জাকাতের যত বিধি-বিধান
লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ১৩ জুলাই, ২০১৪, ০২:০০:৫৪ দুপুর
জাকাত যাদের ওপর ফরজ : প্রয়োজনের অধিক 'নিসাব' পরিমাণ (বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ) অর্থসম্পদ (স্বর্ণ-রুপা, নগদ টাকা ও ব্যবসাপণ্য) কারও কাছে এক বছর কাল থাকলে, তাকে তার নিম্নবর্ণিত খাতগুলোর সমুদয় অর্থসম্পদের ২.৫% (শতকরা আড়াইভাগ) জাকাত প্রদান করা ফরজ। ঋণ থাকলে তা বাদ দিয়ে হিসাব করতে হবে। যদি তার প্রয়োজনের অধিক স্থাবর সম্পদ থাকে এবং ঋণের পরিমাণ ওই সম্পদের চেয়ে কম হয় তবে তা বাদ যাবে না। আর যদি ঋণের পরিমাণ ওই সম্পদের চেয়ে বেশি হয় তবে সে সম্পদ পরিমাণ ঋণ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ঋণ জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে হিসাব করতে হবে। যে ঋণ পরিশোধের জন্য কিস্তি নির্ধারিত আছে সে ঋণের বর্তমান কিস্তি (যদি পরিশোধ না করা হয়ে থাকে) বাদ দিতে হবে। অনুরূপ বর্তমান মাসের যাবতীয় খরচও বাদ রাখবে। প্রাপ্ত বয়স্ক ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সবার ওপর উপরোলি্লখিত শর্তে জাকাত প্রযোজ্য। জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য বালিগ (সাবালক) হওয়া শর্ত নয়। কারও ওপর জাকাত ফরজ অবস্থায় তার মৃত্যু হলে প্রথমে তার সম্পদ থেকে জাকাত আদায় করতে হবে। অবশিষ্ট সম্পদ যথারীতি ব্যবহৃত হবে। (জাকাত নির্দেশিকা, পৃষ্ঠা : ১২৮)।
নিসাবের পরিমাণ : 'নিসাব' হলো ১. সোনা ২০ দিনার/মিছকাল বা ৭.৫ (সাড়ে সাত) ভরি, রুপা ২০০ দিরহাম (৫ উকিয়াহ) বা ৫২.৫ (সাড়ে বায়ান্ন) ভরি অথবা এর সমমূল্যের নগদ টাকা ও ব্যবসাপণ্য। সেকালে ৭.৫ ভরি সোনা ও ৫২.৫ ভরি রুপা মূল্যমানে সমান ছিল। বর্তমানে (২০১৪ সালে) সোনা ৪০ হাজার টাকা ভরি হিসেবে ৭.৫ ভরির মূল্য হয় তিন লাখ টাকা প্রায়, আর রুপা এক হাজার টাকা ভরি হিসেবে ৫২.৫ ভরির মূল্য হয় ৫০ হাজার টাকা প্রায়।
বর্তমানে সোনা ও রুপা কোনটি নিসাব হিসাবে শ্রেয় : সোনা ও রুপা উভয়টিই যেহেতু নিসাবের মূল সূত্রের অন্তর্ভুক্ত, তাই উভয়ের যে কোনো একটির মূল্য ধরলেই হবে। বর্তমানে যেহেতু রুপার মূল্য সোনা অপেক্ষা অনেক কম, তাই সতর্কতা ও পরহেজগারী হলো অল্পটি নেয়া। এতে একদিকে যেমন জাকাত দাতার (ইবাদতকারীর) সংখ্যা বাড়বে, অন্যদিকে গরিবের বেশি উপকার হবে; যা জাকাত, সদকা ও ইনফাকের মূল আবেদন। উল্লেখ্য, ১ ভরি = ১ তোলা বা ১১.৩৩ গ্রাম; সুতরাং ৭.৫ ভরি = ৮৫ গ্রাম, ৫২.৫ ভরি = ৫৯৫ গ্রাম।
মৌলিক প্রয়োজনীয় বস্তু : মৌলিক প্রয়োজন হলো_ একজন মুসলমান অপচয় ও কার্পণ্য ছাড়া মধ্যপন্থায় তার নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন মিটাতে যা প্রয়োজন হয়। যথা_ থাকার ঘর, ঘরের আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, গৃহস্থালি সামগ্রী, পেশা সংক্রান্ত উপকরণ, কারখানার যন্ত্রপাতি, যোগাযোগ-যাতায়াতের বাহন, পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যদ্রব্য। এসব জাকাতের আওতামুক্ত।
জাকাতযোগ্য সম্পদ : ১. সোনা ৭.৫ ভরি বা তদূর্ধ্ব। রুপা ৫২.৫ ভরি বা তদূর্ধ্ব অথবা এর সমমূল্যের। ২. নগদ টাকা, বিনিময়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা, ব্যাংক চেক, ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার, পোস্টাল অর্ডার, মানি অর্ডার, শেয়ার সার্টিফিকেট, কোম্পানি শেয়ার, ডিও লেটার, সঞ্চয়পত্র, সিকিউরিটি মানি, জামানত, প্রাইজ বন্ড, ট্রেজারি বন্ড ইত্যাদি। ব্যাংকে বা অন্য কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা আমানত; যেমন_ বীমা, এফডিআর, ফিঙ্ড ডিপোজিট, পোস্টাল সেভিংস, বিশেষ সঞ্চয়, পেনশন স্কিম ও স্বেচ্ছা প্রভিডেন্ট ফান্ড, ডিভিডেন্ট এবং ফেরত পাওয়ার যোগ্য প্রদত্ত ঋণ, যেসব ইচ্ছা করলে তুলে আনা যায়। ৩. ব্যবসাপণ্য এবং শোপিস ও মূলবান পাথর। যেমন_ হীরা, মণিমুক্তা ইত্যাদি। এসবের বর্তমান বাজার মূল্য অর্থাৎ বর্তমানে নতুন কিনতে যে মূল্য। শেয়ার সার্টিফিকেটের নামিক মূল্য ও বাজার দরের মধ্যে যেটি বেশি সেটি হিসাব করতে হবে। ব্যবসায়িক নার্সারি/হর্টিকালচার/বীজ উৎপাদন খামার, কৃষিখামার, বনজ বৃক্ষ খামার, ফলদ বৃক্ষ খামার, ঔষধি গাছের খামার, চা বাগান, রাবার বাগান, তুলা/রেশম/আগর/অর্কিড এবং ফুলবাগান, মুরগির খামার, মাছের খামার ইত্যাদি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামগ্রী। ৪. গবাদি পশু। যেমন_ গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ও উট ইত্যাদি।
যৌথ মালিকানা বা কোম্পানির জাকাত : যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জাকাত কীভাবে হবে এ নিয়ে ২টি মতামত রয়েছে। ১. কোম্পানি বা মালিকগণের সম্পদ আলাদা আলাদা হিসাব করে দেয়া হবে। এবং এ সম্পদে যদি মালিক সাহেবে নিসাব হন বা তার অন্য সম্পদসহ যদি তিনি সাহেবে নিসাব হন তবে জাকাত দিতে হবে; অন্যথা নয়। ২. যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে একক ব্যক্তি ধরে মোট সম্পদ হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। (জাকাত নির্দেশিকা, পৃষ্ঠা ১৫)। তবে যৌথ মালিকানার ক্ষেত্রে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান সম্মিলিত সম্পদ থেকে জাকাত প্রদান করলে সে সম্পদের জাকাত পুনরায় দিতে হবে না। প্রথম পদ্ধতিটি উত্তম ও শ্রেয়তর বলে মনে হয়। কারণ কোম্পানির এমন কোনো অংশীদার থাকতে পারেন যার সম্পদ নিসাব পরিমাণ নয় অথবা তার এ সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদ মিলেও নিসাব পরিমাণ হবে না। তাহলে তাকে জাকাত প্রদানে বাধ্য করা সঠিক হবে না। তদুপরি মালিকে নিসাব হলেও সব অংশীদারের জাকাত বর্ষের শুরু-শেষ এক নাও হতে পারে এবং প্রদানের ক্ষেত্রেও যার যার পছন্দের খাত ও ব্যক্তি নির্বাচন অধিক সওয়াব ও ফায়দার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বটে।
জাকাতের আওতামুক্ত সম্পদ : ১. স্থায়ী বা স্থাবর সম্পদ। যেমন_ জমি, বাড়ি-ঘর, মূলধনী যন্ত্রপাতি। মনে রাখতে হবে যদি জমি, প্লট, ফ্ল্যাট, গাড়ি ইত্যাদি বিক্রয় বা ব্যবসার উদ্দেশ্যে রাখা হয় তবে তাতে জাকাত প্রযোজ্য হবে। কারণ এগুলো অস্থাবর সম্পদ। ২. সরকার নির্ধারিত কর যা না দিয়ে পারা যায় না। ৩. যে অর্থসম্পদ অন্যের কাছে আছে, যা ফেরত পাওয়ার আদৌ নিশ্চয়তা নেই। সেসব অর্থসম্পদের জাকাত দিতে হবে না। তবে যদি কখনও হস্তগত হয় তাহলে এর বিভিন্ন অবস্থা হতে পারে : (ক.) শুধু মূল ফেরত পাওয়া (এমতাবস্থায় বর্তমান জাকাতবর্ষের হিসাবে ধরে জাকাত দিবে)। (খ.) লাভসহ ফেরত পাওয়া (এ অবস্থায় পেছনের বছরগুলোর জাকাত পরিশোধ না করে থাকলে তা আদায় করে বর্তমান জাকাত বর্ষের হিসেবে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করবে)।
জাকাতের শর্ত : অন্তত পক্ষে 'নিসাব' পরিমাণ অর্থ এক বছর (বার চান্দ্র মাস বা ৩৫৪ দিন) থাকা শর্ত। কারও কারও মতে, জাকাত বর্ষের শুরুতে ও শেষে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলেই জাকাত প্রযোজ্য হবে। উল্লেখ্য যে, জাকাত চান্দ্রবর্ষের হিসাব অনুযায়ী আদায় করতে হয়। চান্দ্রবর্ষ ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে হয়, যেহেতু সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে বা ৩৬৬ দিনে হয় তাই সৌরবর্ষ অপেক্ষা চান্দ্রবর্ষ ১১ বা ১২ দিন কম। সৌরবর্ষ হিসেবে জাকাত আদায় করতে চাইলে শতকরা ২.৫% (আড়াই ভাগ) এর পরিবর্তে ২.৫৭৮% (বা ২.৫৮% প্রায়) দিতে হবে।
বছর অতিক্রান্ত হওয়া বা বছর পূর্ণ হওয়া : জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য অন্তত নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক চান্দ্র বছর (৩৫৪ দিন) থাকতে হবে, একে আরবিতে হাওলানে হাওল অর্থাৎ বছর পূর্ণ হওয়া বা বছর অতিক্রান্ত হওয়া বলে। স্মর্তব্য যে, সম্পূর্ণ সম্পদের বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত নয়। জাকাতবর্ষ পূর্তি বা জাকাত হিসাব সমাপনী দিনে ওই তিন খাতে যত সম্পদ থাকবে পুরোটারই জাকাত দিতে হবে। বছরের মধ্যে যে কোনো সময় অর্থাগম ঘটলে, বছর শেষে জাকাত প্রদান করতে হবে। যেদিন অর্থসম্পদ নিসাব পর্যায়ে পেঁৗছবে সেদিন থেকেই জাকাত বর্ষ গণনা শুরু হবে। (জাকাত নির্দেশিকা, পৃষ্ঠা : ১০৭)। তা না হলে প্রতি মাসে এমনকি প্রতি দিনেও জাকাত দিতে হতো, কারণ অনেক ব্যবসায়ীকে বছরে প্রতিদিনই অর্থাগম হয়। কোনো খনিজসম্পদ বা গুপ্তধন কারও হস্তগত হলে তার জাকাত তাৎক্ষণিক প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত নয়। (জাকাত নির্দেশিকা, পৃষ্ঠা : ১৬)। তবে তিনি মালিকে নিসাব হলে, জাকাতবর্ষ পূর্তিতে পুনরায় এ সম্পদসহ সম্পূর্ণ সম্পদের জাকাত দেবেন।
জাকাতবর্ষ ও হিসাব সমাপনী দিন এবং জাকাতের পরিমাণ : সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত রমজান মাসেই জাকাত আদায় করতেন। তাই রমজানের যে কোনো একটি দিনকে সমাপনী দিন ধরে উপরোক্ত জাকাতযোগ্য খাতগুলোর সব সম্পদের হিসাব করে জাকাত নির্ধারণ করতে হবে। শর্ত পূরণ হলে জাকাতযোগ্য সম্পদের 'রুবউ উশর' অর্থাৎ ২.৫% (শতকরা আড়াই ভাগ/ চলি্লশ ভাগের এক ভাগ) জাকাত প্রদান করতে হবে।
কৃপণের জাকাত : আড়াই পারসেন্ট (২.৫%) বা ৪০ ভাগের একভাগ জাকাত হলো ফরজ। আল্লাহর প্রিয়ভাজন হওয়ার জন্য আরও বেশি দান-সদকা করার কথা পবিত্র কোরআন ও হাদিসে রয়েছে। যেমন : '(হে রাসূল সা:!) তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে তারা কি ব্যয় করবে? আপনি বলুন, অতিরিক্ত (যতদূর সম্ভব) সবই (দান কর)।' (সূরা বাকারা : ২১৯)। তাই হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেছেন, ২.৫% হলো কৃপণের জাকাত। (তিরমিজি)
মুফতি শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
(সংগৃহীত)
বিষয়: বিবিধ
১৪৭৮ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন