বাংলাদেশের মুসলমান ও ১লা বৈশাখ উদযাপন

লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ১৩ এপ্রিল, ২০১৯, ০৩:৪২:৪৬ রাত



বাংলাদেশে ইসলামের দাওয়াত পৌছে ছিল প্রায় সাহাবীগণের আগমনের মাধ্যমে যার প্রমাণ বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন প্রাচীন মসজিদের ফলক থেকে আমরা জানতে পারি। আর ইসলামের আগমন ঘটেছিল আউলিয়াকেরামগনের দাওয়াত ও বিরত্বের মাধ্যমে। অনেক চরাই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের কাছে থেকে পাক-ভারত উপমহাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্থান নামে দুটি দেশের অভ্যুদয় ঘটে। পরবর্তীতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল তথা পাকিস্থানের কেন্দ্রিয় শাসনের অনিয়ম ও শোষনের বিরূদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২০০০ কিঃমিঃ দূরে থাকা জনগোষ্ঠী বিদ্রোহ ঘোষনা করে। এভাবে ১৯৭১ সালের ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা আজও গর্বের সাথে পত পত করে উড়ছে। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এদেশে আরও অনেক ধর্মাবলম্বির বসবাস আছে যার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু, বৌদ্ধ ও খিষ্ট্রান লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করে। এদের প্রায় সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং নিজেকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে।

বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। যার প্রচলন হয়েছিল মূলতঃ সম্রাট আকবরের আমল থেকে। এর পূর্বে এ অঞ্চলে হিজরী সনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কৃষকের নিকট থেকে খাজনা তোলার সুবিধার্থে সম্রাট আকবর চন্দ্র মাসের হিসাব বাদ দিয়ে সূর্যের মাসের হিসাবে বাংলা সাল প্রবর্তন করেন। এ সময়ে বাংলার মানুষেরা ফসল তোলার আনন্দে বিভিন্ন পিঠা-পায়েশ ও ভাল ভাল খাবারের আয়োজন করতো। ফসল তোলার পর কৃষকেরা কিছুটা অবসর পেতো। এই অবসরে তারা আত্মীয়-স্বজনরা একে-অপরের বাড়ীতে বেড়াতে যেত শুভেচ্ছা বিনিময় করতো। এই অবসরের মাঝেই ছিল তাদের বিনোদন। এই বিনোদনে প্রায় সকল ধর্মাবলম্বীই অংশগ্রহণ করতো। এ সময়ে মুসলমানরা তাদের ফসলের একটা অংশ মসজিদ-মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করতো। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন পূজা-অর্চনার ও বিভিন্ন মেলার আয়োজন করতো। এছাড়া খ্রিষ্ট্রান ধর্মাবলম্বীরা গীর্জায় মোমবাতি জ্বালিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতো। বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা যার যার ধর্ম মতে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতো।

বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানাতে বিংশ শতাব্দীর ৭০ দশকে যুক্ত হয় রমনার বটমূলে গানের আয়োজন। ৯০ দশকে যুক্ত হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটির চারুকলা ইনিষ্টিটিউটের সামনে থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা ও মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন যেখানে হিন্দু ও খ্রীষ্ট্রান ধর্মের একটা বিশাল প্রভাব লক্ষ্যনীয় যা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলীম সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। আর বিপত্তিটাই এখানে। বিভিন্ন আলেম-ওলামা বিভিন্ন সময়ে মঙ্গলযাত্রার বিরূদ্ধে ফতোয়া দেওয়ার পরেও তুলনামূলক কম ইসলাম ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন লোকজন (বড় বড় ডিগ্রীধারী) এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহন করে থাকে। তারা নিজেদেরকে সেক্যুলার, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে থাকে। আবার কিছু কিছু মুসলমান নববর্ষের বিরূদ্ধে চরম বিদ্বেষ পোষন করে থাকে। আর কিছু মুসলমান আছে যারা নিজেদেরকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহন করে না কিন্তু পরিবারের সকলকে সাথে নিয়ে ভাল ভাল পোশাক-আশাক পরিধান করে, ভাল ভাল খাবার-দাবারের আয়োজন করে ও দর্শনীয় স্থান গুলোতে পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঘোরাঘুরি করে থাকে। আবার কোন কোন মুমিন মুসলমান নববর্ষের প্রথম ‍দিনটা দুই রাকাত নামাযের মাধ্যমে শুরু করে থাকেন।

এখন কথা হলো, নববর্ষ পালন সম্পর্কে ইসলাম কি বলে ?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

“প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ঈদ রয়েছে, আর এটা আমাদের ঈদ।” [বুখারী: ৯৫২; মুসলিম: ৮৯২]

বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহঃ) এ সম্পর্কে বলেন-

“উৎসব-অনুষ্ঠান ধর্মীয় বিধান, সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেরই একটি অংশ, যা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই আমি একটি নির্দিষ্ট বিধান এবং সুস্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।’ (সূরা আল-মায়িদাহ, ৫:৪৮)

‘প্রতিটি জাতির জন্য আমি অনুষ্ঠান [সময় ও স্থান] নির্দিষ্ট করে দিয়েছি যা তাদেরকে পালন করতে হয়।’ (সূরা আল-হাজ্জ্ব, ২২:৬৭)

আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণিত:

“রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন [মদীনায়] আসলেন, তখন তাদের দুটো উৎসবের দিন ছিল। তিনি (সা.) বললেন, ‘এ দুটো দিনের তাৎপর্য কি?’ তারা বলল,‘জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ দুটো দিনে উৎসব করতাম।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে এদের পরিবর্তে উত্তম কিছু দিয়েছেন: ইয়াওমুল আদহা ও ইয়াওমুল ফিতর ।’” (সূনান আবু দাউদ)

মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ-“আমি জ্বিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোন কারণে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা আয যারিয়াত, -৫৬)

♦আমরা অনেকেই মনে করি নতুন বছরের সাথে মানুষের কল্যাণের সম্পর্ক আছে ?

নতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে, দূরীভূত হয় পুরোনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানি - এধরনের কোন তত্ত্ব ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়, বরং নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতি-পুজারী মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার অবশিষ্টাংশ। ইসলামে এ ধরনের কুসংস্কারের কোন স্থান নেই।

এমনকি পয়লা মুহাররামকে নববর্ষের সূচনা হিসেবে গণনা করা শুরুই হয় নবীর (সা.) মৃত্যুর বহু পরে উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা.) শাসন আমলে। এ থেকে বোঝা যায় যে, নববর্ষ ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা তাৎপর্যহীন, এর সাথে জীবনে কল্যাণ-অকল্যাণের গতিপ্রবাহের কোন দূরতম সম্পর্কও নেই, আর সেক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষের কিই বা তাৎপর্য থাকতে পারে ইসলামে?

আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন-

“নিশ্চয়ই যে কেউই আল্লাহর অংশীদার স্থির করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন, আর তার বাসস্থান হবে অগ্নি। এবং যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।” (আল-মায়িদাহ,-৭২)

♦সূর্যকে স্বাগত জানানো ও বৈশাখকে সম্বোধন করে স্বাগত জানানো:

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন-

“আমি তাকে ও তার জাতিকে দেখেছি, তারা আল্লাহকে ছেড়ে সূর্যকে সিজদা করছে এবং শয়তান তাদের কার্যাবলীকে তাদের জন্য শোভনীয় করেছে...” (সূরা আল নামল-২৪)

♦নববর্ষে মুখোশ নৃত্য, গম্ভীরা গান ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিল:

ইসলামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সকল প্রকার মিথ্যা দেবতার অবসান ঘটিয়ে একমাত্র প্রকৃত ইলাহ, মানুষের স্রষ্টা আল্লাহর ইবাদাতকে প্রতিষ্ঠিত করা,যেন মানুষের সকল ভক্তি, ভালবাসা, ভয় ও আবেগের কেন্দ্রস্থলে তিনি আসীন থাকেন। অপরদিকে শয়তানের ষড়যন্ত্র হচ্ছে বিবিধ প্রতিকৃতির দ্বারা মানুষকে মূল পালনকর্তার ইবাদত থেকে বিচ্যুত করা।

আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেছেন-

“কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে [জীবন্ত বস্তুর] ছবি তৈরীকারীরা।” [বুখারী: ৫৯৫০; মুসলিম: ২১০৯]

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

“যে কেউই ছবি তৈরী করল, আল্লাহ তাকে [কিয়ামতের দিন] ততক্ষণ শাস্তি দিতে থাকবেন যতক্ষণ না সে এতে প্রাণ সঞ্চার করে, আর সে কখনোই তা করতে সমর্থ হবে না।” [বুখারী:২২২৫; মুসলিম: ২১১০]

♦নারীকে জড়িয়ে বৈশাখকে সম্বোধন করে যেসব অশ্লীলতার সৃষ্টি হয়-

রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেন-

“আমি পুরুষের জন্য নারীর চেয়ে বড় কোন ফিতনা রেখে যাচ্ছি না।” [বুখারী: ৫০৯৬; মুসলিম:২৭৪০]

মহান আল্লাহ্‌ বলেন- “তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। অবশ্যই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা।” (সূরা আল ইসরা, ১৭:৩২)

“হে মানুষ! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র বস্তু আছে তা থেকে তোমরা আহার কর আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু । সে তো তোমাদের নির্দেশ দেয় মন্দ ও অশ্লীল কাজ [ব্যভিচার, মদ্যপান, হত্যা ইত্যাদি] করতে এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন সব বিষয় বলতে যা তোমরা জান না।” (সূরা বাক্বারাহ্,-১৬৮-১৬৯)

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন-

“চোখের যিনা হচ্ছে তাকানো, জিহ্বার যিনা হচ্ছে কথা বলা, অন্তর তা কামনা করে এবং পরিশেষে যৌনাঙ্গ একে বাস্তবায়ন করে অথবা প্রত্যাখ্যান করে।” [বুখারী:৬২৪৩; মুসলিম: ২৬৫৭]

♦বৈশাখকে সম্বোধন করে স্বাগত জানিয়ে সঙ্গীত ও বাদ্য বাজানো

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“এবং তাদের মধ্যে যাদেরকে পার পর্যায়ক্রমে বোকা বানাও তোমার গলার স্বরের সাহায্যে, ... ” (সূরা আল ইসরা,-৬৪)

যে কোন আওয়াজ, যা আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে আহবান জানায়, তার সবই এই আয়াতে বর্ণিত আওয়াজের অন্তর্ভুক্ত। (তফসীর ইবন কাসীর)

আল্লাহ আরও বলেন-

“এবং মানুষের মাঝে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর পথ থেকে [মানুষকে] বিচ্যুত করার জন্য কোন জ্ঞান ছাড়াই অনর্থক কথাকে ক্রয় করে, এবং একে ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে, এদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” (সূরা লুকমান, ৩১:৬)

রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেছেন-

“আমার উম্মাতের মধ্যে কিছু লোক হবে যারা ব্যভিচার, রেশমী বস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্রকে হালাল বলে জ্ঞান করবে।” [বুখারী:৫৫৯০]

আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক দান করুন, এবং কল্যাণ ও শান্তি বর্ষিত হোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর, তাঁর পরিবার ও সাহাবীগণের ওপর।

পরিশেষে মহান আল্লাহর বানী দিয়ে শেষ করছি।

“আর তোমরা তোমাদের রবের ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও, যার পরিধি আসমান ও যমীনব্যাপী, যা প্রস্তুত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য।” (সূরা আলে-ইমরান-১৩৩)

সকল ভাই বোনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আমার লেখনির মধ্যে যদি কোন প্রকার ভুল হয়ে থাকে তাহলে দয়া করে কমেন্টস্ করে জানিয়ে দিবেন। কারণ আমরা কেউই ভুলের উর্ধ্বে নই।

আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন

বিঃদ্রঃ বাঙ্গালী একটা শংকর জাতি যেখানে বিভিন্ন ধর্মের লোকের বসবাস। বাংলাদেশের সকল নাগরিকগণ নিজ নিজ ধর্মীয় রীতিতে নববর্ষ ‍উদযাপন করুক, কেউ কারও রীতি-নীতিতে হস্তক্ষেপ না করি। সবাইকে ধন্যবাদ।

বিষয়: বিবিধ

১২৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File