পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের ৭১ সালের যুদ্ধটি ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ।
লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৪:৪৩:০৮ বিকাল
পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধটি ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। ইসলামের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ হয় কীভাবে, ইসলামই তো মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশের প্রেরণা ছিল। কেননা জুলুম বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইসলামই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। গোড়া থেকেই ইসলাম জুলুম সহ্য করেনি। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বারবার জুলুম করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। নানা উপলক্ষে জুলুমের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। উপরন্তু জুলুম প্রতিরোধে ইসলামে জেহাদের বিধান রাখা হয়েছে।
আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এর ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র বা চলচ্চিত্র কিংবা পরিবারের কাছে রণাঙ্গন থেকে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠিপত্র দেখলেই সে কথা জানতে পারি। এসব থেকে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে যাওয়ার আগে নামাজ পড়ে আল্লাহর উদ্দেশে মোনাজাত করে রওনা হয়েছেন। বাবা, মা বা স্ত্রীর অশ্রু-সজল চোখের দিকে চেয়ে তাদের হৃদয় নিংড়ানো দোয়া আর প্রার্থনা শুনেই তারা ছুটেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের শতকরা একজনও ধর্মবিরোধিতা বা ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ থেকে যুদ্ধে যাননি।
বছরখানেক আগে আমি গিয়েছিলাম শেরপুরের এক সীমান্তঘেঁষা পল্লী মরিয়ম নগরে। ওই গ্রামে একটি ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। আলোচক হিসেবে সেখানে যাওয়ার সময় দুর্গম পথে দেখা হয়েছিল স্থানীয় একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সঙ্গে। নাম মনে না থাকলেও ভদ্রলোকের শ্মশ্রুম-িত টুপি-পাঞ্জাবি পরা ইসলাম অন্তঃপ্রাণ চেহারাটি মনে এখনও জ্বলজ্বল করছে। দুর্গম পথে এক পর্যায়ে তিনি আমাদের সঙ্গী হলেন পথপ্রদর্শক হিসেবে।
গাড়িতে পাশের সিটে বসে আমি দাদার বয়সী ওই মুরুবি্বর ছোট্ট একখান সাক্ষাৎকারই নিয়ে ফেললাম। জানালেন ক'দিন পরেই তিনি ঢাকায় আসছেন মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে। সেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা দেবেন প্রধান অতিথি হিসেবে। তার মুখে এ প্রসঙ্গ শুনতেই আমার মনে হলো তাকেই জিজ্ঞেস করা দরকার আমার দীর্ঘদিনের লালিত সেই মোক্ষম প্রশ্নটি। আচ্ছা দাদু, আপনারা যুদ্ধ করেছিলেন কি কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে? দ্ব্যর্থহীনভাষায় তার উত্তর : 'বাবা, আমরা লড়াই করেছি জালেম হটিয়ে মজলুমদের বাঁচাতে। ইসলামই আমাদের সে প্রেরণা জুগিয়েছে। ইসলাম কখনও জালেমের পক্ষে নয়। ইসলাম সব সময় জালেম নির্মূল করতে বলে। আচ্ছা, স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের ক'জন আছেন, যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস নিয়ে মরেননি? তারা সবাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেই লড়াই করেছেন। এ সম্পদ বুকে নিয়েই শহীদ হয়েছেন। আমরা সবাই ফজর নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কেঁদে বুক ভাসিয়ে মোনাজাত করেই চলে গেছি যুদ্ধক্ষেত্রে।'
মাওলানা শাকের হোসাইন শিবলি সহস্রাধিক পৃষ্ঠার শেকড়-সন্ধানী একটি ঢাউস বই লিখেছেন। বহুল প্রশংসিত সেই বইটির নাম 'আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ের ইতিহাস। এ চেতনায় শত শত আলেমের অস্ত্র তুলে নেয়ার রোমাঞ্চকর ইতিবৃত্ত। বইটির প্রকাশনা উৎসবে আমন্ত্রিত দেশের প্রবীণ সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন স্পষ্ট বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ইসলামের কোনো বিরোধ নেই। ঢালাওভাবে আলেমদের কিংবা টুপি-দাড়ি দেখলেই রাজাকার বলা স্বাধীনতার চেতনা নয়।
বঙ্গবন্ধু মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তার শুরুতেই পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা হয়। সেখানে যে মাওলানা সাহেব কোরআন তেলাওয়াত করেছিলেন তার ছোট ভাই স্বনামখ্যাত লেখক-অনুবাদক মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীর মুখে তার গৌরবদীপ্ত বর্ণনা শুনেছি। আলোকিত বাংলাদেশের এ পাতায় কদিন আগে তার সাক্ষাৎকারও ছাপা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু যে ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন সেখানে তার শেষ উক্তি ছিল, 'এ দেশের মানুষকে মুক্ত করেই ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।' এ 'ইনশাআল্লাহ' শব্দের মধ্যেও তার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও ভরসার চেতনা ফুটে ওঠে। তার বক্তব্য থেকেও তো কখনও মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের বিপক্ষে যুদ্ধ বলে মনে হয়নি।
যে দেশের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধের প্রেরণা ছিলেন, যে দেশের জেলখানায় তিনি বিনা বিচারে নয় মাস বন্দি ছিলেন, সে দেশের প্রতি তিনি প্রসন্ন হতে পারেন না। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েক মাসের মাথায় তিনি পাকিস্তানে ওআইসির সম্মেলনে যোগদান করেন। নিজের ক্ষোভ ও কষ্ট মনে পুষে রেখে তিনি এতে যোগদান করেন কেবল 'উম্মাহ চেতনায়' উদ্বুদ্ধ হয়ে। এটিও তার ইসলাম সম্পর্কে ইতিবাচক মানসিকতাকে প্রমাণ করে।
আমার ব্যক্তিগত পড়াশোনায় দেখেছি, পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম এমনকি বিশ্বের শীর্ষ আলেমরাও এ যুদ্ধকে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের বৈধ ও উচিত লড়াই বলে আখ্যায়িত করেছেন। পাকিস্তানের বিশ্বখ্যাত আলেম সাবেক বিচারপতি মুফতি তাকী উসমানীর বিশ্বভ্রমণ কাহিনীর বই 'জাহানে দীদাহ'-এর বাংলাদেশ ভ্রমণ অংশে এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামিক স্কলার ড. ইউসুফ আল-কারযাবীর ভ্রমণ কাহিনীর বাংলাদেশ অধ্যায়েও এ সত্যের অকুণ্ঠ সমর্থন করা হয়েছে। তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধকে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ বলেই আখ্যায়িত করেছেন।ইসলামে দেশপ্রেমের গুরুত্ব অপরিসীম।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানিরা গণহত্যা ও নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। কোরআনে একজন নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা গোটা মানবজাতিকে হত্যার সমতুল্য অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, 'নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেনো দুনিয়ার সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে হত্যা করল; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেনো পৃথিবীর সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।' (সূরা আল মায়েদা : ৩২)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'দুনিয়া ধ্বংস করে দেয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।' (তিরমিজি)।
লেখকঃ আলী হাসান তৈয়ব (সংগৃহীত)
বিষয়: বিবিধ
১১৫২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই পোস্ট জামায়াতিদের পশ্চাদ দেশে আগুন ধরিয়ে দেবে ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন