মানুষের আসল পরিচয় কাজে আর তার জন্য দরকার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা।

লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ৩০ আগস্ট, ২০১৬, ০৪:৫৭:৫৫ বিকাল



তোমরা নিশ্চয়ই 'পুঁথিগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন'- এ প্রবাদটি পড়েছ। বহু বছর থেকে এটি ভাবসম্প্রসারণ হিসেবে পরীক্ষায় আসছে।শিক্ষার্থীরা এর ভালো ভালো ব্যাখ্যা খাতায় লিখে অনেক নম্বর পেলেও বাস্তব জীবনে অনেকেই এর শিক্ষাকে কাজে লাগায় না। ফলে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা সত্ত্বেও অনেকেই কর্মক্ষেত্রে সফল হতে পারে না। এ জন্য অভিজ্ঞ লোকেরা মুখস্থ বিদ্যার সঙ্গে অভিজ্ঞতার সমন্বয় করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তারা মনে করেন, অভিজ্ঞতা থেকে যে যত বেশি শেখে, সে চিন্তায় ও কাজে তত বেশি অগ্রসর হতে পারে।দৈনন্দিন জীবনে অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অপরিসীম। অভিজ্ঞতার কারণেই মাটিতে আপেল পড়ার ঘটনা দেখে বিজ্ঞানী নিউটন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চৌবাচ্চায় নেমে গোসল করতে গিয়ে হালকা বোধ করার অভিজ্ঞতা থেকেই আর্কিমিডিস আবিষ্কার করেন আপেক্ষিক সূত্র। ইতিহাসে এ রকম অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। এছাড়া, নিরক্ষর, অর্ধশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত লোকেরা যে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকেন তার মূলে রয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা। অক্ষরজ্ঞান ছাড়াই একজন কৃষক জমি চাষ করে যে সাফল্য অর্জন করেন তার মূলে রয়েছে অভিজ্ঞতা। তাই আমাদের সবাইকে অভিজ্ঞতা অর্জন এবং অভিজ্ঞতার বাস্তব প্রয়োগ করতে হবে। কেবল পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে ডুবে থাকলে সফল মানুষ হওয়া যাবে না।

বন্ধুরা, অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রমের গুরুত্ব সম্পর্কে রংধনু আসরে কয়েকটি গল্প প্রচার করেছি। আর গল্প শেষে রয়েছে একটি গান। গল্পটি ইরানের বিখ্যাত কবি শেখ সা'দীর জীবন থেকে নেয়া।

শেখ সা'দী একবার বিদেশ সফরে বের হলেন। তিনি বলখ হয়ে ইরাকে যাবেন। ইরাকের কিছু লোক তার সংগী হলেন। তাঁদের মুয়াল্লেম মানে পথপ্রদর্শক হলো একজন তরুণ যুবক। যুবক দেখতে যেমন তাগড়া, তেমনি শক্তিশালী। শক্তিতে সে দশজনের সমান। তীর নিক্ষেপে সে অতি পটু। মুষ্টিযুদ্ধে তার জুড়ি নেই। তাকে কেউ উপরে তুলে আছাড় মারতে পারে না- এসব বাহাদুরীর কথা বলে বলে সে সবার কান ঝালাপালা করে ফেলল। শেখ সা'দী বললেন- ‘তোমার বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে?

যুবক উত্তর দিল : না, আমি কখনও বিদেশে যাইনি।

শেখ সা'দী বললেন, লড়াইয়ের ময়দানে সাহসী যোদ্ধার তরবারীর ঝিলিক দেখেছ কখনো?'

যুবক বলল: না, জনাব।

শেখ সা'দী বললেন, মহাযুদ্ধের বাজনা কখনো শুনেছ ?

যুবক আবার বলল, না।

এভাবে সব প্রশ্নের জবাবে ‘না' শুনে শেখ সা'দী হেসে দিলেন এবং তাকে পথ চলতে বললেন।

কাফেলা এগিয়ে চলতে লাগল। যুবকটি সামনে পুরোনো দেয়াল দেখামাত্র লাথি মেরে ভেঙে খান খান করে ফেলল। ছোটো খাটো গাছ দেখে হাতের মুঠিতে উপড়ে ফেলতে লাগল। হঠাৎ পাহাড়ের ওপর থেকে কয়েকজন ডাকাত তাঁদের দিকে ছুটে এল। শেখ সা'দী বললেন, ‘হে সাহসী যুবক, ডাকাত এসেছে। এবার তোমার শক্তির পরীক্ষা। তোমার বাহাদুরী দেখিয়ে ডাকাতদের মোকাবেলা কর।'

ডাকাত সামনে আসতেই যুবক ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগল। হাত থেকে তীর আপনা আপনি খসে পড়ল। গলা শুকিয়ে গেল এবং দু'চোখ বড় বড় হল। শেখ সা'দী ও তার সঙ্গীরা কোনো উপায় না দেখে সব কিছু ডাকাতের হাতে দিয়ে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচালেন। শেখ সা'দী বললেন : অভিজ্ঞতা না থাকলে দায়িত্বপূর্ণ কাজে কাউকে নিয়োগ করা উচিত নয় ; যেমন ঠিক নয় হিংস্র বাঘ মারতে অনভিজ্ঞ শিকারী। এ গল্প থেকে জানা গেল, লম্বা লম্বা কথা এবং অযথা বাহাদুরী কোন কাজে আসে না। মানুষের আসল পরিচয় কাজে এবং সে কাজের জন্য দরকার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা।

কোনো কাজে অভিজ্ঞতা না থাকলে কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় সে সম্পর্কেই একটি ঘটনা ঘটেছে পাকিস্তানের বিখ্যাত কুস্তিবিদ গোলাম মোহাম্মদ ওরফে গামা পাহলোয়ানের জীবনে। 'পাঞ্জাবের সিংহ' হিসেবে পরিচিত এ মল্লযোদ্ধার সঙ্গে মহাকবি আল্লামা ইকবালের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। একবার এক জনসভায় দু'জনেই উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ কবি দাঁড়িয়ে বললেন, এইবার গামা সাহেব বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু কথা বলবেন। এ ঘোষণা শুনে সবাই হৈ চৈ করে বলে উঠল- ‘হ্যাঁ ', ‘হ্যাঁ' শুনব, আমরা গামা সাহেবের বক্তৃতা শুনব।' গামা পাহলোয়ান চিৎকার করে 'না, না' বলতে থাকলেও কেউ তার কথায় কান দিল না। অগত্যা তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। ডায়াসে গিয়ে অতি কষ্টে বললেন, “ভাইসব, আপনারা দেহের শক্তি বাড়ানোর জন্য সকাল-সন্ধ্যা কুস্তি করবেন।" কাঁপা গলায় এ ক’টি কথা বলতে বলতে তিনি বসে পড়লেন। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, রোজ সকালে আমি একহাজার বৈঠক দেই একফোঁটা ঘাম দেখা যায় না, আর এই শ্বশুরের পুত কবি আমাকে কী মুশকিলে ফেলেছেন যে, আমার শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে।" এই ঘটনাটি থেকে আমরা শিক্ষা পেলাম যে, শারীরিক শক্তিতে একজন মানুষ যতই বলীয়ান হোক না কেন, তার যদি বক্তৃতা করার অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে তিনি অসহায় হতে বাধ্য।



অভিজ্ঞতার পর এবার আমরা পরিশ্রম ও আত্মমর্যাদা সম্পর্কে শেখ সা'দীর লেখা একটি গল্প শোনাব। গল্পটি তৎকালীন আরবের ইয়েমেন প্রদেশের একজন অত্যন্ত জ্ঞানী, নিরহংকারী ও দানশীল ব্যক্তির জীবন থেকে নেয়া। তাঁর নাম হাতেম তাঈ। দানশীল এবং মহৎ ব্যক্তি হিসেবে তার খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। একবার কয়েকজন লোক তাঁর কাছে গিয়ে বললো- আপনি তো মহান এবং দানশীল। আরবের শ্রেষ্ঠ লোক। আপনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাউকে দেখেছেন কি?

হাতেম তাঈ মুখে হাসি ছড়িয়ে বলেন-দেখেছি। কোথায় এবং কাকে দেখেছেন?- সবাই এক বাক্যে জানতে চাইল। হাতেম তাঈ সেই কাহিনীটি বলেন এভাবে-

“একদিন আমি আরবের সব আমীরকে দাওয়াত দিলাম। খানা-পিনায় যাতে কোন ধরনের ত্রুটি বা বদনাম না হয় সেজন্য চল্লিশটি উট জবাই করলাম। রান্না-বান্না শুরু হলো। রান্নার সুঘ্রানে চারদিক মউমউ করছে। আমীরদের আসা শুরু হলো। একজন আমীরের আসতে বিলম্ব দেখে আমি রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলাম। রাস্তার পাশে ছিল বন-জংগল। জংগলে দেখলাম, একজন গরীব কাঠুরে কাঠ কাটছে। তার পা থেকে দর দর করে ঘাম ঝরছে। কাঠুরে গায়ের ঘাম মুচছে আর কাটা কাঠ এক জায়গায় জড়ো করছে। এ কাঠ সে বাজারে গিয়ে বিক্রি করবে এবং সেই পয়সা দিয়ে সংসার চালাবে। আমি আস্তে আস্তে তার কাছে গেলাম এবং অতি নরম সুরে জানতে চাইলাম- তুমি কেন এত কষ্ট করছো? হাতেম তাঈয়ের বাড়ী রোজ রোজ তো হাজার হাজার লোক খাচ্ছে। সেখানে মেহমান হলেই তো তোমাকে এত কষ্ট করতে হতো না। কাঠুরে বিজ্ঞের মত হাসি ছড়িয়ে বলল- যে লোক নিজের গতর খাটিয়ে আহার সংগ্রহ করে হাতেম তাঈয়ের ওপর তাকে নির্ভর করতে হবে না। আমি সেই কাঠুরের কথায় লজ্জা পেলাম এবং তার কাছে হার মানলাম। সেই দিনে আমি বুঝতে পারলাম, আমার চেয়েও সাহসী এবং শ্রেষ্ঠ লোক দুনিয়াতে আছে।”এ ঘটনাটি থেকে আমরা জানতে পারলাম আত্মনির্ভরশীল ও পরিশ্রমী লোকের মর্যাদাই সবচেয়ে বেশী। আর মহান আল্লাহও পরিশ্রমী মানুষকে পছন্দ করেন। ইসলাম পরমুখাপেক্ষিতা পছন্দ করে না। রাসূল (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি নিজেকে পরমুখাপেক্ষী না করার জন্য দুনিয়ায় হালাল উপার্জন করে কিয়ামতের দিন তার মুখমণ্ডল পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় হবে।" অপরদিকে হযরত লোকমান হাকীম তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন-"হে বৎস! উপার্জন ছেড়ে দিও না। কেননা পরমুখাপেক্ষী ব্যক্তির ধর্মীয় চেতনার সাথে সাথে বুদ্ধিও কমে যায় এবং মানুষ তাকে ঘৃণার চোখে দেখে।" আমরা পরনির্ভরশীল না হয়ে পরিশ্রমী হবে। জীবন চলার পথে নানা ঘটনা থেকে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করব। আকাশের মতো উদার মন নিয়ে আমরা আলোর পথে চলব। আঁধার কালো যেন আমাদেরকে কিছুতেই না স্পর্শ করতে পারে। তাহলেই আমাদের জীবন হবে সার্থক।

বিষয়: বিবিধ

১৯১৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

376968
৩০ আগস্ট ২০১৬ রাত ০৮:৪৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File