শত্রুকে কখনো বিশ্বাস করতে নেই এবং শত্রুর কাছে কখনো কোনোরকম কল্যাণ আশা করতে নেই।

লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ২৮ এপ্রিল, ২০১৪, ১২:৪৩:৪৪ দুপুর



একটা পুকুরের পাড়ে বসে ছিল একটা সারস পাখি। সারস অনেকটা বকের মতোই তবে ঠোঁটটা আরেকটু চওড়া এবং লম্বা। উভয় পাখিই মাছ শিকার করে জীবন ধারণ করে। সারস পাখিটি তীরে বসেই ক্লান্ত অবসন্ন দৃষ্টি দিয়েছিল পুকুরের পানির ভেতর ঘুরে বেড়ানো মাছগুলোর দিকে। ছোট বড় কত রকমের কতশত মাছ মনের আনন্দে, নিশ্চিন্তে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। আহা কত স্বাধীন তারা। সারসের খুব অনুতাপ হচ্ছিল, আক্ষেপ হচ্ছিল। আক্ষেপ তার মাছের স্বাধীনতার জন্যে নয় বরং তাদের স্বাধীনতা নষ্ট করে ভোগ করতে না পারার কষ্টের কারণেই দুঃখ, হা-পিত্যেস। কীভাবে ভোগ করবে। এখন তো আর সেই যৌবনকাল নেই। শরীরে শিকার করার মতো সতেজতা নেই, চনমনে ভাবটা নেই। বয়স হয়ে গেছে সারসের। এতই বৃদ্ধ হয়ে পড়েছে যে ছোট্ট মাছটিকে পর্যন্ত শিকার করার শক্তি এখন আর তার নেই। খাবে কীভাবে! প্রশান্ত চোখগুলো তার সে কারণেই ম্লান হয়ে আছে।

অথচ ওই ম্লান চোখের আড়ালে ছিল তার ভোগ করতে না পারার বেদনা। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে তো না খেয়ে না দেয়ে অভুক্ত থেকেই মারা পড়তে হবে। কিন্তু সে কী করে হয়! যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ করে যেতে হবে চেষ্টা প্রচেষ্টা পর্বত সমান। হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না। বার্ধক্যকে বুদ্ধি দিয়ে, মেধা দিয়ে জয় করতে হবে। শারীরিক শক্তি দিয়ে না হোক অন্য কোনো মেধাবী কৌশল প্রয়োগ করে হলেও খাবারের আয়োজন করতে হবে। পেটে তো কিছু দিতে হবে। কিন্তু কী করা যায়, কী করা যায়...। পানির দিকে অপলক দৃষ্টিতে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেই এসব ভাবছিল সারস পাখি।

পুকুর পাড়ের একটা কাঁকড়ার গর্তের মুখে দাঁড়িয়ে আ..হ্.... উঁ.... শব্দ করলো সারস। কাঁকড়া তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সারসকে জিজ্ঞেস করলো: কী হয়েছে তোমার! তোমাকে এরকম বিমর্ষ, ক্লান্ত লাগছে কেন?

সারস কাঁকড়াকে বলল: কী আর বলব। আমার জীবনের সকল হাঁসি আনন্দ শেষ হয়ে গেছে। বুড়ো হয়ে গেছি। তাই দূরে কোথাও না গিয়ে এই পুকুরটার তীরেই এখন জীবন কাটাচ্ছি। ভালোই তো কাটছিল। কোনো সমস্যাই ছিল না। যখন যা জুটতো খেতাম। কিন্তু এখন দেখছি বাঁচার আর কোনো সুযোগ দেখছি না।

কাঁকড়া জিজ্ঞেস করলো: কেন কী হয়েছে...!

সারস বলল: আজই দু জন মাছ শিকারী এই পুকুরপাড় দিয়ে যাচ্ছিল। পুকুরের দিকে তাকিয়ে তারা মাছগুলোকে দেখে বলল: দু তিন দিন পর তারা এই পুকুরের মাছ শিকার করতে আসবে। কোনো এক হ্রদে নাকি মাছ ধরতে গেছে। সেখানে মাছ ধরা শেষ করেই তারা এখানে আসবে এবং সব মাছ ধরে নিয়ে যাবে।

সারসের কথা শুনে কাঁকড়া খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি মাছদেরকে খবরটা পৌঁছিয়ে দিল। মাছেরা তো এ খবর শুনেই ভড়কে গেল। তারা কী করবে ভেবে না পেয়ে কাঁকড়ার চারপাশে সমবেত হলো। একটি মাছ বলল: এখন এই পুকুর থেকে আমরা কোথায় যাবো, কীভাবে যাবো! আমরা তো নিজেরা পারবো না অন্য কোনো পুকুরে যেতে..! আমাদেরকে সাহায্য করতে পারে কেবল সারস পাখি। তার কাছে যাওয়া দরকার। এই বলে মাছেরা কাঁকড়ার সাথে পুকুরপাড়ে এল সারসের সাথে পরামর্শ করতে। সারস তো একবুক বিষন্নতা বুকে নিয়ে বেকার, নিঃসঙ্গ বসেছিল পুকুরপাড়ে। তাই মাছের সমবেত মিছিল দেখে খুশি হয়ে গেল।

মাছেরা সারসকে জিজ্ঞেস করলো: তোমরা কী মনে হয়, মাছ শিকারীরা কবে নাগাদ এখানে আসতে পারে?

সারস এতক্ষণ তারা পাখা দুটো বিস্তার করে রেখেছিল। এবার পাখা গুটিয়ে নিয়ে বলল: একেবারে সঠিক দিনক্ষণ বলতে পারব না, তবে যেরকম শুনেছি সম্ভবত দু'একদিনের মধ্যে আসতে পারে।

মাছেরা বলল: আচ্ছা, তুমি কি আমাদের একটু সাহায্য করতে পার!

অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকা সারস বলল: হ্যাঁ, অবশ্যই। জানি, আমাদের মাঝে শত্রুতা আছে...কিন্তু বিপদের সময় কি আর সেসব মনে রাখতে হয়! পরস্পরকে সাহায্য করতে হয়। আমি আরেকটা পুকুরের কথা জানি। এখান থেকে একটু দূরে। ওই পুকুরটা বেশ নিরাপদ, কোনো শিকারী যেতে পারবে না সেখানে। কিন্তু আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি...এখন আর শরীরে শক্তি নেই। তোমাদেরকে একবারে নিয়ে যেতে পারব না আমি। একেক করে নিয়ে যাব, তাতে অন্তত দু দিন সময় লেগে যেতে পারে।

মাছেরা রাজি হয়ে গেল এবং সারস পাখি তার কাজ শুরু করে দিল। প্রতিদিন দু'বার কয়েকটা করে মাছ নিয়ে যেতে লাগল এবং বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই তাদেরকে নিয়ে কী করতো সারস। বেশ কয়েকটা দিন ভালোই কাটল সারসের। তাজা তাজা মাছ খেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল সে। কয়েকদিন পর কাঁকড়া বলল: চল তো, নতুন হ্রদে যাই... মাছগুলো সেখানে কেমন আছে, খোঁজখবর এনে তাদের বন্ধুদের জানাই।

সারস মনে মনে বলল: কাঁকড়া যেভাবে মাছের জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে..সমস্যা হতে পারে। ও যদি আসল ঘটনা জেনে ফেলে তাহলে অন্যান্য মাছকে বলে দেবে এবং তারা আর আমাকে বিশ্বাস করবে না। অতএব কাঁকড়াকেও মাছের মতো একইরকম ভাগ্য বরণ করানো হলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। আমাকে আর ডিস্টার্ব করার কেউ থাকবে না। আমার অপকর্মেরও সাক্ষী থাকবে না। তাই সে কাঁকড়াকে বলল: খুব ভালো চিন্তা তো!

এই বলেই সারস কাঁকড়াকে পিঠে চড়িয়ে উড়াল দিল আকাশে। সারস চেয়েছিলো কাঁকড়াকে উপর থেকে এমন একটা জায়গায় ফেলে দেবে। কিন্তু কাঁকড়া ছিল বেশ সচেতন। সে টিলার ওপর মাছের কাঁটা দেখতে পেয়েছিল। দেখেই বুঝতে পেরেছিল সারস মাছদের সাথে প্রতারণা করেছে। সাহায্য করার বাহানায় বেচারা মাছগুলোকে খেয়ে ফেলেছে। কাঁকড়া আরো বুঝতে পেরেছিলো যে তার জীবনও মাছেদের মতোই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল সে প্রতিশোধ নেবে। এই ভেবে কাঁকড়া তার কাঁচির মতো ধারালো আর সাঁড়াশির মতো কঠিন অস্ত্র দুটি দিয়ে সারসের গলায় বেড়ি পরাল এবং চাপ দিতে লাগল। সারসের দম বন্ধ হয়ে গেল এবং উভয়েই নিচে মাটিতে পড়ে গেল।

কাঁকড়া যখন নিশ্চিত হলো সারস মরে গেছে, বেড়ি খুলে ফেলল। তাড়াতাড়ি করে মাছেদের কাছে ফিরে গিয়ে সারসের প্রতারণার কথা এবং তার মৃত্যুর কথাও জানাল। মাছেরা তাদের সঙ্গী সাথীদের হারানোর বেদনায় যন্ত্রণাকাতর হয়ে পড়ল। তবে অনেক প্রাণের বিনিময়ে তারা শিখলো: শত্রুকে কখনো বিশ্বাস করতে নেই এবং শত্রুর কাছে কখনো কোনোরকম কল্যাণ আশা করতে নেই।

বিষয়: বিবিধ

১৭৯৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

214401
২৮ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:৫১
সুমাইয়া হাবীবা লিখেছেন : অসাধারন গল্প। খুব ভালো লাগলো। ছোটবেলায় পড়েছিলাম। আজ আবার মনে করিয়ে দিলেন। শেয়ার করলাম।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File