অর্থ-সম্পদ, খ্যাতি ও ক্ষমতার লোভ-লালসা মানুষকে পশুতে পরিণত করে।
লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ১৫ মার্চ, ২০১৭, ১২:১২:১৬ দুপুর
মানুষ সামাজিক জীব। সে একা চলতে পারে না। তাই প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ বিভিন্ন পেশায় বিভক্ত, একে অপরের চাহিদা পূরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। আর বর্তমানে বিনিময় মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয় অর্থ। জীবন চলার পথে অর্থের গুরুত্ব অপরিসীম, তাই বলে অর্থই সবকিছু নয়। জীবনের জন্য অর্থ, কিন্ত অর্থের জন্য জীবন নয়। তাই ইসলাম অর্থ উপার্জনের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করেছে। আর অর্থলালসার প্রতি করেছে নিরুৎসাহিত। অর্থলালসায় একজন মানুষ যখন মত্ত্ব হয়ে উঠে, তখন তার মন থেকে মায়া, মমতা, ভালোবাসা কমতে থাকে। অর্থলোভ হৃদয় থেকে মনুষ্যত্ববোধ কেড়ে নিয়ে পশুত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। এ আসক্তি মানুষকে এতটাই স্বার্থপর করে দেয় যে, ব্যক্তি আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং বন্ধু-বান্ধব থেকে ক্রমেই দূরে সরে যায়। আপনজন ও কাছের মানুষ হয়ে যায় পর, যখন কারও কাছে অর্থই হয়ে উঠে সব। অথচ এসব অর্থসম্পত্তি আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের অংশ এবং পরীক্ষার বস্তু। তাই আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষের জন্য তার উপার্জনের অংশ নির্ধারণ করে দিয়ে অপরের সম্পদের প্রতি লালায়িত হতে নিষেধ করেছেন।
আল কোরআন বলছে, ‘আর চোখ তুলেও তাকাবে না পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যময় ভোগ বিলাসের প্রতি, যা আমি এদের মধ্য থেকে বিভিন্ন ধরনের লোকদের দিয়ে রেখেছি। এসব তো আমি এদের পরীক্ষার মুখোমুখি করার জন্য দিয়েছি। আর রবের দেয়া রিজিকই উত্তম ও অধিকতর স্থায়ী।’ (সূরা ত্বহা : ১৩১)। আরও বলা হয়েছে, ‘তোমাদের একজনকে আল্লাহ তায়ালা অপরজন থেকে যে অতিরিক্ত সম্পদ দিয়েছেন তোমরা তার জন্য লালায়িত হইও না। পুরুষরা যা উপার্জন করেছে, তা তাদের অংশ আর নারীরা যা উপার্জন করেছে, তা তাদেরই অংশ। আল্লাহর কাছেই তোমরা তার অনুগ্রহ লাভের জন্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয় জানেন।’ (সূরা নিসা : ৩২)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এ আয়াতের ভাবার্থ হলো, ‘মানুষ যেন এ আশা পোষণ না করে যে, যদি অমুক ব্যক্তির সন্তান ও সম্পত্তি আমার হতো।’ (তাফসিরে ইবনে কাছির)। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যাদের আল্লাহ অর্থসম্পদের নেয়ামত দেয়ার পরেও তারা ‘হায় হায়, খাই খাই’ করে বেড়ায়। পাহাড়সম সম্পত্তিও এদের কাছে যথেষ্ট নয়। রাসুল (সা.) বলেন, আদম সন্তানের মালিকানায় যদি সোনার একটি উপত্যকা থাকে, তথাপি সে অনুরূপ আরও একটির মালিকানা লাভে আকাক্সক্ষী হয়ে উঠে। কেবল মাটিই পারে আদম সন্তানের পেট পূর্ণ করতে। অবশ্য যে তওবা করে আল্লাহ তার তওবা গ্রহণ করেন।’ (বোখারি : ৬৪৩৭, মুসলিম : ১০৪৯)।
অর্থলালসা এত বেশি অন্ধ করে দেয় যে, অর্থলোভী মানুষ অর্থ অর্জনের উদ্দেশ্যে কঠিনতম মন্দ কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এমন লোকদের প্রকৃতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা মিরাশের সব ধনসম্পদ সম্পূর্ণরূপে খেয়ে ফেল এবং ধনসম্পদের প্রেমে তোমরা মারাত্মকভাবে বাধা পড়েছ।’ (সূরা ফজর : ১৯-২০)। তাবেঈ হাসান বসরী (রা.) বলেন, ‘যার লোভ-লালসা যত দীর্ঘ হবে, তার কার্যকলাপও তত মন্দ হবে।’ (বায়হাকি, শুয়াবুল ইমাম : ২৩৭৬; যুহদ লিল হাসানুল বসরি, পৃ. ৮২)।
ক্ষুধায় কাতর নেকড়ে বাঘ হয়তো বন্য প্রাণীর বিনাশ ঘটায়। কিন্তু একজন অর্থলোভী মানুষ নিজের মনের ও সমাজের বিনাশ ঘটায়। নিজে অর্থ কামানোর জন্য অপরের স্বার্থ বিনষ্ট করে। এজন্যই হয়তো রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুইটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছাগলের পালে ছেড়ে দিলে তারা যতটা না ক্ষতিসাধন করবে, অর্থলালসা ও খ্যাতিলোভ মানুষের দ্বীনদারির জন্য তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর।’ (তিরমিজি : ২৩৭৬, মুসনাদে আহমদ : ১৫৭৮৪, ইবনে হিব্বান : ৩২১৮)। তিনি আরও বলেন, ‘দিনার ও দিরহাম অর্থাৎ সম্পদের পূজারিরা ধ্বংস হোক।’ (বোখারি : ২৭৩০)।
অতিরিক্ত আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতা যখন মানুষের অন্তরে আসন গেড়ে বসে, তখনই সে অর্থের পিছে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ায়। অর্থসম্পদ ও প্রাচুর্যের মোহ মানুষকে এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যেকটি জিনিস থেকে অমনোযোগী করে তোলে। তারা আল্লাহ, আখিরাত, পরকালীন জবাবদিহিতা, নৈতিকতার সীমা ও নৈতিক দায়িত্ব থেকে গাফেল হয়ে যায়। অধিকারীর অধিকার এবং তা আদায় করার ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে। বিপুল অবৈধ অর্থ জমানোর পর তারা ক্ষমতা পাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। অধিক অর্থের লালসায় পড়ে তারা অবৈধ ভাবে জনগনের অধিকারকে হরণ করে, রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে নিজের বাপ-দাদার সম্পদ মনে করে। ফলে বৈধ-অবৈধ উপায়ে যত বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদই সে লাভ করুক না কেন তার লোভের ক্ষুধা কখনও মিটে না। তাদের আরও চাই। এমন এক সময় আসে তখন অর্থের মোহে পড়ে তারা জনগনের অধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে তাদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করে। টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী, সুদখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজরা তাদের বন্ধু হয়ে ওঠে। ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়োজনে তারা সবাই এক কাতারে চলে আসে, এমনকি মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করে না। তখন সমাজে যা হবার তাই ঘটে থাকে, তাহলো বিশৃঙ্খলা আর বিপর্যয়। এভাবে অর্থের পিছু ছুটতে ছুটতে একদিন মৃত্যু এসে তার সামনে ধরা দেয়। সেদিন তার সব কামাই করা অর্থও তাকে বাঁচাতে সক্ষম হয় না। ফলে সে অতৃপ্তি নিয়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার সেই অতৃপ্তি কখনও মিটে না, অতৃষ্ণা কোনো দিন ফুরায় না। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের এমনভাবে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে, এমনকি যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা কবরস্থানের দিকে ধাবিত হচ্ছ।’ (সূরা তাকাসুর : ১-২)। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আদম সন্তানের বয়স যত বাড়তে থাকে সেই সঙ্গে সতেজ ও সক্রিয় হতে থাকে তার দুইটি বিষয়। তা হলো, অর্থসম্পদের প্রতি লোভ এবং জীবনের প্রতি মোহ।’ (বোখারি : ৬০৫৮, মুসলিম : ২৪৫৯)। এর সর্বশেষ পরিণাম হচ্ছে জাহান্নাম। আল্লাহ বলেন, ‘যারা শুধু পার্থিব জীবন ও তার সৌন্দর্য কামনা করে, আমি তাদের তাদের কাজের প্রতিফল পূর্ণরূপে প্রদান করি এবং দুনিয়াতে তাদের জন্য কোনো কমতি করা হয় না। এরা হচ্ছে এমন লোক যাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নেই। আর তারা যা কিছু করেছিল তা সবই অকেজো এবং বাতিল কাজ বলে পরিগণিত হবে।’
(সূরা হুদ : ১৫-১৬)।
বিষয়: বিবিধ
২০০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন