'সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ'
লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ০৩ আগস্ট, ২০১৬, ১১:৪১:১৪ সকাল
আমরা সকলেই নিশ্চয় স্বীকার করব যে, মানুষ তার বন্ধুর দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই বন্ধু নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখা উচিত কাকে বন্ধু বানানো হচ্ছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোন কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এমনটি করবে, আল্লাহ তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবেন না।”
সূরা মুদ্দাসসিরের ৪২ ও ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “বেহেশতবাসীরা দোজখবাসীদের জিজ্ঞাসা করবে, তোমরা কেন দোজখের অধিবাসী হলে? জবাবে দোজখবাসীরা কয়েকটি কারণ বলবে। তারমধ্যে একটি হিসেবে তারা বলবে, আমরা এমন লোকদের সাথে চলাফেরা করতাম যারা ছিল অসৎ।”
অন্যদিকে, রাসূল (সা.) বলেছেন, 'দুনিয়াতে যার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা রয়েছে, পরকালে তার সঙ্গেই হাশর হবে। তিনি আরও বলেছেন, মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। সুতরাং বন্ধু নির্বাচনের সময় খেয়াল করা উচিত সে কাকে বন্ধু বানাচ্ছে।'
নবীজি আরও বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে কাউকে ভালোবাসল, তাঁর জন্যই কাউকে ঘৃণা করল, তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাউকে দান করল এবং তা থেকে বিরত থাকল তবে নিঃসন্দেহে সে নিজ ঈমানকে পূর্ণতা দান করল।'
পবিত্র কুরআন ও হাদিসের এসব বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হলো যে, সব ধরনের লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাকে ইসলাম সমর্থন করে না। এ জন্য বন্ধু নির্বাচনের আগে তাকে পরীক্ষা করে নেয়া জরুরি।
আমরা নিশ্চয়ই ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ' এই প্রবাদ বাক্যটি শুনেছি। ইরানের বিখ্যাত মনীষী শেখ সাদী (রহঃ) এর এই প্রবাদ বাক্যটির মূল বক্তব্য হচ্ছে, একজন উত্তম বন্ধু যেমন জীবনের গতি পাল্টে দিতে পারে, তেমনি একজন অসৎ বন্ধু জীবনকে ধ্বংসের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিতে পারে। ইরানি অপর এক কবি বলেছেন, অসৎ বন্ধু থেকে দূরে থাকো, কেননা সে বিষাক্ত সাপ থেকেও ভয়ংকর। বিষাক্ত সাপ কেবল তোমার জীবনের ক্ষতি করবে কিন্তু অসৎ বন্ধু তোমার জীবনের সাথে সাথে তোমার ঈমানও শেষ করে দিবে। তাই ইসলাম ধর্মে অসৎ ব্যক্তিদের কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য ব্যাপক তাগিদ দেয়া হয়েছে। অসৎ সঙ্গের পরিণতি সম্পর্কে একটি গল্প।
মনে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘কেউ অসৎ হলে আমাদের সমস্যা কোথায়? আমরা আমাদের মতো চলব।’ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মানুষ ইচ্ছে করলেই বন্ধুর প্রভাবমুক্ত থাকতে পারে না। অসৎ বন্ধুর গুণ অন্য বন্ধুকে প্রভাবিত করবেই। আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (রাঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘যদি ভালো লোক খারাপ লোকের সাথে উঠাবসা করে তাহলে তার মাথায়ও খারাপ চিন্তা চলে আসে।‘ ইমাম জাওয়াদ এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘খারাপ বন্ধুর সাথে চলাফেরা করো না। কারণ সে খোলা তলোয়ারের মত, যার বাইরের চেহারা সূন্দর কিন্তু ফলাফল খুবই বিপজ্জনক।‘ নবী বংশের মহান ইমাম হযরত জাফর সাদিক (রহঃ) বলেছেন, ‘একজন মুসলমানের জন্য এটা কখনই ঠিক নয় যে, সে একজন গুনাহগারের সাথে বন্ধুত্ব করবে।‘
কিন্তু কারো মধ্যে ভালো গুণ দেখে বন্ধুত্ব করার পরও যদি তার মধ্যে খারাপ গুণ দেখা যায় তাহলে কি করতে হবে? এক্ষেত্রে প্রথমে তাকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সে যদি নিজেকে সংশোধন করতে রাজি না হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। যেমনটি করেছিলেন, আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদেক (রহঃ)।
'ইমাম জাফর সাদেকের এক বন্ধু ছিল; যে সব সময় ইমামের সাথে ঘোরাফেরা করতো। একদিন ইমাম বাজারে গেলেন। সঙ্গে সেই বন্ধু ও তার কাজের ছেলেটি ছিল। বাজারে ঘুরতে ঘুরতে কাজের ছেলেটি কৌতুহল বশতঃ এটা ওটা দেখছিল এবং মাঝে মাঝে পরিচিত লোকদের সাথে কথা বলছিল। এতে সে তার মনিবের কাছ থেকে একটু পিছিয়ে পড়ল। আর এদিকে ইমাম ও তার বন্ধুটি বাজারের মাঝখানে চলে গেল। হঠাৎ পেছনের দিকে তাকিয়ে কাজের ছেলেকে না দেখে ইমামের বন্ধুর মেজাজ বিগড়ে গেল। কিছুকক্ষন পর ছেলেটি ফিরে এলে মনিব তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। ইমামের সামনেই সে কাজের ছেলেটির বাপ-মা তুলে গালি দিল। লোকটির অশ্লীল কথাবার্তা শুনে ইমাম অবাক হয়ে তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'হায় আল্লাহ! একি করলে তুমি! ছেলেটির বাপ-মা তুলে গালি দিলে? আমি তো মনে করেছিলাম তুমি একজন ধার্মিক ও খোদাভীরু লোক। এখন দেখছি সামান্য তাকওয়াও তোমার মধ্যে নেই !'
ইমামের কথা শুনে লোকটি বলল, আপনাকে আর কি বলব, এই ছেলেটি আসলেই বদ। তার মা সিন্ধু থেকে এসেছিল। ওই বেটির জন্মেরও কোন ঠিক ছিল না। তাছাড়া সে মুসলমানও ছিল না। সে ক্ষেত্রে তাকে কিছু বলা মোটেও অন্যায় হয়নি।'
ইমাম বললেন, 'আমি জানি ওই মহিলা একজন অমুসলিম ছিল। কিন্তু তোমার জানা দরকার, প্রত্যেক ধর্মেরই নিজ নিজ আইন-কানুন আছে। একজন অমুসলিম তার নিজ ধর্মের আইন অনুযায়ী বিয়ে করলে অশুদ্ধ হয় না। তাদের বিয়ের পর সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করলেও তা অবৈধ হয় না। তুমি ছেলেটির মাকে অন্যায়ভাবে অপবাদ দিয়েছো। তাই তোমার সাথে বন্ধুত্ব রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব না। আজ থেকে তোমার সাথে আমার সম্পর্কের অবসান হলো। এ ঘটনার পর ইমাম জাফর সাদেকের সাথে ওই লোকটিকে আর কখনই দেখা যায়নি।'
ইমাম জাফর সাদেকের মত আমাদেরও অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত। তবে তাই বলে একেবারে বন্ধুহীন থাকলে চলবে না। কারণ বন্ধুহীন জীবন নাবিকবিহীন জাহাজের মতো। একজন প্রকৃত বন্ধুই সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার অংশীদার হয়। প্রকৃত বন্ধুই পারে আত্মার আত্মীয় হয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দুঃখ-কষ্টকে ভুলিয়ে রাখতে। নিটসে বলেছেন, 'বিশ্বস্ত বন্ধু হচ্ছে প্রাণ রক্ষাকারী ছায়ার মতো। যে তা খুঁজে পেল, সে একটি গুপ্তধন পেল।'
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন লোকের সাথে বন্ধুত্ব করা উচিত? ইমাম গাযযালী (রহঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, 'সবাইকে বন্ধু নির্বাচন করা যাবে না, বরং ৩টি গুণ দেখে বন্ধু নির্বাচন করা উচিত। গুণ তিনটি হল-
১. বন্ধুকে হতে হবে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ
২.বন্ধুর চরিত্র হতে হবে সুন্দর ও মাধুর্যময় এবং
৩. বন্ধুকে হতে হবে নেককার ও পুণ্যবান
ফরাসি এক প্রবাদে বলা হয়েছে, 'বন্ধুত্ব হলো তরমুজের মতো। ভালো একশটিকে পেতে হলে এক কোটি আগে পরীক্ষা করে দেখতে হয়। 'রাসূল (সাঃ) বলেছেন, শেষ বিচারের দিন সকল বন্ধুই শত্রুতে পরিণত হবে তবে একমাত্র সৎ বন্ধুই সেদিন প্রকৃত বন্ধু হিসেবে পরিচয় দেবে। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সততা, আমানতদারি, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা প্রভৃতি গুণের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। তাই বন্ধুত্ব যদি করতে হয় তাহলে ইসলামের নির্দেশনা অনুসারে বন্ধু নির্বাচন করা উচিত।
বিষয়: বিবিধ
২০৯৯ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন