অন্যায় বিচার
লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ৩০ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:১৯:৩৬ দুপুর
তোমরা নিশ্চয়ই 'ন্যায়বিচার' শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। এটির আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে আদল। যার বাংলা অর্থ সোজা করা, সমতা রক্ষা করা, কম-বেশি না করা, ইনসাফ করা, ভারসাম্য রক্ষা করা ইত্যাদি। ন্যায়বিচার ছাড়া জীবনের কোনো অবস্থাতেই শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ন্যায়বিচার ছাড়া যেমন ইসলামী আইন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তেমনি ইসলামী আইন ছাড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাও প্রায় অসম্ভব।
ন্যায়বিচারের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন মাজিদে বলেছেন, ''আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্টই নির্দেশনাদি দিয়ে পাঠিয়েছি এবং তাঁদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব মানদণ্ড তথা ইসলামী আদালত, যেন লোকেরা ইনসাফ ও সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।"
‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহতা’য়ালা আরো বলেছেন-"নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সংকাজ ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অসৎকাজ ও অবাধ্যতা নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে সদুপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।" শুধু তাই নয়, যারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে না তাদেরকে আল-কুরআনে কাফির, জালিম ও ফাসিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বন্ধুরা, ন্যায় বিচার না করার পরিণতি সম্পর্কে মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী তার বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবীতে চমৎকার একটি গল্প লিখেছেন।
অন্যায় বিচার
---------------------
একবার এক হাড্ডিসার বৃদ্ধ গেল ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য। বৃদ্ধটি কংকালসার হওয়া ছাড়াও ছিল চরম ক্ষুধার্ত। ক্ষুধার জ্বালায় তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বৃদ্ধকে দেখে ডাক্তারের বুঝতে বাকী রইল না যে, এই বৃদ্ধ বেচারার জীবন প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। ডাক্তারের খুব মায়া হলো বৃদ্ধের জন্য। তাই বৃদ্ধ যাতে কষ্ট না পায় সেদিকে খেয়াল রেখে বললেন,
ডাক্তার : তোমার যা অবস্থা-তাতে রোগ নিরাময়ের কোনো সহজ পথ নেই। এর জন্য তেমন কোনো ওষুধও দেখছি না। তবে তোমাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি। পরামর্শটি হলো, তোমার ভালো ভালো খাবার খেতে হবে এবং মন যা চায় তাই করতে হবে।
ডাক্তারের পরামর্শ বৃদ্ধের খুব ভালো লাগল। সে বলল :
বৃদ্ধ : আপনি ঠিকই বলেছেন ডাক্তার সাব। তবে আমার মন যা চায় তাতো খেতে পারি না অর্থাৎ আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই যে কিনে খাবো।
ডাক্তার : এটা তো সমস্যারই কথা- তবে যা নেই তা নিয়ে মন খারাপ করে লাভ কি? যা আছে তাই মন খুশী করে খাও এবং যা করতে মনটা ইচ্ছে করে তাই করো। সুন্দর সুন্দর কল্পনা করেও কিন্তু মন ভালো রাখা যায়।
বৃদ্ধ : মাশাআল্লাহ, খুব ভালো ডাক্তার আপনি। একদম আমার মনের কথাই বলেছেন। জীবনে কখনো আমার মনের ইচ্ছে পূরণ হয়নি। তাই সুন্দর সুন্দর কল্পনা করাই ভালো।
ডাক্তার: ঠিক আছে এখন যাও, মন যেখানে চায় সেখানে ঘুরে বেড়াও। আশাকরি তোমার মনের আশা পূরণ হবে।
বৃদ্ধ : ডাক্তার সাব, আমার মন চাচ্ছে ঐ সবুজ বনের পাশে যে পানির নহর আছে তার পাশে গিয়ে বসে পানির ছলছল দৃশ্য দেখি।
ডাক্তার : খুব ভালো কথা। যাও, সেখানেই যাও। খোদা হাফেজ।
ডাক্তারের কথা বৃদ্ধের বেশ ভালোই লাগল। মনটা খুশীতে নেচে উঠল। সে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল পানির নহরের কাছে। কলকল রবে পানি বয়ে চলেছে। বৃদ্ধটি মনোযোগ দিয়ে পানির স্রোত ও গতিবিধি দেখতে লাগল। হঠাৎ তার নজর পড়ল নহরের পাড়ে বসা এক দরবেশের ওপর। বৃদ্ধ লোকটি দরবেশকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল। এক সময় তার দৃষ্টি পড়ল দরবেশের বিশাল ঘাড়ের ওপর। এরকম মোটাসোটা ঘাড় দেখে বুড়োর হাত ইসপিস করতে লাগল জোরসে কষে একটা থাপ্পড় দেয়ার জন্য। দরবেশের ঘাড়ে থাপ্পড় বসালে এর যে কী আওয়াজ হবে সে কল্পনা পেয়ে বসল বৃদ্ধকে। তবে তার জানা ছিল না যে, বেহুদা কাউকে থাপ্পড় দেয়া যায় না। তার মনে পড়ল ডাক্তারের কথা। ডাক্তার তাকে বলেছিলেন, তার রোগের একমাত্র ওষুধই হলো মনে যা আসে তাই করা। ব্যস আর যায় কোথায়! বৃদ্ধ হাতের আস্তিন গুটিয়ে হাত তুলল আসমানের দিকে। এরপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরবেশের ঘাড়ে মারলো কষে এক থাপ্পড়। তড়াক করে বিরাট এক আওয়াজ হলো। সাথে সাথে খিলখিল করে সে হাসতে শুরু করল হাড্ডিসার বৃদ্ধ।
থাপ্পড় খেয়ে বেখেয়াল অবস্থায় দরবেশে বেচারা পড়ে যাচ্ছিল পানিতে। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকাল দরবেশ। এরপর দরবেশ বৃদ্ধকে পাল্টা থাপ্পড় মারতে গিয়েও থেমে গেলেন। তার মনে হলো, এই বৃদ্ধকে একটা থাপ্পড় মারলে সে নির্ঘাত মারা পড়বে। তাই শক্ত করে বৃদ্ধে হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন:
দরবেশ : এই বুড়ো, তোর ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে যে, অনর্থক আমাকে মারলি? আবার নিলর্জ্জের মত হাসছিস? পাগল হয়েছিস নাকি?
দরবেশের কথা শুনে বৃদ্ধ বলল:
বৃদ্ধ : জানি না কেন এ কাজ করেছি। শুধু মনটা চাইল আর ডাক্তারও বলেছিল যে, মনে যা আসবে তাই যেন করি। কিন্তু হাসছি এজন্য যে, চমৎকার আওয়াজ হয়েছে। বুঝতে পারলাম না, এ আওয়াজ আমার হাতের না তোমার ঘাড়ের?
দরবেশ : বুঝতে পারছিস না? আয় তোকে বুঝিয়ে দেই।
এ কথা বলেই দরবেশ বৃদ্ধকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে চললেন কাজীর বাড়ী। কাজীকে সব কথা খুলে বলে উপযুক্ত বিচার চাইলেন। কাজী বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখে বললেন, তার উপর কেসাস অর্থাৎ থাপ্পড়ের বদলা থাপ্পড় দেয়া সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়ে দরবেশকে তিনি বললেন,
কাজী : বন্ধু আমার, দেখতেই পাচ্ছেন লোকটিকে একটা থাপ্পড় মারলে ওতেই সে মারা পড়বে। তখন তাকে হত্যার দায় আপনাকেই বহন করতে হবে। তার চেয়ে ওকে মাফ করে দিন। ক্ষমা করার ভেতরও একটা আনন্দ আছে।
দরবেশ : ক্ষমা? কিসের ক্ষমা? কাকে ক্ষমা করব? মানুষ যখন জানবে যে, এ ধরনের অন্যায় কাজের কোনো বিচার হয়নি তখন শহরে অন্যায়, অবিচার ছড়িয়ে পড়বে। কেউ কাউকে মানবে না। কাজীকেও পাত্তা দেবে না। এটা একটা অন্যায় হুকুম। সব খারাপ কাজেরই শাস্তি হওয়া উচিত। আমি তাকে ক্ষমা করব না, ত্রিশ বছর গেলেও না।
কাজী : আহ-হা, আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, লোকটা হাড্ডিসার ও মৃত্যুমুখে পতিত। তার ওপর থেকে অভিযোগ উঠিয়ে নিন না!
দরবেশ এরপরও যখন বৃদ্ধকে মাফ করে দিতে রাজি হলো না তখন কাজী বৃদ্ধের দিকে তাকালেন। বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন :
কাজী : সকালে কি খেয়েছো?
বৃদ্ধ জানাল কিছুই খায়নি। এবার কাজী দরবেশের দিকে তাকিয়ে বললেন,
কাজী : দেখতেই তো পাচ্ছেন লোকটি অভুক্ত। আপনাকে না হয় একটা থাপ্পড়ই মেরেছো । এতে আপনার তো কিছু কমে যায়নি। আচ্ছা, আপনার কাছে কত টাকা আছে?
দরবেশ: ছয় টাকা। কিন্তু টাকার প্রশ্ন আসছে কেন?
কাজী : না- বলছিলাম কি, এ ছয় টাকা থেকে তিনটি টাকা বৃদ্ধকে দিয়ে দিন। বেচারা রুটি কিনে খাবে।
একথা শুনে দরবেশ রেগেমেগে চিৎকার শুরু করে দিল। সে বলল
দরবেশ : আজব বিচার তো! মারও খেলাম আবার টাকাও দেবো? এটা অন্যায় কাজী সাহেব, এটা জুলুম। আমি মানি না এ বিচার।
এরপর শুরু হলো কাজী আর দরবেশের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক। এদিকে বৃদ্ধ ভাবতে লাগল, থাপ্পড় দিলে তাহলে টাকা পাওয়া যায়! আর এক থাপ্পড়ের দাম তিন টাকা! এসময় তার চোখ পড়ল কাজীর ঘাড়ের ওপর। আবার রঙিন কল্পনা তাকে পেয়ে বসল। তার হাত উঠে গেল শূন্যে। সবাইকে চমকে দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে মেরে বসল কাজীর ঘাড়ে। এরপর বলল,
বৃদ্ধ : এবার দুজনেই তিন টাকা করে দিন, তাহলে ছয় টাকা দিয়ে ভালো কিছু কিনে খাওয়া যাবে।
থাপ্পড় খেয়ে লজ্জা আর অপমানে কাজীর মাথা নিচু হয়ে গেল। কিন্তু দরবেশ ভীষণ খুশী হলো। পকেট থেকে ছয় টাকা বের করে এনে কাজীকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
দরবেশ : এই নিন, তিন টাকা আমার থাপ্পড়ের দাম আর তিন টাকা আপনার থাপ্পড়ের দাম। তবে আপনার থাপ্পড়ের দাম আরও বেশী হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আফসোস, আমার হাতে আর কোনো টাকা নাই। নতুবা পুরো দামই দিতাম।
দরবেশের কথা শুনে কাজী আর কোনো কথাই বলল না। অন্যায় বিচার করতে গিয়ে তার যে শিক্ষা হলো, তা ভেবে সে খুবই লজ্জা পেল।
বন্ধুরা, অন্যায় বিচারের পরিণতি সম্পর্কে জানলে। বিচারকদের মধ্যে যদি তাকওয়া না থাকে, তারা যদি আল্লাহকে ভয় না করে তাহলে অন্যায় বিচার চলতেই থাকবে। শুধু বিচারক নয়, আমাদের সবার মধ্যেই তাকওয়া থাকা উচিত। তাকওয়াবান হলে আমরা অন্যায়, অবিচার ও আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ, কথা ও চিন্তা থেকে নিজেকে যেমন বাঁচিয়ে রাখতে পারব তেমনি মহান প্রভূর প্রিয়জন হতে পারব।
বিষয়: বিবিধ
১০২৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন