আল্লাহর কাছে (কোরবানির) রক্ত-মাংস কিছুই পৌছে না। পৌছে কেবল তোমাদের সদিচ্ছা-তাকওয়া।'
লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৫:৩৩:৩০ বিকাল
কোরবানির দিনে প্রত্যেক সজ্ঞান, সামর্থ্যবান, সাবালক, মুকিম মুসলিমের জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব। আল্লাহর সন্তুটিই যার একমাত্র উদ্দেশ্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা কোরবানি করে না, তারা যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩১২৩)।
কোরবানির সময় মোট তিন দিন_ ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ। ১০ জিলহজ ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত কোরবানি করা যায়। তবে প্রথম দিন করাই উত্তম। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোরবানি করতে না পারলে একটি মধ্যম মানের ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। পরবর্তী বছর কাজা কোরবানি করা জরুরি নয়। (ফাতাওয়া শামী : ৯/৪৫২; বাদায়ে সানায়ে : ৪/২০২; খুলাসাতুল ফাতাওয়া : ৪/৩০৯)।
কোরবানির জন্য দিনের বেলাটাই অধিক উপযোগী। অযথা রাতেরবেলা কোরবানি করা সমীচীন নয়, মাকরুহ। এতে অঙ্গহানিসহ পশুর অধিকাংশ রগ না কাটার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তাই দিনেরবেলা করাই শ্রেয়। তবে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকলে রাতেও করার অবকাশ রয়েছে। (ফাতাওয়া শামী : ৬/৩২০; ফাতাওয়া কাজিখান : ৩/৩৪৫)।
কোরবানি একটি মহৎ ইবাদত। নিছক লৌকিকতা বা অহঙ্কারের জন্য কোরবানি করলে তা কখনোই কবুল হয় না। সেজন্য কোরবানি হওয়া চাই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, 'আল্লাহর কাছে (কোরবানির) রক্ত-মাংস কিছুই পৌছে না। পৌছে কেবল তোমাদের সদিচ্ছা-তাকওয়া।' (সূরা হজ : ৩৭)। এজন্য কবুলিয়তের লক্ষ্যে মনে মনে নিয়ত করা জরুরি। তবে পশু জবাই করার সময় মুখে নাম উচ্চারণ করা বা পড়ে শোনানো জরুরি নয়। (সূত্র : ফাতাওয়া শামী : ৬/৩১৫; বাদায়ে সানায়ে : ৫/৬৩-৬৪; কিফায়াতুল মুফতি : ৮/১৮৬-১৮৭)।
হাদিস শরিফে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানির কথা এসেছে। সে হিসেবে নিজ বাড়ির পালিত পশু দ্বারা কোরবানি করা চাই। তা না হলে সামর্থ্যানুযায়ী ভালো পশু কিনেও করা যাবে। আর মহব্বত ও ভালোবাসার কারণেই কোরবানির পশু নিজ হাতে জবাই করা উত্তম। তা না হলে অন্তত জবাইয়ের সময় উপস্থিত থাকা কর্তব্য। (বাদায়ে সানায়ে : ৫/৭৯; ফাতাওয়া কাজিখান : ৩/৩৫৫)।
কোনো কারণে কোরবানির পশু নিজে জবাই করতে না পারলে সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি। কেননা জবাইকারী মুসলমান হওয়া আবশ্যক। কোনো অমুসলিম বা বিধর্মী দ্বারা জবাই করালে কোরবানি সহিহ হবে না। আবার জবাইয়ের সময় জবাইকারী ও তার ছুরি চালনায় সহযোগীদের বিসমিল্লাহ বলাও জরুরি। ইচ্ছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ না বললে কোরবানি সহিহ হবে না। এমনকি তার গোশত খাওয়াও বৈধ হবে না। বরং সেটি মৃত প্রাণী বলেই বিবেচিত হবে। (সূত্র : ফাতাওয়া শামী : ৬/২৯৬; আল ইখতিয়ার : ১/৫১)।
জবাইকালে ছুরিটি তীক্ষ্ন, ধারালো হওয়া বাঞ্ছনীয়। ভোঁতা বা কম ধারালো ছুরি দ্বারা জবাই করলে পশু কষ্ট পায়। সেজন্য এরূপ ছুরি দ্বারা জবাই করা মানবতা পরিপন্থী ও মাকরুহ। তেমনি পশুর কমপক্ষে তিনটি রগ (খাদ্যনালি, শ্বাসনালি ও শাহ রগ দুটির যে কোনো একটি) কাটা জরুরি। এর ব্যত্যয় ঘটলে কোরবানি সহিহ হবে না। (সূত্র : আল ইখতিয়ার : ১/৫১)।
কোরবানির সময় উটকে নহর আর গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদিকে জবাই করা মুস্তাহাব। জবাইয়ের ক্ষেত্র হলো পশুর চোয়াল ও বুকের মাঝামাঝি স্থান অর্থাৎ গলা । এজন্য পশুর ঘাড় বাঁ পিঠের দিক থেকে জবাই করা মাকরুহ। এতে পশু কষ্ট পায়। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রগ কাটার আগেই প্রাণীটির মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। সে জন্য গলার দিক থেকেই জবাই করা বাঞ্ছনীয়। (আল ইখতিয়ার : ১/৫১)।
জবাইয়ের সময় পশুর দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও কোরবানি সহিহ হবে এবং তার গোশতও খাওয়া যাবে। তবে বিনা প্রয়োজনে এমনটা করা মাকরুহ। এতে পশুকে অযথা কষ্ট দেয়া হয়। তবে এ কারণে কোরবানিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। (আল ইখতিয়ার : ৫/১২; মুখতাসারুল কুদুরি : ২৭৬)।
ঘটনাক্রমে কোরবানির দিনগুলোতে শক্তিশালী কোনো গরু-মহিষের কাছে যাওয়া সম্ভব না হলে বা কূপ কিংবা খাদে পড়ে যাওয়া কোনো পশু জীবিত ওঠানো সম্ভব না হলে ধারালো অস্ত্র দ্বারা দূর থেকে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত করলেও তা বৈধ হবে এবং তার গোশত খাওয়া হালাল হবে। (আল বাহরুর রায়েক : ৮/১৭১; ফাতাওয়া শামী : ৬/৩০৩; আল ইখতিয়ার : ১/৫১)।
উন্নত বিশ্বের কোথাও কোথাও মেশিনে জবাইয়ের প্রচলন রয়েছে। কোরবানির পশু এভাবে জবাই করা সমীচীন নয়। হক্কানি ওলামায়ে কেরাম এটাকে ভালো মনে করেন না। সে জন্য এ থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। তবে কোথাও যদি এমনটা করতেই হয় তাহলে সুইচদাতাকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে এবং বিসমিল্লাহ বলে সুইচ অন করতে হবে। নতুবা কোরবানি সহিহ হবে না। তার গোশত খাওয়াও হালাল হবে না। (ফাতাওয়া শামী : ৯/৪২৭; আল ইখতিয়ার : ৫/৯; আপকে মাসাইল : ৪/১৩০)।
জবাইয়ের পর পশুটি নিস্তেজ হওয়ার আগেই তার রগ কাটা বা চামড়া ছিলতে শুরু করা মানবতা-বিবর্জিত ও মাকরুহ। এতে পশুর অসম্ভব কষ্ট হয়। সুতরাং নিস্তেজ হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করা জরুরি। (সূত্র : সুনানে নাসায়ি : ৪৪১৭; কিতাবুল ফাতাওয়া : ৪/১৮৮)।
মানবতার খাতিরে ঈদের দিন সবাই পরস্পরকে সহযোগিতা করে। ইমাম পশুটি জবাই করে দিয়ে যান। মহল্লা ও সমাজের কেউ কেউ পশুর চামড়া ছেলা ও গোশত বানানোর কাজে সহযোগিতা করেন। সে জন্য তাদের প্রত্যেককেই কিছু সম্মানী দেয়া কর্তব্য। সেটা ঈদ বোনাসের নামেও হতে পারে। কেননা ঈদের দিন কাউকে দিয়ে ফ্রি শ্রম নেয়া সমীচীন নয়। তাই অন্যের মাধ্যমে জবাই করালে, সহযোগিতা নিলে তাদের যথোপযুক্ত সম্মানী দেয়া একান্ত কর্তব্য। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ৪/৪৫৪; কিফায়াতুল মুফতি : ৮/২৪৩)।
অথচ কাজ শেষে দেখা যায়, তাদের কাউকে মাথা, রান, ভুঁড়ি বা সামান্য পরিমাণ গোশত দেয়া হয়। আবার কখনও হুজুরকে চামড়া দিয়েই বিদায় করা হয়। আসলে এমনটা কাম্য নয়। এক্ষেত্রে মাসয়ালা হলো_ কোরবানির কোনো অংশ পারিশ্রমিক বা বিনিময় হিসেবে দিলে সেটা বৈধ হয় না। কারণ কোরবানির পশুর কোনো অংশ বিক্রয় বা বিনিময়যোগ্য নয়। তবে হাদিয়া হিসেবে দেয়া যেতে পারে। (ফাতাওয়া শামী : ৯/৪৭৫; বাদায়ে সানায়ে : ৫/৮১; ফাতহুল কাদির : ৮/৪৩৭)।
বিষয়: বিবিধ
১৪০৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"..স্মরণ করাও, আর স্মরণ করানোটা মুমিনদের জন্য কল্যানকর হয়"
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
আমাদের দেশের অনেকেই কুরবানির মুল উদ্দেশ্যকে অবজ্ঞা করে বড় পশু কে দেখিয়ে চলতে ভাল বাসে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন