রাগের মাথায় কোনো কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলে সে কাজের পরিণতি ভালো হয় না, নিশ্চিত পরাজয় অথবা ব্যর্থতা বয়ে আনে।
লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ০৬ মে, ২০১৪, ১০:৩২:২৬ সকাল
তরুলতায় ভরা ঘন এক জঙ্গল। বহুদূর থেকেও দেখা যায় জঙ্গলের বিশাল বিশাল গাছের সবুজ ছাতার উপরে পাখিদের ওড়াউড়ি। মনে পড়ে যাবে বাংলাদেশের গর্ব সুন্দরবনের কথা। যাই হোক ওই বনের বিরাট একটি গাছের মগডালে ছিল একটি কাকের বাসা। কাকটির মনে খুব কষ্ট ছিল। এমন কষ্ট যে তার পুরো জীবনটাই যেন বেদনার কালো রঙে ছেয়ে গিয়েছিল। নিজের পালকগুলো দেখে তার মনে হতো এই রঙ তার মনের ভেতরে জমাট বাঁধা বেদনার। কিন্তু কেন? এমন কী ঘটেছে কাকের জীবনে? কেন তার জীবনের থরে থরে কষ্টের এতো কালো আঁধার?
এ প্রশ্ন যে কোনো শ্রোতা কিংবা পাঠকের মনকেই আবিষ্ট করবে সন্দেহ নেই। সেটাই বরং বলছি। কাক যে গাছটিতে বাসা বেঁধেছিল ওই গাছের কাছে বিরাট একটা সাপের বাসাও ছিল। সাপটা যেমন ছিল বড়সড় তেমনি দেখতেও ছিল ভীষণ কুৎসিত। দীর্ঘদিন ধরে সাপ এখানে বসবাস করে আসছে। কাকের বাসা যতদিন এখানে অন্তত ততদিন সে তো ছিলই। বলা যায় কাকের পুরনো প্রতিবেশি এই সাপ। কিন্তু কাজে সাপটা একেবারেই প্রতিবেশিসুলভ ছিল না। প্রতিবেশি তো বন্ধুর মতো হয় কিন্তু সাপটার কাজকর্ম ছিল শত্রুসুলভ।
কাক যখন তার বাসায় ডিম পাড়ত এবং ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটাতো, সাপটা তখন সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো বাচ্চাগুলোকে খাওয়ার জন্য। যখনি কাক বাচ্চাদের জন্য খাবার আনতে যেত সেই সুযোগে সাপটা কাকের বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলত। আশ্চর্য কত উপরে কাকের বাসা! সাপ গাছ বেয়ে বেয়ে সেই বাসা পর্যন্ত যেত এবং বাচ্চাগুলোকে খেত। পরপর অনেকবার এভাবে সন্তানদের হারিয়ে কাক কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। সন্তান হারানোর শোকই তার জীবনটাকে নিজের পালকের মতো কালো অন্ধকারে ভরে দিয়েছিল। তুষের আগুনের মতো তপ্ত আর ভয়ংকর বিষাক্ত সেই শোক কাকের জীবনে বার্ধক্যকে ত্বরান্বিত করেছিল।
কাকের বাসায় এখনো বেশ ক'টি ছানা আছে। কিন্তু কাক কিছুতেই বাচ্চাগুলোকে বাসায় রেখে বাইরে যেতে চাচ্ছে না। আবার না গিয়েও উপায় নেই। বাচ্চাদেরকে তো খাওয়াতে হবে। কী করা যায়...ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল কাক। পাশেই ছিল আরেক প্রতিবেশী। শেয়াল। অনেকদিন ধরেই এখানে শেয়ালের বাস। কখনো খারাপ কিছু দেখে নি সে। কাক ভাবলো শেয়ালের কাছে বাচ্চাগুলোকে রেখে গেলে কেমন হয়। দেরি করার সুযোগ নেই। বাচ্চাগুলো না খেয়ে আছে। সাথেসাথেই কাক বাচ্চাগুলোকে পায়ের নখে আটকে নিয়ে চলে গেল শেয়ালের কাছে।
কাকের অবস্থা দেখে শেয়াল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। জিজ্ঞেস করলো: কী হয়েছে কাক! এরকম বিমর্ষ লাগছে কেন তোমাকে?
কাক তার স্বভাবসুলভ কা-কা কর্কশ কণ্ঠে বলল: আমার এক প্রতিবেশী সাপ, দেখতে যেমন বিশ্রী কাজেকর্মে আরো বেশি নোংরা। যেদিন থেকে সে জেনেছে আমি গাছের ডালে বাসা বেঁধেছি, তখন থেকেই সে আমাকে কষ্ট দিয়ে আসছে। সে এ পর্যন্ত আমার বহু বাচ্চাকে খেয়েছে।
শেয়াল বলল: এটা তো কোনো ব্যাপারই না। তুমি বাসা পাল্টাও, অন্য কোনো গাছে গিয়ে বাসা বানাও, তাইলেই তো আর সমস্যা থাকে না।
কাক বলল: হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো, এ ছাড়া তো আর কোনো উপায় দেখছি না। কিন্তু এখান থেকে অন্য কোথাও যাবার আগে চাচ্ছি প্রতিশোধ নিতে। সাপ আমার বাচ্চাদেরকে জীবিত খেয়েছে, এর প্রতিশোধ আমি নেবই নেব। সাপের সাথে লড়াই করব, হয় আমি মরবো নৈলে সাপকে মারব।
শেয়াল বলল: কিন্তু এটা তো কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হলো না। কেননা তুমি রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছ। রাগের মাথায় কোনো কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলে সে কাজের পরিণতি ভালো হয় না, নিশ্চিত পরাজয় অথবা ব্যর্থতা বয়ে আনে। ঠাণ্ডা মাথায় ভালোভাবে চিন্তা কর। সাপের সাথে তো তুমি পারবে না। সাপ সহজেই তোমাকে কাবু করে ফেলবে। ফলে তুমি না পারবে বেঁচে থাকতে আর না পারবে তোমার বাচ্চাদের প্রতিশোধ নিতে।
কাক বলল: ঠিক বলেছো, কিন্তু কী করবো তাহলে?
শেয়াল খানিক চুপ থেকে কী যেন বুদ্ধি আঁটল। কাককে সে কানে কানে বলল আর কাক খুশি হয়ে গেল। মনে হলো যেন সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি কাক তার বাচ্চাগুলোকে শেয়ালের কাছে রেখে বিদায় নিয়ে উড়াল দিল।
উড়তে উড়তে কাক গিয়ে পৌঁছল এক গ্রামের কাছে। সেখানে একটি বাড়ির উঠোনে এক মহিলাকে দেখল পানির হাউজের পাশে বসে জামা কাপড় ধুচ্ছে। তার সোনার আংটিটা আঙুল থেকে খুলে পাশেই রেখে দিয়েছে। কাক ওই ঘরটির ছাদের ওপরে নেমে বসল। তেমন একটা নড়াচড়া করল না। মহিলা তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে শেষ করে যখন রোদে শুকাতে দিতে গেল কাক তখন আংটিটা দুই ঠোঁটের মাঝে নিয়ে আস্তে আস্তে উড়াল দিলো। মহিলা দেখেই চীৎকার চেঁচামেচি করে মানুষ জড়ো করে ফেলল। লাঠিসোটা যে যা পেয়েছে হাতের কাছে তাই নিয়েই তারা কাকের পেছনে পেছনে দৌড়তে লাগল। কাক উড়তে উড়তে গিয়ে পৌঁছল তার বাসার কাছে সাপের গর্তের ঠিক উপরে। লোকজনও দৌড়তে দৌড়তে সাপের গর্তের কাছে গেল। অমনি কাক সোনার আংটিটা নীচে ফেলল। আংটি গিয়ে পড়লো ঠিক সাপের গর্তের মুখে।
সাপ বুঝতে পারলো আংটি একটা তার গর্তের মুখে পড়েছে। সে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো। আংটিটার কাছে যেতেই লোকজন ভালো করে লাঠিপেটা করলো সাপটাকে। একজন তো বিরাট একটা পাথর দিয়ে চেপে সাপটাকে মেরেই ফেললো। সাপ মরে যাবার পর আংটিটা তুলে নিল তারা। কাক এতোক্ষণ গাছের ডালে বসে বসে দেখছিল কাণ্ড কারখানা। সাপের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর উড়াল দিয়ে সোজা চলে গেল শেয়ালের কাছে। শেয়ালকে সব ঘটনা খুলে বলল এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাল। এরপর কাক তার বাচ্চাগুলোকে বুঝে নিয়ে ফিরে গেল তার বাসায়।
বিষয়: বিবিধ
১২৭৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন