কেমন করে একটি জাতির পতন ঘটানো যায় ?
লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ২০ মে, ২০১৪, ১১:০৩:৫৫ সকাল
মার্কিন সামরিক বাহিনীর এক কর্মকর্তা, কর্নেল ডান (Colonel Dan) এক চমৎকার গবেষণামূলক প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘কোনো গুলি খরচ না করে বা এক ফোঁটা রক্ত না ঝরিয়ে একটি জাতির পতন ঘটানো সম্ভব।’ তার ‘কেমন করে জাতির পতন ঘটানো যায়’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘এ কাজটি করিয়ে নিতে হয় ভেতর থেকে। সে জাতির সমাজ ও রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে।’ তিনি বলেছেন, অতীতে এ কাজটি কঠিন ছিল এবং দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতো। প্রযুক্তি এখন তা সহজ ও সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছে। কার্যকলাপ-যেমন প্রচারণা ও দখল, এমনভাবে চলবে যেন সমাজ ও রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় নিয়ন্ত্রণে আসতে চায়। এ জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতরটার মানসিক পরিবর্তন করে জাতিটাকে দাসে পরিণত করতে হবে। কর্নেল ডান বলেছেন, যে বিষয়গুলো রাষ্ট্র ও জাতিকে দিকনির্দেশনা (sense of direction) দেয় সেগুলোকে প্রথমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেমন সমাজের মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও পরিবার। প্রচার ও আন্দোলন দিয়ে এগুলোকে অপাঙ্তেয় করে সেখানে নতুন নিয়ন্ত্রিত মূল্যবোধ ও বিশ্বাস সৃষ্টি করতে হবে, যা চলবে ক্ষমতাধরদের নির্দেশে। জাতির গর্ব করার সব বিষয় বুদ্ধিমত্তার সাথে তুচ্ছ করে ফেলতে হবে। এমনকি পোশাক বা শারীরিক অবয়বকেও। যেমন কেউ যদি শ্মশ্রুকে বিশ্বাসের অংশ মনে করে, তাকে তুচ্ছ বা অনাকাক্সিত করে তুলতে হবে। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের কেন্দ্রীয় অভিকর্ষ হারিয়ে তাদের জীবন ধারণের নতুন উদ্দেশ্যকে আঁকড়ে ধরবে। এ জন্য সংবাদ মাধ্যমকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং এ মাধ্যম যেন শুধু চাহিদা মোতাবেক সত্য বলে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। যেহেতু বেশির ভাগ দর্শক অলস, অর্ধ বা অশিক্ষিত, চিন্তাহীন, তাই তারা সংবাদমাধ্যমের আঁকা সব ছবিই সত্য মনে করে। এ মাধ্যমকে দিয়ে জনগণকে বিভক্ত করে মিথ্যার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে হবে। আর একটি প্রধান কাজ হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণ দখল করে সেখানে শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাইয়ের জন্য এমন শিক্ষাক্রম দিতে হবে যেন এখান থেকে প্রয়োজনীয় যোদ্ধা পাওয়া যায়। এসব শিক্ষার্থী নিজেদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কার ও বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করে, ক্ষমতাধরদের দেয়া নীতি-জীবনব্যবস্থাকে শ্রেয় মনে করবে। এমনটি হলে সমাজ ও রাষ্ট্র ভেতর থেকেই ভেঙে পড়বে। যখনই দেখা যাবে কোনো জাতির যুবাশ্রেণী ঐতিহ্যগত বিশ্বাস, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ওপর বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছে, তখন বুঝতে হবে আত্মহননের প্রথম পদক্ষেপ দৃঢ়ভাবে নেয়া হয়েছে। জাতির পতন ঘটাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের অন্যতম হলো রাজনৈতিক দর্শনের পরিবর্তন। সরকারের সর্বস্তরে অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে। দু’টি স্তরে বিশেষ মনোনিবেশ করতে হবে। তা হলো সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগ। সেখানে নির্ভরযোগ্য অনুগতদের ঢোকাতে হবে। তখন এরা সব অন্যায়-অনাচারকে আইনসম্মত করে দেবে। রাজনীতি দখলে থাকার ফলে প্রয়োজনীয় আইন নির্মাণে কোনো অসুবিধা থাকবে না। এর পরের ধাপে জাতীয়তাবাদকে ঘোলাটে করে ফেলতে হবে। এর জন্য ভাষা ও কৃষ্টিকে বিশেষভাবে পরিচালিত করার লক্ষ্যে বিশেষ বাহিনীর সৃষ্টি করতে হবে। এরা তাদের প্রচার, বক্তব্য ও অন্যান্য আন্দোলনের মাঝ দিয়ে ঐতিহ্যগত কৃষ্টি, ভাষা ও নৈতিকতাকে অপরিচিত করে তুলবে। এর সাথে সাথে অর্থনীতিকে দুর্বল করে ফেলতে হবে। এটা সহজ। শুধু খরচ আর খরচ করতে হবে আর নির্মাণকাজ চালু রেখে দেশকে ঋণী করে ফেলতে হবে। কর্নেল ডান বলেছেন, সুচতুর পরিচালনার মধ্য দিয়ে শুধু এ কর্মকাণ্ডগুলোই ভেতর থেকে জাতিকে আত্মহননের দিকে নিয়ে যাবে।
একজন গবেষক জাতির আত্মহনন ও রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য সব কর্মকাণ্ডকে সংক্ষেপে দশটির মধ্যে ধারণ করেছেন। এ পথগুলো হলোÑ ১. জাতিকে দুই ভাগ করে বিরামহীন সঙ্ঘাত সৃষ্টি করা, ২. কোনো দল, সংগঠন বা জনগণকে একত্র হতে না দেয়া ৩. ধর্ম ও প্রচলিত সংস্কার, কৃষ্টি ও নৈতিকতাকে বিকৃত করে প্রচার ও কর্মকাণ্ড চালানো ৪. সংবাদমাধ্যমকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা ও তাদের দুই ভাগ করে একে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যস্ত রাখা ৫. সব নির্বাচিত পদ ও অফিসগুলো দখল করা ৬. সরকারের ভেতরের ও বাইরের সব নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা এবং তাদের সব স্বাধীনতা নিষিদ্ধ করা বা সীমিত করা ৭. পরিবার ও পারিবারিক মূল্যবোধকে মূল্যহীন করে সামাজিক ঐক্য ও বন্ধনকে দুর্বল করে ফেলা ৮. অর্থজোগান ও অর্থনীতিকে দুর্বল করা ৯. সব ক্ষমতার উৎসকে নির্মূল করা এবং তার সাথে খাবার ও পানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা ১০. সামরিক বাহিনীকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এর নেতৃত্বে শুধু অনুগতদের রাখা যেন অঙ্গুলি নির্দেশে এ বাহিনী পরিচালিত হয়।
গবেষক বলেছেন, যখন কোনো দেশে এ দশটি পথ নির্মিত হবে তখন যেকোনো অদৃশ্য ক্ষমতা সে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে সক্ষম হবে আর সে জাতিও আত্মহননে প্রস্তুত থাকবে।
তবে তারা আর একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। যারা এমনভাবে সহজেই দেশ ও রাষ্ট্র দখল করবে, তারা তাদের অবস্থান দৃঢ় রাখার জন্য সাধারণত কয়েকটি পদ্ধতির অনুসরণ করে। আমেরিকান এম্পায়ার প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা টম এঞ্জেলহার্ট বলেছেন, ‘এ ক্ষমতাবানেরা সাতটি পদ্ধতি চালু রাখে। তারা হলোঃ ১. অপহরণ (এটা ৯/১১ পরে চালু হয় এবং ৫৪টি দেশ বিশেষভাবে এটা পরিচালিত করছে) ২. প্রতিবাদী, বিরোধীদের ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে অত্যাচার (টর্চার) চালু রাখার জন্য গোয়েন্দাসংস্থাসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনকে নিয়োগ করা ৩. অপরাধের সব প্রমাণ চিহ্ন মুছে ফেলা ৪. আইনবহির্ভূত কারাগার নির্মাণ ও সেখানে বিরোধী ও প্রতিবাদীদের রাখা (এটা এখন বিশ্বব্যাপী প্রধান পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে) ৫. রাজবন্দীদের এমন কারাগারে নানা অপবাদ দিয়ে হত্যা করা ৬. বিশিষ্ট ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হত্যা (অ্যাসাসিন) করা ৭. পার্লামেন্টে মিথ্যা বলা ও সত্য প্রকাশে বাধা দেয়া।
টম বলেছেন, এ সাতটি কার্যক্রমের একটি প্রধান উদ্দেশ্য যেন কেউ সঠিক তথ্য না জানতে পারে। কারণ জ্ঞান (বা জানা) যেন বিস্তার লাভ না করে। কারণ জ্ঞান বা জানাটাই এখন অপরাধ (নলেজ ইজ নাউ এ ক্রাইম)। আর একজন বিখ্যাত লেখক ক্রিস হেজেছ (Chris Hedges) লিখেছেন, ক্ষমতার উৎস জনগণ না হয়ে অস্ত্র হওয়ার জন্য সঙ্ঘাতের রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটছে। তিনি লিখেছেন, আমেরিকানদের হাতে ৩১ কোটি অস্ত্র (১১.৪ কোটি হ্যান্ড গান, ১১ কোটি রাইফেল ও ৮.৬ কোটি শটগান) এবং এর ব্যবহার হয় প্রতিদিন যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন ২৮২ জন গুলিবিদ্ধ হয়। হেজেছ বলেছেন, ‘যারা বলেন বিপ্লবের প্রয়োজন এবং সঙ্ঘাতের গুণগান করেন, তারা আসলে অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা।’ এটা শুধু আত্মহননের পথ। এখান থেকে ফিরতে হলে জনগণকে সত্য জানতে হবে এবং তাদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সব প্রচারণা, বক্তব্যকে গভীরভাবে লক্ষ রাখতে হবে। কেন না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর উদ্দেশ্য থাকে জনগণকে দাসে পরিণত করে ক্ষমতা ও স্বার্থকে দৃঢ় করা। এমন কমকাণ্ড তৃতীয় বিশ্বেই ব্যাপক। (সংগৃহীত)
বিষয়: বিবিধ
১১৫৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন