দশ মহররম : মুসলিম মিল্লাতের দায়িত্ব ও কর্তব্য

লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ০৩:৪৪:০৯ দুপুর



আমাদের দেশে তিন ভাষায় সন বা বর্ষ গণনা করা হয়। আরবী, বাংলা ও ইংরেজী। দেশ হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং স্বাধীন ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার নিজস্ব স্বকীয়তা ও মর্যাদা থাকলেও সন গণনার ক্ষেত্রে বাংলার অবস্থান দ্বিতীয়। মুসলিম জাতি হিসেবে আরবী ভাষার একটা স্বতন্ত্র মর্যাদা থাকলেও আমাদের কাছে তা নেই। ফলে আরবী সন গণনার স্তর গিয়ে দাঁড়িয়েছে তৃতীয়তে। কেবল প্রাধান্য পাচ্ছে ইংরেজী গণনা। প্রায় দু’শ বছরের ইংরেজ শাসন আমাদের মন-মগজকে যেভাবে ধুলাই করেছে বংশ পরিক্রমায় তা আমরা লালন করছি ঐশী বিধানের মতো। আমাদের যা নিজস্ব সম্পদ তার গুরুত্ব আমাদের কাছে নেই বললেই চলে। যেমন বাংলা ভাষার জন্য ৮ই ফাল্গুন রক্ত ঝরেছে। শহীদ হয়েছে অনেকে। অথচ আমরা মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করি ২১শ ফেব্রুয়ারী। ৮ই ফাল্গুণ ইংরেজদের ধুলাই আগুনে জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে। একইভাবে আরবী চলে গেছে আরব দেশে। সে যাই হোক, বাংলা ও ইংরেজি সন আমরা গণনা করি বটে। আজ পর্যন্ত কেউ এ সনদ্বয়কে চর্ম চক্ষে দেখছে বলে শুনিনি। ৩০/৩১ দিন শেষ হলেই তোতা পাখির ন্যায় বলি জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি। আসলে এসবের কোন দৃশ্যমান অস্তিত্ব যেমন নেই তেমনি মানবজীবনে এর গুরুত্বও নেই। পক্ষান্তরে আরবী মাসসমূহ যেমন মানুষের চোখের সামনে দৃশ্যমান অনুরূপ এর গুরুত্বও অপরিসীম। এ বিশাল ও বৈচিত্র্যময় পৃথিবী যার ইঙ্গিতে সৃষ্টি হয়েছে সে মহামহিম আল্লাহ নিজেই এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘তোমরা যাতে করে বছরের সংখ্যা, সময় গণনা করতে পার তার জন্য আমি চন্দ্র ও সূর্য্যকে আলোকবর্তিকাময় ও উহার কক্ষপথ সুনিয়ন্ত্রিত করেছি।‘‘ (আল-কোরআন)। [আরবী মাসসমূহ মূলত এ জন্যই দৃশ্যমান। যেহেতু আরবী মাসসমূহ সময় এবং কাল গণনার্তে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই দৃশ্যমান এ মাসগুলোর গুরুত্ব লক্ষণীয়। সময়ের আবর্তে নতুন চন্দ্র উদয়ের মধ্যদিয়ে চক্রাকারে এক একটি মাস নানান গুরুত্বে ও তাৎপর্য্যের বার্তা নিয়ে মানবমন্ডলীর সমীপে উপস্থিত হয়। এসব মাসের মধ্যে এমন কতক মাস রয়েছে যা অধিক মর্যাদার দাবীদার ও বরকতময়। এ বরকতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ মাসসমূহের মধ্যে একটি হলো আরবী সনের প্রথম মাস ‘‘মাহে মহররম’’ বা হারাম মাস অথবা পবিত্র মাস। মহররমকে হারাম মাস বলা হয় এ কারণেই যে, এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি করা হারাম বা শরীয়া দৃষ্টিতে অবৈধ। পবিত্র মাস বলা হয় এ কারণেই যে, সকল প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিবাদ-বিশৃংখলা, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা দরকার বলেই এ মাসকে পবিত্র মাস হিসেবে মর্যাদা প্রদান করা হয়। যেহেতু সন গণনার সূচনা মাস সেহেতু এ মাসে কোন ধরনের খারাপ কাজ করা উচিত নয়। অন্যান্য মাসেও তা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা সূচনা মাসেই দেয়া হয়। পৃথিবীর সূচনা হতে এ পর্যন্ত যত বড় বড় বৈচিত্র্যপূর্ণ ও অকল্পনীয় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার সিংহ ভাগই এ মাসের ১০ তারিখ সংঘটিত হয়েছে। এ দিনে সংঘটিত কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা নিম্নরূপ : ১। আল্লাহ তা’আলা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এ দিনে। অর্থাৎ পৃথিবীর জন্ম দিন হলো ১০ মহররম। ২। আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করা হয় এ দিন। ৩। এ দিনেই হযরত আদম (আঃ) কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। ৪। বিচ্যুতির কারণে হযরত আদম (আঃ)-এর পৃথিবীতে প্রেরণের পর এ দিনই তাঁর তাওবা কবুল করা হয়। ৫। জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর জন্ম দিন। ৬। নমরুদের বিশাল অগ্নিকুন্ড হতে জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) মুক্তিলাভ করেন। ৭। তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে হযরত মুসা (আঃ)-এর কথোপকথন ও আসমানী কিতাব ‘‘তাওরাত’’ লাভ। ৮। জালেম ফেরাউনের দলবলসহ নীল দরিয়ায় সলিল সমাধি। ৯। হযরত ইদ্রীছ (আঃ) এর পুনঃ জান্নাতে ফেরা। ১০। বিবি মরিয়ম (আঃ)-এর গর্ভ হতে হযরত ঈসা (আঃ) এর পৃথিবীতে আগমন। ১১। হযরত নুহ (আঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মহাপ্লাবন হতে মুক্ত লাভ। ১২। হযরত ঈসা (আঃ)-এর আকাশ গমন। ১৩। হযরত সোলাইমান (আঃ)-এর পুনঃরাজত্ব লাভ। ১৪। হযরত আইয়োব (আঃ)-এর রোগ মুক্তি ও পুনঃধন সম্পদ লাভ। ১৫। হযরত দাউদ (আঃ)-এর হাতে জালিম বাদশা জালুত নিহত হয়। ১৬। হযরত দাউদ (আঃ)-এর গুনাহ্ মাফ হয়। ১৭। হযরত্ ইয়াকুব (আঃ) তার প্রিয় পুত্র হযরত ইউসুফ (আঃ) কে ফিরে পান। ১৮। মাছের পেট হতে হযরত ইউনুস (আঃ)-এর মুক্তি লাভ। ১৯। আসমান হতে বৃষ্টি বর্ষণের সূচনা হয় এ দিনে। ২০। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর শাহাদাত বরণ। ২১। এ দিনের কোন এক জুমাবারে ইস্রাফিলের সিংগার ফুঁৎকারে কেয়ামত সংগঠিত হবে। [উপরোক্ত বহুল আলোচিত ঘটনাসমূহের মতো আরো ঘটনা ঘটেছে মহররমের দশ তারিখ। এসব কারণেই এ মাস অতীব গুরুত্বের দাবী রাখে। সকল সংঘঠিত ঘটনাসমূহের মাঝে সব চেয়ে ব্যথাদায়ক ও বহুল আলোচিত ঘটনা হলো হযরত মুহাম্মদে আরবী (সঃ) এর প্রিয় দৌহিত্র শহীদ জননী ফাতেমাতুজ জোহরা (রাঃ) এর হৃদয়ের স্পন্দন, শেরে খোদা হযরত আলী মর্তুজা (রাঃ) এর নয়নের মনি বিশ্ব মুসলিম মিল্লাতের বিপ্লবী ও সংগ্রামী চেতনার প্রতীক সাইয়াদুস শুহাদা হযরত ইমাম হোছাইন (রাঃ) এর মর্মান্তিক শাহাদাত বরণ। দজলা ও ফোরাতের তীরে কারবালা প্রান্তরে হিজরী ৬১ সনে কাতেবে ওহি হযরত আমীরে মোয়াবিয়ার অযোগ্য সন্তান জালিম এজিদের পাষন্ড সৈন্য-সামন্তরা খোদায়ী খিলাফতকে পদ তলে দিয়ে আহলে বাইয়্যাতের যোগ্য খিলাফতকে অস্বীকার করে রাজতন্ত্রের দম্ভ প্রদর্শন করে সাইয়্যাদিনা ইমাম হোছাইন সহ ৭২জনকে শাহাদাত বরণ করিয়ে দুনিয়ার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করে। কিন্তু কেন এবং কিভাবে এ ঘটনা সংগঠিত হয় তার কম বেশি দুনিয়াবাসীর অজানা নয়। আমরা সি দিকে যাব না। শুধু এটুকু বলার প্রয়াস পাব যা জরুরী মনে হয়। [কুফায় গভর্নর হযরত আমীরে মোয়াবিয়ার ইন্তেকালের পর তার পুত্র এজিদ পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে নিজকে খলিফা বলে ঘোষণা দেয়। আহলে বাইয়্যাতদের কে সে তার আনুগত্য স্বীকার করার নির্দেশ দেয়। অথচ শরীয়াহ মোতাবেক এজিদ কোন প্রকার ইসলামী খিলাফতের জন্য উপযুক্ত ছিল না। তাই আহলে বাইয়্যাতগণ তার আনুগত্য স্বীকার করার মতো কোন ধরনের যৌক্তিকতা নেই বিধায় তাঁরা এজিদের নির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করে। শুধু এ কারণেই হিজরী ৬১ সনের ১০ মহররম কারবালা প্রান্তরের ব্যথাদায়ক ঘটনা সংঘটিত হয়, আহলে বাইয়্যাতের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয় কারবালা প্রান্তর। এজিদি শক্তি অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়, সুকৌশলে ৭২ জন আহলে বাইয়্যাতের রক্ত ঝরায় নির্মমভাবে। দুনিয়ার বুকে সৃষ্টি করে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। হযরত ইমাম হোছাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের মর্মান্তিক ঘটনা অতি গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়ে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। আলোচনা পর্যালোচনা চলছেই। তা চলতে থাকবে প্রলয় দিবস অবধি। ঘটনার চুলচেড়া বিশ্লেষণ হচ্ছে। কিন্তু ঘটনার মূল কারণ কি সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষ খুব বেশি ওয়াকিফহাল নয়। ফলে মুসলিম বিশ্ব এ ঘটনার তাৎপর্যকে কেন্দ্র করে যে শিক্ষা পাওয়ার কথা এবং শিক্ষার বিষয়কে মূল্যায়ন করার কথা তা করা হচ্ছেনা। অথচ এ দিনকে কেন্দ্র করে আমরা অনেক কিছু করে থাকি। যা করি তা শরীয়াহ্ সম্মত কিনা তার বাছ বিচার করা হয় না। বাস্তব সম্মত বিষয় হলো ১০ মহররম কারবালার প্রান্তরে সংঘটিত ঐতিহাসিক ও হৃদয় বিদারক ঘটনার সামাজিক, রাজনৈতিক ও শরীয়াহ ভিত্তিক গুরুত্ব আছে। দেখার বিষয় হলো আমরা এর গুরুত্ব কতটুকু মূল্যায়ন করি এবং কি ভাবে মূল্যায়ন করি? আমরা যা করি তার মধ্য হতে অধিক আর করার কিছু আছে কিনা এবং যা করি তার মধ্য হতে বর্জনীয় কিছু আছে কিনা? তা জানা ও বুঝা সকলের জন্য অতিব জরুরী। এটা জানার পূর্বে আমরা দেখব যে, বিশ্বনবী (সঃ) এর আগমনের পূর্বে ও পরে মহররম পালন হতো কিনা? হলে কিভাবে হতো? [বিশ্বনবী (সঃ) এর আগমন পূর্ব মহররম পালন:] বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ)-এর আগমন পূর্ব যত নবী পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে আগমন করেছেন তারা এবং তাদের উম্মতগণ মহররম পালন করেছেন। তাঁরা ১০ মহররম রোজা পালনের মাধ্যমে মহররম পালন করতেন। কোন কোন নবীর উম্মতের উপর মহররমের রোজা ফরজ ছিল। এ মাসকে তারা পবিত্র মাস হিসেবে জানতো- বিধায় এ মাসে কোন ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ, ঝগড়-বিবাদ ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়তো না। পবিত্র মাসে ঐ প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। হযরত মুসা (আঃ) এর উম্মত তথা বনি ইস্রাইলের লোকেরা দশ-ই-মহররমকে মুক্তি দিবস হিসেবে পালন করতো। কারণ অত্যাচারী জালিম বাদশা ফেরাউনের দলবলসহ নীল দরিয়ায় সলিল সমাধি ঘটেছিল এ দিনে। তার মৃত্যুর পর তার জুলুম থেকে বনি ইস্রাইল নিষ্কৃতি লাভ করে- বিধায় এ দিনকে তারা মুক্তি দিবস হিসেবে পালন করতো। [মহানবী (সঃ) এর মহররম পালন:] বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) স্বয়ং পবিত্র আশুরার রোজা রেখেছেন। হাদীস শরীফের বর্ণনা মতে, হযরত (সঃ) অহি প্রাপ্তির পূর্বে ১০ই মহররম রোজা রাখতেন। হিজরতের পর মদীনায় গিয়েও তিনি রোজা রেখেছেন। পবিত্র রমজান মাসের রোজা ফরজ হবার পর আশুরার রোজা সুন্নাতে রূপায়িত হয়। কেউ ইচ্ছা করলে আশুরার রোজা রাখতেও পারে আবার নাও রাখতে পারে। তবে হযরত (সঃ) মহররমের ৯ ও ১০ তারিখ দু’টি রোজা রাখতেন। এভাবে দু’টি রোজা রাখা সুন্নাত। এ দু’টি রোজা ৯ ও ১০ তারিখ হোক অথবা ১০ ও ১১ তারিখ হোক। এটা মুসলিম মিল্লাতের কর্তব্য। এ বিষয়ে সবাইকে উৎসাহিত করা সকলের একান্ত দায়িত্ব। [হযরত ইমাম হোছাইনের শাহাদাত বরণ কেন?] কারবালার ঐতিহাসিক মর্মান্তিক ঘটনায় হযরত ইমাম হোছাইন (রঃ) নিজে শাহাদাত বরণ করলেন। তার সাথে কোলের মাসুম বাচ্চাসহ আহলে বাইয়্যাতের ৭২জন সদস্য শাহাদাতের নজরানা পেশ করলেন। একজন ব্যক্তির জীবন দেয়া এবং সাথে কোলের বাচ্চাসহ ৭২জন কুরবানী হওয়া এটা ছোট কোন ঘটনা নয়। কোন ধরনের দুর্ঘটনাও নয়। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে যে, এজিদের সাথে হযরত ইমাম হোছাইনের বিরোধ কোথায় ছিল? ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায যে, হযরত ইমাম হোছাইন (রঃ) এর সাথে এজিদের কোন ধরনের ব্যক্তিগত শত্রুতা, দ্বনদ্ব-সংঘাত ছিল না। সামাজিক কোন সমস্যাও ছিল না। সিংহাসন লাভের মতো কুৎসিত কোন মনোবাসনা ইমামের ছিল না। যিনি বিশ্বনবীর কোলে-কাঁধে চড়েছেন, হযরত আলী ও হযরত ফাতেমা (রঃ)-এর কোলে চড়ে বড় হয়েছেন- আসহাবে রাসূল (সHappy এর মাঝে বড় হয়েছেন, এমন একজন মহান ব্যক্তির মাঝে সিংহাসন লাভের মতো কুৎসিত বাসনা থাকবে তা চিন্তা করা যায় না। তিনি ছিলেন উন্নত মানের তাকওয়া সম্পন্ন লোক। সবদিক দিয়ে ছিলেন তিনি সম্মানিত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়। যারা শাসক ছিলেন তাদের কাছেও তিনি সম্মানিত ছিলেন। হযরত ইমাম হোছাইনের ব্যক্তিত্ব দুনিয়ার সাধারণ পদ-পদবীর চেয়ে অনেক গুণে বড় এবং সম্মানিত ছিল। অতএব সিংহাসন লাভের মতো কোন ধরনের কুৎসিত বাসনা ইমামের ছিল না। কোন ধরনের পদ-পদবীর প্রয়োজনও ইমামের ছিল না। তারপরও কেন তিনি কারবালা প্রান্তরে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন? এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখতে হবে। এখানে সে সুযোগ নেই বিধায় মৌলিক কারণগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করছি। আল্লাহর দেয়া সংবিধান অনুযায়ী বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সঃ)-এর নেতৃত্বে মদীনায় যে ইসলামী খিলাফাত প্রতিষ্ঠিত হয় সে ইসলামী রাষ্ট্রের কয়েকটি মৌলিক শাসনতান্ত্রিক ধারা ছিল। ইসলামী রাষ্ট্রের সে শাসনতান্ত্রিক মৌলিক ধারাসমূহ ছিল আল্লাহর প্রদত্ত এবং রাসুল (সঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ধারা। যা সকল যুগের সকল মানুষের জন্য ছিল কল্যাণকর। এ ধারা গুলো নিম্নরূপ: ১নং ধারা:- ‘‘একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে জনসাধারণের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে। এ রাষ্ট্রে কোন একজন ব্যক্তির একক কর্তৃত্ব থাকবে না। এককভাবে কেউ একচ্ছত্র প্রাধান্য পাবে না।’’ নবুওয়াত লাভের পর মক্কার জনগণ স্বাধীনভাবে ইসলামী দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করেছে বিধায় যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়নি। মদীনায় হিজরতের পর মদীনার সকল জনগণ ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার বিষয়ে স্বাধীন মতামত পেশ করলে সেখানেই প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঘটে। রাসূল (সঃ) এর ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি স্বয়ং ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেন। তিনি স্বয়ং অহি দ্বারা পরিচালিত বিধায় এ রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেন। বিশ্বনবীর ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদীনগণ পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। এখানে কারো একক কর্তৃত্ব ছিল না। ২নং ধারা: ‘‘দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে। আর পরামর্শ করতে হবে এমন লোকদের সাথে যাদের রয়েছে চারটি মৌলিক গুণ। মৌলিক গুণ হলো ১) যার রয়েছে ইসলামের গভীর জ্ঞান ২) তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি ৩) যার রয়েছে নির্ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো বুদ্ধি জ্ঞান। ৪) যার প্রতি রয়েছে জনগণের গভীর আস্থা। মদীনায় যে ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল তার প্রথম কর্ণধার ছিলেন স্বয়ং আল্লাহর রাসূল। রাসূল (সঃ) এর ওফাতের পর প্রধান চার খলিফা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ঐ সময়ের সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী, তাক্ওয়া সম্পন্ন, বুদ্ধি সম্পন্ন এবং জনগণের নিকট প্রিয়জন যারা ছিল তাদেরকে নিয়ে মজলিশে শূরা গঠন করে তাদের সাথে পরামর্শ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। কোন খলিফা ইসলাম বহির্ভূত কোন সিদ্ধান্ত কিংবা নিজের মর্জিমতো কোন সিদ্ধান্ত কারো উপর বা রাষ্ট্রের জনগণের উপর চাপিয়ে দিতেন না। ৩নং ধারা: ‘‘রাষ্ট্রের ভাল-মন্দ ইত্যাদি বিষয়ে মতামত পেশ করার পূর্ণ স্বাধীনতা জনগণের থাকবে। জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর কারো কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করা যাবে না। বিশেষ করে সৎ কাজের আদেশ দেয়া, অসৎ কাজে বাধা দেয়ার স্বাধীনতা সকল জনগণ সংরক্ষণ করবে।’’ সৎ কাজের আদেশ দেয়া, অসৎ কাজে বাধার সৃষ্টি করা এটা আল্লাহর হুকুম। আল্লাহর নির্দেশ। এ নির্দেশ রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারী পর্যন্ত সকলের মৌলিক কাজ। মূলত: ইসলামের বড় ও আসল মিশন এটা। আল্লাহর এ হুকুম সকলে সমভাবে সংরক্ষণ করবে। মদীনার নব গঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণ মতামত পেশ করার স্বাধীনতা পূর্ণরূপে ভোগ করেছেন। ৪নং ধারা: ‘‘যিনি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হবেন তাকে আল্লাহ এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।‘‘ এখানেই একজন ব্যক্তির আসল রূপ ফুটে উঠে। যিনি সরকার প্রধান হবেন তিনি কোন ধরনের জবাব দিহিতার ঊর্ধ্বে থাকবেন না। দুনিয়ার জীবনে রাষ্ট্রের ভাল-মন্দ সব বিষয়ে জনগণের নিকট স্বচ্ছ জবাবদিহি করতে হবে। আর আদালতে আখেরাতে মহান আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করার মনমানসিকতা থাকতে হবে। রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের এ ধারার বলে কোন রাষ্ট্রনায়কের স্বেচ্ছাচারী হবার সুযোগ নেই। প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কোন ধরনের বৈষয়িক বা জাগতিক, নৈতিক বা অনৈতিক কোন ধরনের অপরাধ করার সুযোগ থাকে না।

মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারের কাউকে এমন কাজ করতে দেখা যায়নি। তা শাসনতন্ত্রের ঐ ধারার কারণে। বিশেষ করে আল্লাহর নিকট জবাবদানের বিষয়টিই একজন মানুষকে সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে। অপরদিকে যে ব্যক্তির মাঝে, আল্লাহর নিকট জবাব দিহিতার মানসিকতা সৃষ্টি হবে না সে জনগণের নিকট জবাবদিহিতার প্রশ্নই উঠে না। এমন লোকদেরকে কোন ধরনের পদে বসানো উচিৎ নয়। ৫নং ধারা : ‘‘রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সকল সম্পদের মালিক আল্লাহ। রাষ্ট্র প্রধানের নিকট এ সম্পদ জনগণের পক্ষ থেকে আমানত। তিনি রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে এ সম্পদের মালিক নন। শুধুমাত্র আমানতদার।’’ রাষ্ট্র প্রধান এ সম্পদ ব্যবহার করবেন আল্লাহর প্রদত্ত নির্ধারিত খাতে। যা দেশ ও জনগণের কল্যাণে ব্যয়িত হবে। তা এমন ভাবে ব্যয় করবেন যে ভাবে আল্লাহ বলেছেন, এ ব্যাপারে তিনি হবেন কঠোর ও নির্দয়। কারণ সম্পদের বিষয়েও তাকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। ৬নং ধারা : ‘‘রাষ্ট্রের আইন হবে আল্লাহর প্রদত্ত রাসুল (সঃ) প্রদর্শিত ও প্রয়োগকৃত আইন।’’ রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে সাধারণ কুলি-মজুর পর্যন্ত এই আইনের অধীনে থাকবেন। আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না কেউ। এ আইন সকলের জন্য সমান। এটার নামই হচ্ছে আইনের শাসন। যেমন মদীনার ইসলামী আদালতের কাজী রাষ্ট্র প্রধানকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য করেছেন। খলিফার বিরুদ্ধে রায়ও দিয়েছেন। এ দ্বারা প্রমাণ হয় যে, আল্লাহর আইন সকলের জন্য সমান প্রযোজ্য। ৭নং ধারা : ‘‘সকল প্রকার অধিকার ও মর্যাদার ক্ষেত্রে পূর্ণ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। অধিকারের ক্ষেত্রে সকল মানুষ সমান।’’ রাষ্ট্রপ্রধান যেমন মানুষ রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকও মানুষ। অধিকার ও মর্যাদার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রধান যা ভোগ করবে সাধারণ মানুষ তাই ভোগ করবে। দেশ, গোত্র, ভাষা বর্ণের কোন ধরনের পার্থক্য করা চলবেনা। কে শাসক আর কে শাসিত তা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো উভয়ই মানুষ। উভয়ে আল্লাহর বান্দাহ্। আল্লাহর বান্দাহ্ হিসেবে সকলেই সম অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করবে। উপরোক্ত ৭টি ধারা ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক শাসনতান্ত্রিক ধারা। এর বাইরে গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। যার হৃদয়ের গভীরে আল্লাহর প্রেম আছে এবং আল্লাহর গজব ও কঠিন শাস্তির ভয় আছে তিনি এর বাইরে যেতে পারেন না। কাউকে এর বাইরে যেতে দিতে পারেন না। সৎ কাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজের বাঁধাদান যেহেতু শাসতন্ত্রের একটি মৌলিক ধারা সে অনুযায়ী হযরত ইমাম হোছাইন (রঃ) এজিদকে বাঁধা দান করেছেন। কারণ এজিদ ইসলামী শাসনতন্ত্রের মৌলিক ধারার বাইরে চলে গিয়েছে। তাকে বাধা দেয়া এবং জনগণ তথা আল্লাহর বান্দাদেরকে তার কবল থেকে উদ্ধার করা জরুরি ছিল বিধায় তিনি কারবালার ময়দানে এজিদি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এ অবতীর্ণ হন এবং ৭২ জন আহলে বাইয়্যাতসহ শাহাদাত বরণ করেন। এজিদ স্বাভাবিক পদ্ধতিতে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি। হযরত আমীরে মোয়াবিয়ার ছেলে হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে নিজেকে খলিফা ঘোষণা করে। যা ইসলামী রীতিনীতির পরিপন্থি ছিল। এজিদ ক্ষমতায় আরোহণ করার পর হযরত ইমাম হোছাইন (রঃ) তার অন্তর দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন যে, এক: এজিদ তার মসনদে বসে ভিন্ন গতিতে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। অর্থাৎ রাসুল (সঃ) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনগণ যেভাবে বা যে পদ্ধতিতে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন সে সুন্দর ও সত্যের পথ থেকে সরে গিয়ে আল্লাহর বান্দাদেরকে ভিন্ন পথে পরিচালনা করার প্রয়াস চালাচ্ছে। যা কোন খোদাভীরু লোক.....মেনে নিতে পারেনা। দুই: যেহেতু পৃথিবীর শ্রষ্টা একক ভাবে একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। সেহেতু দুনিয়ার সকল দেশ বা রাষ্ট্রের একমাত্র মালিকানাও আল্লাহর। দুনিয়ার সকল দেশ বা রাষ্ট্র যেহেতু আল্লাহর একক মালিকানাধীন সেহেতু দেশ বা রাষ্ট্রে বসবাস রত সকল বনি আদম কেবল মাত্র আল্লাহরই বান্দাহ বা গোলাম। রাষ্ট্র বা দেশ জনগণের মালিক নয়। জনগণও রাষ্ট্র বা দেশের গোলাম নয়। জনগণের পরামর্শ, মতামত বা ভোটের মাধ্যমে যিনি রাষ্ট্র প্রধান হবেন তার প্রধান দায়িত্ব হলো সর্বাগ্রে আল্লাহর দাসত্ব কবুল করা এবং আল্লাহর দাসত্বের শিকল গলায় ঝুলিয়ে নেয়া। তারপর আল্লাহর বান্দাহদের ওপর আল্লাহর আইন জারি করা। এজিদ সিংহাসনে বসার পর আল্লাহর কর্তৃত্বকে বাদ দিয়ে স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আল্লাহর বান্দাহদের গলায় তার মর্জি মতো রাজতান্ত্রিক শিকল পরিয়ে দেবার চেষ্টা করে। সে বাদশাহ হিসেবে রাষ্ট্রের মালিক, জনগণের মালিক এবং জনগণের ইজ্জত আব্রুর মালিক হয়ে বসে। যা ইসলামী শাসনতন্ত্রের মৌলিক ধারার পরিপন্থি। আল্লাহর প্রদত্ত আইনের পরিপন্থি কোন ধরনের প্রচেষ্টাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও লালন-পালন করতে দেয়া যায় না। কোন সাচ্চা মুসলিম তা মেনে নিতে পারেনা। তিন: আল্লাহর প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হচ্ছে ইসলাম। ইসলামকে সামগ্রিকভাবে চর্চা করতে হলে রাষ্ট্রীয় ভাবে তার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা মুসলমানের সর্বপ্রথম ও প্রধান কর্তব্য। কেননা ইসলামকে বাদ দিয়ে মুসলমান থাকা যায় না। তাই আল্লাহর মনোনীত পূর্ণাঙ্গ এই জীবন বিধান ধরাপৃষ্ঠে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিভাবে কোন পদ্ধতিতে ইসলামী রাষ্ট্র চালাতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান যারা হবেন তাদের চরিত্র ও নীতি নৈতিকতা কোন মানের হবে। জনগণের চরিত্র কেমন হবে তা সরাসরি দেখিয়ে দেবার জন্য এবং বাস্তবে শিখিয়ে দেবার জন্য সরাসরি রাসুল প্রেরণ করেছেন। যাকে রাসুল হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে তাকে অহি দ্বারা পরিচালিত করা হয়েছে। বিশ্বনবী (সঃ) সে মনোনীত সর্বশেষ রাসূল (সঃ)। আল্লাহর নির্দেশ ক্রমে রাসুল (সঃ) ইসলামকে এবং ইসলামী রাষ্ট্রকে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান কাজ সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, ইনসাফ এবং আল্লাহর বান্দাহদের জন্য আল্লাহর নির্দেশিত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সাথে সাথে ইসলামের বিপরীত যা কিছু আছে তা সমূলে ধূলিস্যাৎ করা। ধ্বংস করা। মানুষের ওপর থেকে মানুষের প্রভুত্ব খতম করা। রাসুল (সঃ) পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্র এমনই ছিল। খোলাফায়ে রাশেদার যুগেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু এজিদ উত্তরাধিকার সূত্রের নামে মতায় এসে সততা ও ইনসাফকে উৎখাত করতে চেষ্টা করল এবং নিজেকে প্রভুর আসনে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালালো। যা সম্পূর্ণরূপে রাসূল (সঃ) এর দেখানো এবং শিখানো নীতির পরিপন্থি। চার : তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি। রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারী পর্যন্ত সকলকে এ শক্তির বলে বলীয়ান হতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের গোটা জন শক্তির অন্তরে বিরাজ করবে আল্লাহর আযাবের ভয়। এর বাইরে অন্য কাউকে ভয় করা যাবে না। মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণ শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়েই ভীত ছিল। অন্য কোন ভয় তাদের মাঝে ছিল না। কিন্তু এজিদ ক্ষমতায় আসার পর পরই নিজে ইসলামী রীতি-নীতি বাদ দিয়ে ভিন্ন রীতি-নীতি অনুস্মরণ কতে লাগল। দেশ থেকে চলে গেল সততা, ন্যায়নীতি ও ইনসাফ। বেড়ে গেল জুলুম নিপীড়ন। মানুষের মন থেকে বিধায় নিতে শুরু করল খোদাভীতি পূর্ণ ইসলামী চরিত্র। জনগণের মাঝে বেড়ে গেল আল্লাহর ভয়ের পরিবর্তে শাসকগোষ্ঠীর ভয়। এ ছিল এক বিরাট পরিবর্তন। হযরত ইমাম হোসাইন (রঃ) তাঁর অন্তর দৃষ্টি দিয়ে উপরোক্ত বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করে এজিদকে বাধা দিতে গেলেন। তার পতিপথ পরিবর্তন করে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেন। এ প্রচেষ্টার ফলই হলো কারবালার যুদ্ধ। সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি হলেন আপোসহীন। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে তিনি শহীদ হলেন। মাসুম বাচ্চাকেও কুরবানী দিলেন। তার পরও মিথ্যার কাছে মাতা নত করলেন না। দ্বীনের জন্য ইমাম হোছাইন (রঃ) এর জীবন দান কোন সহজ ব্যাপার ছিলনা। অথচ আমরা কি করছি? যা করে যাচ্ছি তা কি ইসলাম সম্মত? হযরত ইমাম হোছাইন (রঃ) এর পবিত্র শাহাদাত দিবসকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু কুসংস্কার প্রচলিত আছে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এসব কাজ জায়েজ বা বৈধ নয়। ঈমানের বলে বলিয়ান কোন মুসলমান ঐসব কাজ করতে পারেনা। ঐসব কুসংস্কারের জনক হলো পোড়া শিয়া সম্প্রদায় এবং এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী। আমাদের সমাজের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ পোড়া শিয়া সম্প্রদায় ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে শাহাদাতে কারবালা হতে বাস্তব ও জীবন্ত শিক্ষা গ্রহণ করার পরিবর্তে নানা ধরনের কুসংস্কার শিখছে এবং ঐ সব কুসংস্কার চর্চার মাধ্যমে এজিদি শক্তিকে শক্তিশালী করে তুলছে। জারীগান আর পুঁথি পাঠের আসর ইত্যাদি মনোরঞ্জনের জন্য হতে পারে। শোক-সন্তোপের জন্য নয়। ইমাম হোছাইন (রঃ) এর শাহাদাত দুনিয়ার সবচেয়ে বিয়োগান্ত ও হৃদয় বিধারক ঘটনা। এ ঘটনা মুসলমান হৃদয়ে ঈমানী ও ইসলামী চেতানার প্রসার ঘটায়। আল্লাহর প্রদত্ত ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করে। মিথ্যার বিরুদ্ধে বজ্রকঠোর করে তুলতে পারে। কোন রকম আনন্দ দিতে পারেনা। বিনা অপরাধে আহলে-বাইয়্যাতের ৭২ জন লোকের শাহাদাত বরণ সহ্য করার মতো বিষয় নয়। নবী দৌহিত্রের কোন অপরাধ ছিলনা। আপন সমাজে নতুনভাবে জন্ম নেয়া তাগুতকে অস্বীকার করার কারণে তাদেরকে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। এ ঘটনা বা এ দিবসকে কেন্দ্র করে জারিগান আর পুঁথি পাঠের আসর বসায়ে আনন্দ করার মাঝে কোন কল্যাণ নেই। এ সব কুসংস্কার মুসলিম জাতিকে বিপ্লবী চেতনা হতে ফিরিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র মাত্র। দ্বীন-ধর্মের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আনন্দ-ফুর্তির সাগরে ডুব দিয়ে মহররম পালন কতটুকু শরিয়াহ সম্মত তা মুসলমানদের ভেবে দেখা উচিত। নগ্ন-পায়ে হাঁটা, কালো ব্যাজ ধারণ করা, হায় হোসেন, হায় হোসেন রবে মদমত্ত হওয়ার ভান করা, আপন দেহে চাকু চালিয়ে খুন প্রবাহিত করা। নারী-পুরুষ এক সাথে একাকার হয়ে শোকযাত্রা করা এসব মুসলমানের সংস্কৃতি নয়। এসব কোন মুসলমানের সংস্কৃতি হতে পারে না। এ সংস্কৃতি ইংরেজদের কাছ থেকে গ্রহণ করা। যার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে ঐসব কুসংস্কার। মুসলমানরা আজ ঐসব ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে শাহাদাতে কারবালার প্রকৃত শিক্ষাকে বিকৃত করে চলছে। শুধু তাই নয়, ঐসব কুসংস্কার চর্চার মাধ্যমে এজিদি শক্তিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যা কোন মতে মেনে নেয়া যায়না। শাহাদাতে কারবালার যথাযত মূল্যায়ন পূর্বক আশুরা পালন করতে হলে নিম্নে লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। এক: বিশ্বনবী (সঃ) যে ভাবে আশুরা পালন করেছেন ঠিক সে ভাবে আশুরা পালন করার জন্য সকল মুসলমানকে এগিয়ে আসতে হবে। রাসুল (সঃ) ২টি রোজা রাখতেন। বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগী করতেন। এর বাইরে অন্য কিছু তিনি করেননি। মুসলমানদের কেউ এর অতিরিক্ত কিছু করা উচিৎ নয়। রাসূল যা করেনি তা করা কোন উম্মতের জন্য জায়েজ নয়। এটা হচ্ছে মৌলিক সংস্কৃতি। দুই: কারবালার শাহাদাতের ঘটনার অন্যতম শিক্ষা হলো কোন ধরনের তাগুতি শক্তির কাছে কোন ভাবে মাথানত না করা। আল্লাহ দ্রোহী তাগুতি শক্তিকে ধ্বংস করে সত্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে হিজরী ৬১ সন মোতাবেক ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে ইমাম হোছাইন (রাঃ)সহ ৭২ জন শাহাদাত বরণ করেন। যে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ইমাম হোছাইন (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেছেন সে সত্য এখনো বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। কুফরী ও তাগুতি শক্তি গোটা দুনিয়ার মুসলিম মিল্লাতের উপর খবরদারী করছে। কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত মিথ্যাকে ধ্বংস করে সত্য ও ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য মুসলিম মিল্লাতকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গড়তে হবে এক নতুন বিপ্লব। সৃষ্টি করতে হবে এক নতুন স্রোত। নিতে হবে নতুন শপথ। তিন: কারবালার রণক্ষেত্রে সত্যের সৈনিক ছিল মাত্র ৭২ জন। অপর পক্ষে এজিদি সৈন্য ছিল অনেক গুণ বেশি। সত্যের সৈনিকরা মুষ্ঠিমেয় ছিল বটে। তারা তাদের ঈমানের ওপর ছিল অটল ও অবিচল। তাদের অন্তরে ছিল আল্লাহ, রাসুল (সঃ) এবং দ্বীনের মুহাববত। তাদের মাঝে ছিল ঈমানি চেতনা। তাই এজিদ বাহিনীর শক্ত, কঠিন বেষ্টনীর মাঝে ও তারা মাথানত করেনি। জালিম সৈনিকদের তলোয়ারের নীচে মাথা সঁপে দিয়েছে বীরের মতো লড়াই করে। তারপরও পিছু হটেনি। মিথ্যাবাদীর নিকট মাথানত করেনি। লড়াই করে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করলেন। কিন্তু ঈমান হারা হলেন না। মিথ্যাকে স্বীকৃতি দিলেন না। অথচ চলমান দুনিয়ার মুসলিম সমাজের একটি অংশ দুনিয়ার ঘৃণ্যতম মতবাদসমূহের পূজা-অর্চনা করেও মুসলিম বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে না। অথচ কুসংস্কারের কাছে মাথানত করে শিরিক বেদআতের আসর বসিয়ে তারা মিথ্যা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত। আশুরার এ পবিত্র দিবস হতে সত্যের পক্ষে অবিচল থাকার প্রেরণা নিয়ে আশুরা পালন করা উচিৎ। চার: শোকগাঁথা, গান-বাজনা, জারিগান, পুঁথি পাঠের আসর, চাকুমারা, কালো ব্যাজ ধারণ ইত্যাদি বর্জন করে ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে এ দিবস পালন করা নিতান্ত জরুরি। সাথে সাথে যাবতীয় অপ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রাণ-পণ সংগ্রামের শিক্ষা গ্রহণ করে ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া আবশ্যক। পাঁচ: পাড়া, গ্রাম, মহল্লা, শহর, নগর তথা জায়গায় জায়গায় আলোচনা সভা, ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে আশুরার প্রকৃত ঘটনা, গুরুত্ব, বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে সঠিক তথ্য সাধারণ মানুষের মাঝে তুলে ধরা উচিত। সমগ্র মুসলিম জাতিকে সকল প্রকার বিদা’আত, শিরিক ও ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আশুরা এবং কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া জরুরি। শুধু জরুরি কেবল নয়। সচেতন মুসলমানের জন্য বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য। সত্তর দানার বিরানী রান্না করে ফুর্তি সহকারে খাওয়ার মাঝে এ দিবস পালনের কোন যৌক্তিকতা নেই। কোন সার্থকতাও নেই। আল্লাহর প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থাকে দুনিয়ার জমিনে প্রতিষ্ঠা করে মিথ্যা ও জুলুমের শিকড় উপড়ে ফেলার মাধ্যমেই রয়েছে ঈমানদারের সার্থকতা। ইমাম হোছাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের উদ্দেশ্য এটাই ছিল। সমগ্র মুসলিম মিল্লাতের চেতনাও তাই হওয়া উচিৎ। আল্লাহ আমাদেরকে শাহাদাতে কারবালার ঘটনা হতে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করে দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন দান করার তৌফিক দিন। আমিন। ছুম্মা আমিন।

--- মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

সূত্রঃ ইনকিলাব (সংগৃহীত)

বিষয়: বিবিধ

৯৯৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File