। বাস থেকে নামার পর এলাকায় জোড়া পাথরের কথা বলতেই সবাই দেখিয়ে দিল। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি ঠিক ডানদিকে মাত্র ৩ মিনিটের রাস্তা হাঁটলেই সন্ধান মেলবে রহস্যময় সেই জোড়া পাথরের। জনমানবহীন এলাকা দেখতেই গা ঝিম ঝিম করছে। নিশ্চুপে দাঁড়ানো এ জোড়া পাথরটিকে ঘিরেই বছরের পর বছর রহস্য হচ্ছে আর তার বিশ্বাসে জড়িয়ে আছে। জোড়া পাথর সম্পর্কে জানতে চাইতেই, মতিবালা প্রাং এলাকার প্রবীণ নারী তিনি বললেন, তালতলার ওই জোড়া পাথরের মাথা দুটি যেদিন এক সঙ্গে লেগে যাবে সেদিন দুনিয়া ধ্বংস হবে। ঠিক একই সুরে সুর মেলালেন গ্রামের আরেক মহিলা মালা বানু। তিনিও জানালেন, কেয়ামত হবে এ দুই পাথর একসঙ্গে লেগে গেলে। তারা নাকি তাদের দাদাদের কাছে এ কথা শুনেছে আবার তাদের দাদারা শুনেছে তাদের দাদাদের কাছ থেকে। আশ্চর্য হলেও সত্য, এলাকার অধিকাংশ মানুষ এ কথা বিশ্বাস করেন। দিন দিন নাকি এ পাথর দুটি এগিয়ে কাছাকাছি আসছে। দৈর্ঘ্য,ে প্রস্থে ও উচ্চতায় বৃদ্ধি পাচ্ছে পাথর দুটি। মাটি থেকে সমান্তরালভাবে ওপরের দিকে ওঠে যাওয়া দুটি পাথরের মধ্যে পূর্ব দিকের পাথরটির উচ্চতা সাড়ে ৫ ফুট এবং পশ্চিম দিকের পাথরটির উচ্চতা ৫ ফুট। প্রস্থের দিকে ১৪ ইঞ্চি-ই দুটি পাথর তবে এদের প্রস্থ নাকি আগে ৬ ইঞ্চি করে ছিল জানালেন, আরেক বয়োজ্যেষ্ঠ ৭০ বছর বয়সী ইলিয়াস কবির। তিনি আরও জানালেন, জনশ্র“তিতে আছে, জোড়া পাথরের স্থান ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী থেকে এক সময় জলকুমির এসে রহস্যময় জোড়া পাথর দুটিতে শ্রদ্ধাভরে মাথানত করে চলে যেত। সে অনেক আগেকার কথা। তবে পাথরটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তিনিসহ অনেকেই জানালেন।
ছোট্ট একটি তালগাছের নিচে রহস্যময় পাথর দুটির জš§। তবে এদের সম্পর্কে কেউ সঠিকভাবে কিছু বলতে পারে না। কারও কারও মতে এ পাথর দুটি পুরাকালে এ অঞ্চলের কোন অধিপতি হাতি বেঁধে রাখতেন। আবার অনেকে এ পাথর দুটিকে প্রকৃতি প্রদত্ত মঙ্গলের প্রতীক মনে করেন। বর্তমানে এ অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই এ পাথর দুটিকে ভক্তি করে থাকেন। কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে সফল হওয়ার জন্য অনেকেই এ পাথর দুটিকে উদ্দেশ্য করে মানত করেন। তারপর উদ্দেশ্য পূরণ হলে পাথরের পাদদেশে দিয়ে আসে সিঁদুর, ধূপধোঁয়া ইত্যাদি।
এক সময় তালতলার নিচে অলৌকিক জোড়া পাথরের পাদদেশে পূজা হতো, মেলা বসত। দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ লোক এসে তাদের মনোবাসনা পূরণের জন্য এখানে জমায়েত হতেন। গোরস্থানসংলগ্ন কিছুটা উঁচু জায়গায় খাড়াভাবে অবস্থিত ৫ ফুট উচু ২টি রহস্যময় পাথর ঠিক কত বছর আগে থেকে বগুড়া জেলার সোনাতলা উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের জঙ্গলে আবিষ্কৃত হয়েছে তা অনুমান করে কেউ বলতে পারেন না। তবে জোড়া পাথরটির স্থান এ অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানসহ সব ধর্মের লোকজনের কাছে একটি তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত।
এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা জানালেন, সোনাতলা উপজেলায় বিক্ষিপ্তভাবে কিছু প্রতœতত্ত্ব সম্পদ রয়েছে। জোড়া পাথরের স্থানটি প্রায় দুই বিঘা পরিমাণ জমি নিয়ে বেষ্টিত হলেও এর বেশিরভাগ অংশজুড়ে রয়েছে গণকবরস্থান। আরেকটি আশ্চর্য বিষয় হল সেখানে রয়েছে দুটি ২৫ হাত লম্বা কবর। তারা নাকি স্বামী-স্ত্রী তবে তাদের সম্পর্কেও কেউ-ই সঠিক তথ্য দিতে পারলেন না। তারা আরও জানান, জোড়া পাথরটি প্রতœতত্ত্ব সম্পদের একটি প্রাচীন নিদর্শনও হতে পারে। আবার কেউ কেউ এ পাথর দুটি সম্পর্কে মন্তব্য করেন, অনেক দিন আগের কথা। সে সময় সোনাতলা এলাকাটি ময়মনসিংহের দেওয়ানগঞ্জ থানার অধীনে ছিল। তখন বারভুঁইয়ারা বাংলা শাসন করতেন। বারভুঁইয়ার একজন ঈশা খাঁ বিদ্রোহ করেন দিল্লিশ্বরের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহ দমনে সেনাপতি মানসিংহ আসেন বাংলায়। ছাইনি ফেলেন সোনাতলায় কাবিলপুরে। কিন্তু মানসিংহ যেখানেই যেতেন সেখানেই তার পছন্দের হাতিটা নিয়ে যেতেন। তাই এখানে ছাইনি ফেলার সময় হাতি বাঁধার জন্য দুইটি পাথর পুঁতে সেখানে হাতি বেঁধে রাখতেন এমনটাই নাকি শুনেছে এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি সুশের দাশ। তবে তার এ কথার সঙ্গে একমত নয় এলাকার আরেক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ইউসুফ সরদার। তিনি বললেন অন্য কথা, পীর ফতেহ আলী মতান্তরে ‘ফতেহউল্লা’ সবসময় ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতেন বলে তিনি ঘোড়া পীর নামে পরিচিত ছিলেন। এই পীর সাহেব এখানেই ঘোড়া বেঁধে রাখতেন বলে জনশ্র“তি আছে।
প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর স্থানীয় প্রশাসন কিংবা এলাকার কোন সংগঠন থেকে পাথর দুটির ব্যাপারে কোন যতœ নেয়া হয় না। আর সে কারণে প্রকৃতির এ আশ্চর্য দুটি পাথর অবহেলায় শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। প্রতœতত্ত্ব সম্পদের এ আশ্চর্য নিদর্শনসহ আশপাশ এলাকার অনেক সম্পদ সঠিক সংরক্ষণ করার ব্যাপারে অনেক সুধীজন দাবি জানিয়েছেন। পাথর দুটি যেখানে অবস্থান করছে সে এলাকাটি অরক্ষিত। এ ব্যাপারে এ এলাকার চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন জানান, প্রায় ৩০ বছর আগে পাথর দুটির রহস্য উšে§াচনের জন্য তা তোলার ব্যাপারে অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু ধর্মভীরু এলাকার লোকদের তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে গত ৬ বছর আগে বেলাল নিজেই পাথর দুটির রহস্য জানার জন্য পশ্চিম পাশের পাথরটি মাটি থেকে তুলে ফেলার চেষ্টা করেন কিন্তু পাথরটি কোথা থেকে শুরু তা গভীরভাবে মাটি খননের পরও জানা যায়নি। সেখানে অলৌকিক কিছু পাওয়া যায়নি তবে মাটির নিচে যত খোঁড়া হয়েছে পাথরটি অদ্ভুত লেগেছে সবার কাছে।
বিষয়: বিবিধ
১৪৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন