আঙুর নিয়ে চার ভিক্ষুকের মতবিরোধ

লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ০২ আগস্ট, ২০১৬, ১০:২৬:৩০ সকাল



নিশ্চয় আমাদের জানা আছে যে, বর্তমান বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষ প্রায় ছয় হাজার ভাষায় কথা বলে। কিন্তু কোনো মানুষই সব ভাষা জানেন না। তবে সবাই এ কথা জানেন যে, ভাষা শেখার গুরুত্ব অপরিসীম।

পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.)কে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা ভাষা শিখিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “অসীম দয়াবান আল্লাহ। তিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাকে কথা বলতে শিখিয়েছেন।”

আল্লাহতায়ালা আরো বলেছেন, “আমি যখনই কোনো রাসূল পাঠিয়েছি, সে নিজের জাতীয় ভাষায় জনগণকে আমার আহ্বান পৌঁছিয়েছে। এ ব্যবস্থা আমি এ জন্যে করেছি, যাতে করে সে খুব সুন্দর করে পরিস্কারভাবে তাদের বুঝতে পারে।”

এ আয়াত থেকে আমরা ভাষা শেখার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি। ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাসূল (সা) তাঁর নিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী যায়েদ ইবনে সাবেত আনসারীকে ইহুদীদের ভেতর দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্যে তাদের ভাষা হিব্রু শিখতে বলেন। যায়েদ (রা.) মাত্র ১৩ দিনে হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন।

ভাষা শেখার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জানলাম। ভাষা না জানলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে সে সম্পর্কে একটি গল্প । গল্পটি নেয়া হয়েছে মাওলানা রুমীর বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবী থেকে। তাহলে শোনা যাক আজকের গল্প ‘মতবিরোধ’।

একবার এক শহরে চার দেশের চারজন ভিক্ষুক এক জায়গায় মিলিত হলো। তারা কেউ কারো ভাষা বুঝতো না। কেবল ভাষাগত দিক থেকেই নয় বরং বর্ণ এবং জাতিগত দিক থেকেও এদের একজন আরেকজন থেকে ছিল আলাদা। ভিক্ষুকদের একজন ছিল ইরানি, একজন ছিল আরব, অপরজন ছিল তুরস্কের আর বাকিজন ছিল গ্রীক দেশীয়। কেউ কারো ভাষা না জানলেও আকারে-ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় করত তারা। যা কিছু দেখত তা-ই নিজ নিজ ভাষায় একে অপরকে শেখাত। যেমন-ইরানি ভিক্ষুক পানি দেখিয়ে বলত, ফার্সিতে একে বলে ‘অব’। আরব বলত, আমরা একে বলি ‘মাহ’। তুর্কি ভিক্ষুক জানাত তাদের দেশে একে বলে ‘সূ’। এভাবেই তারা পরস্পর ভাব ও ভাষার আদান-প্রদান করে ঘনিষ্ঠ হতে লাগল।

একদিনের কথা। দুপুরে চার ভিক্ষুক এক জায়গায় এসে জড়ো হলো। যার যার খাবারের পুঁটলী খুলে রাখলো সামনে। সবার হাতেই এক টুকরো করে রুটি। ইরানি ভিক্ষুক বলল : “আমি বাপু এ রকম শুকনো রুটি খেতে পারিনে। গলা দিয়ে নিচে নামতেই চায় না। আমার কাছে টাকাও নেই যে, আঙুর বা অন্যকিছু কিনে রুটির সাথে মিশিয়ে খাবো। যদি কারো কাছে টাকা-পয়সা থাকে তাহলে কিছু একটা নিয়ে এসো। আগামীকাল না হয় আমি তোমাদের পুষিয়ে দেব।”

ইরানি ভিক্ষুকের কথা শুনে বাকী তিন ভিক্ষুক জানালো তাদের হাতেও কোনো টাকা-পয়সা নেই। কী আর করা! উপায়ন্তর না দেখে সবাই শুকনো রুটিই চিবানো শুরু করল। ঠিক এ সময় ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলো এক পথিক। ভিক্ষুকদের শুকনো রুটি খেতে দেখে তার মনে দয়া এল। পথিক পকেটে হাত দিয়ে কয়টি টাকা দিল একজনের হাতে। টাকা পেয়ে ভিক্ষুকরা খুশী হয়ে পথিকের জন্য দোয়া করল।

পথিক চলে গেলে ইরানি বলল : বন্ধুরা! টাকা তো আমাদের হাতে এসে গেছে। চলো এ টাকা দিয়ে বাজার থেকে আঙুর কিনে আনি। আঙুর দিয়ে রুটি খেতে খুব মজা!

কিন্তু অন্য তিনজন বেঁকে বসল। তাদের একজন বলল, আমরা আঙুর খাব না। আঙুর আবার খাওয়ার জিনিস হলো নাকি!

ওরা আসলে আঙুর কি ধরনের ফল তা জানত না। আরব লোকটি তখন বলল : আঙুর বাদ দাও। তারচে বরং ‘ইনাব’ কিনি।

এমন সময় তুর্কি ভিক্ষুক বাধ সাধল। সে বলল: আমি বাপু ‘ইনাব’ খেতে চাই না। তোমরা যদি আমার মতামত চাও তাহলে আমি বরং বলব ওযোমের কথা। ওযোম খুবই মজার এবং সুস্বাদু একটি ফল।

বাকি থাকল আর গ্রীক ভিক্ষুক। শেষ পর্যন্ত সেও অন্য সবার মত্ অগ্রাহ্য করে ‘ইস্তাফিল’ খেতে চাইল। এ সময় ইরানি ভিক্ষুক বলল: আরে বাবা! একদিনে কি সবার মন রাখা যাবে? তারচেয়ে তোমরা বরং আমার কথা শোন। আমি হচ্ছি তোমাদের সবার চেয়ে বয়সে বড় এবং অভিজ্ঞ। আমিই বলছি আঙুর ফল খেতে খুব সুস্বাদু। আজ না হয় আঙুরই খাই।

এ কথা শুনে আরব লোকটি রেগে গেল। সে বলল : তুমি বড় হয়েছো তো কি হয়েছে? রেখে দাও তোমার মুরুব্বীয়ানা। তাছাড়া জানোইতো আরবরা কারো কাছে মাথানত করে না। আমার কথা খুবই স্পষ্ট- আজ আমরা ‘ইনাব’ই খাব।

এ কথা শুনে তুর্কি বেচারার ধৈর্য ভেঙে গেল। সে বলল : দয়া করে এখানে আরব- আজমের ঝগড়া বাধাবে না। যদি ঝগড়া করার প্রশ্নই ওঠে, তাহলে জেনে রাখো- তোমাদের মতো দু’চারজনকে কুপোকাত করার মত শক্তি আমার গায়ে আছে। আমি তুর্কি, কাউকে সমীহ করা তুর্কিদের কাজ নয়। তর্ক যখন বেঁধেছে তাহলে জেনে রাখো- ওযোম ছাড়া অন্য কিছুই খাব না।

এবার গ্রীক ভিক্ষুক মুখ খুলল। সে বলল : আহ্‌হা। কেন তোমরা রাগারাগি করছো? তারচেয়ে চলো- এ টাকা ভাগাভাগি করে কিছু আঙুর, কিছু ইনাব, কিছু ওযোম আর কিছু ইস্তাফিল কিনে আনি। ঝগড়া করার কি আছে বুঝতে পারলাম না।

আরব ভিক্ষুক তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল : এখানেও ফিরিঙ্গিবাজী করতে চাও- তাই না? ‘ভাগ করো, শাসন করো’- এ নীতি তোমাদের ইউরোপীয়দের এক ধরনের দুর্নীতি। তা এখানে চলবে না। আমরা সবেমাত্র একে অপরের বন্ধু হয়েছি। এখানে ওই ফিরিঙ্গিপনা বাদ দাও।

আরব ভিক্ষুকের কথায় গ্রীক বেচারার মেজাজ গেল বিগড়ে। সে চেঁচিয়ে ওঠে বলল: ফাজলামী শুরু করেছো- তাই না? ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লাগতে আসবে হিসাব করে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে থাপ্পড় দিয়ে তোমার দাঁত ফেলে দেব।

ব্যস, শুরু হয়ে গেল-তর্ক-বিতর্ক, শোরগোল ও চেঁচামেচি। সে সময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ। ভিক্ষুকদের ঝগড়াঝাটি শুনে তাদের কাছে এগিয়ে এলেন। তিনি তাদের কাছে ঝগড়ার কারণ জানতে চাইলেন।

ভিক্ষুকরা বৃদ্ধকে বলল- আমাদের একজন চায় আঙুর, একজন চায় ইনাব, একজন ওযোম আরেকজন চায় ইস্তাফিল। কিন্তু আমাদের কাছে যে টাকা আছে তা দিয়ে সব তো কেনা যাবে না। কিন্তু কেউ কারো কথা রাখছে না। ঝগড়ার এটাই কারণ।

বৃদ্ধ ছিলেন লেখাপড়া জানা মানুষ। তিনি আরবী, ফার্সি, তুর্কি আর গ্রীক ভাষাও মোটামুটি জানতেন। ভিক্ষুকদের কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। বৃদ্ধকে হাসতে দেখে ভিক্ষুকরা আশ্চর্য হয়ে গেল। তারা হাসির কারণ জানতে চাইলে বৃদ্ধ বললেন : আমি হাসছি তোমাদের বোকামী দেখে। তোমরা যদি জানতে আঙুর, ইনাব, ওযোম আর ইস্তাফিল একই ফল তাহলে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে না। তোমরা একে অপরের ভাষা জানো না বলেই এই সমস্যা হয়েছে।

বৃদ্ধের কথা শুনে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তারাও স্বীকার করল- কেউ কারো ভাষা না বুঝার কারণেই এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এরপর তারা সবাই মিলে আঙুর ফল কিনে সবাই মিলে মজা করে খেলো।

ওই ঘটনার পর চার ভিক্ষুকের মধ্যে সম্পর্ক আরো গভীর হলো। তারা পরস্পরের ভাষা শেখার সিদ্ধান্ত নিল। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা ভাষা শেখা শেষ করল এবং সবাই মিলে চার ভাষায় অভিধান তৈরির কাজ শুরু করল।

শিক্ষণীয়ঃ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দল নিরপেক্ষ সরকার, বহুদলীয় সরকার যে নামেই ডাকা হোক না কেন বাংলাদেশের জনগন সেই সরকারের অধীনে একটা নির্বাচন আশা করে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যুদ্ধাবস্থা ঐ চার মূর্খ ভিক্ষুকের ঝগড়ার অনুরুপ।

বিষয়: বিবিধ

১৩৬৮ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

375762
০২ আগস্ট ২০১৬ দুপুর ১২:৩১
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..

একই রকম কাহিনী হচ্ছে ইসলাম, জিহাদী বই এবং জঙ্গী নিয়ে
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
375764
০২ আগস্ট ২০১৬ দুপুর ১২:৪৭
মুহাম্মদ_২ লিখেছেন : পারস টুডে থেকে?!
375768
০২ আগস্ট ২০১৬ দুপুর ০২:৩৯
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
375775
০২ আগস্ট ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:২১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
375785
০২ আগস্ট ২০১৬ রাত ০৯:০৯
দ্য স্লেভ লিখেছেন : গল্পটা অনেক শিক্ষনীয়

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File