ইসলামে শিক্ষাদানের পদ্ধতি
লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ২২ এপ্রিল, ২০১৪, ০৩:৪১:৩৫ দুপুর
ইসলামে শিক্ষাদানের পদ্ধতি ও ব্যবস্থার ওপর চোখ বুলানোর পূর্বে একটি উড়ন্ত দৃষ্টি বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ড এবং এর অফিসের প্রাচুর্যের ওপর দেয়া হোক। এ সব অফিসের কর্মকর্তাদের সংখ্যা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিয়ম-কানুনের যে জাল বিস্তৃত রয়েছে এর পরিসর ও এর উপর লক্ষ-কোটি টাকার ব্যয় এবং ব্যয়ের সাথে শিক্ষার্থীদের ব্যয়ের খাতের ওপরও দৃষ্টি দেয়া হোক। এসবের পর যে জ্ঞান ও শাস্ত্র তাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয় তার শতভাগ যোগ্যতা ক’জন ছাত্রের অর্জিত হয় এবং এ শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের চরিত্র গঠনে কতটুকু ভূমিকা রাখে এর উপর নজর দেয়া হোক। এরপর জ্ঞানের আধার নবিগণের সর্দার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদত্ত শিক্ষা কারিকুলামের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হোক যে তা কত সহজ-সরল মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এরমধ্যে রাষ্ট্রের বিশাল অঙ্কের খরচও নেই এবং শিক্ষার্থীর ওপর এক পয়সারও ভার নেই।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের প্রতিটি ঘরকে এমন প্রাথমিক বিদ্যালয় বানিয়ে দিয়েছেন, যেসব বিদ্যালয়ে কচিকাঁচারদল নিজের প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ করতে করতে বেড়ে উঠে। শিশুর বয়স যখন সাত বছরে উপনীত হয় তখন স্বভাবগতভাবেই পবিত্রতা-অপবিত্রতার পার্থক্য তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। ওই সময় মাতা-পিতাকে শরীয়ত এই হুকুম দিয়েছে যে, তাকে নামায শেখাও; সাথে সাথে মসজিদে নিয়ে যাও। অধিকাংশ মসজিদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কাজ অঞ্জাম দেয়। যদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় তাহলে দেখা যায় আমাদের মসজিদসমূহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্থলাভিষিক্ত। এখানে সর্বশ্রেণীর আলেম-উলামা সমবেত হন। তাদের ওয়াজ- নসীহত পেশ করেন। তাদের সোহবতের বদৌলতে ইলম ও প্রজ্ঞার দরজা উন্মুক্ত হয় যা প্রচুর পরিমাণ গ্রন্থাদি মন্তব্য করেও লাভ করা যায় না। এই ইলম হাসিল হয় কেবল উলামায়ে কেরামের সাহচর্যের ফলে। এছাড়াও সাধারণ মুসলমানদের ওপর রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দায়িত্ব অর্পণ করে দিয়েছেন যে, ‘যদি তুমি তোমার কোন মুসলমান ভাইকে অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকতে দেখ তাহলে তাকে এ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করো। যদি সম্ভব হয় তাহলে তাকে হাত দ্বারা বাধা দাও। তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে তাকে মুখের ভাষায় বুঝিয়ে দাও। আর যদি তাও সম্ভব না হয় তাহলে মন্দ কর্মটিকে মনে প্রাণে ঘৃণা করো।’ হাত দ্বারা বাধা দেয়ার পদ্ধতি দুটি। যথা-
এক. আইনের শক্তিবলে শাসকগণ কর্তৃক বিধি-নিষেধ আরোপ করা।
দুই. নিজের বন্ধু-বান্ধব ও সন্তান-সন্তুতি যাদের ওপর তার অধিকার রয়েছে তাদেরকে দরদমাখা ভাষায় বুঝিয়ে দেয়া।
চিন্তা করুন, যখন প্রত্যেক মুসলমানকে উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, যদি দ্বীনের কোন বিষয় তার জানা থাকে, আর সে কাউকে-এর বিপরীত করতে দেখে, তাহলে তার কর্তব্য হল ওই বিষয়টি তাকে জানিয়ে দেয়া এবং শরীয়ত পরিপন্থী কাজ হতে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা। তখন এ মূলনীতির যথার্থ বাস্তবায়নে দ্বীনি শিক্ষার প্রচার-প্রসার কত সহজ পদ্ধতিতে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। নামাজ ঘরে সম্পন্ন করা যেত কিন্তু এর জন্য মসজিদে সমবেত হওয়ার বিধানের মধ্যে একটি বিরাট কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যদি এক মুসলমান অপর মুসলমানের আয়না হয়ে তার ভুল পদক্ষেপগুলোর ওপর সর্তক করে তাহলে সমগ্র জাতির শিক্ষা ও ধর্ম-প্রশিক্ষণ এক সাথে সম্পন্ন হয়ে যায়। যা না কোন স্কুলে অর্জন করা সম্ভব ছিল আর না কোন মাদ্রাসায়। তবে অন্যকে তার ভুলের ওপর সতর্ক করার জন্য দরদ ও কল্যাণ কামনার গুণ থাকা অপরিহার্য। যার ভুল সংশোধন করা হবে তার অন্তরে যেন আঘাত না লাগে এবং মোকাবেলায় এগিয়ে না আসে সেভাবে দাওয়াত দিতে হবে। মহাগ্রন্থ আল কোরআন যেখানে হকের দাওয়াত দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে সেখানে দাওয়াতের শর্ত ও আদব উল্লেখ করে বলেছে, ‘তোমার প্রতিপালকের পথের দিকে প্রজ্ঞা ও কল্যাণ কামনার সাথে আহ্বান করো।’ এখানে প্রজ্ঞা দ্বারা উদ্দেশ্যে হল দাওয়াত দেয়ার পূর্বে এ কথা চিন্তা করা যে, যাকে দাওয়াত দেয়া হবে তাকে কোন সময় কোন অবস্থায়, কোন পদ্ধতিতে ও কি বলে দাওয়াত দিবে যা তার অন্তরে প্রভাব সৃষ্টি করবে। তাছাড়া দাওয়াতও দিতে হবে কল্যাণকামনাকে সামনে রেখে। এ ক্ষেত্রে নিজের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা ও অন্যকে অপদস্ত করার হীন উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। আয়াতে মাওইযা শব্দের সাথে হাসানা শব্দ যুক্ত করে এর ওপরই সর্তক করা হয়েছে।
মোটকথা! রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিক নির্দেশনাগুলোর ওপর যদি সঠিকভাবে আমল করা হয় তাহলে প্রতিটি শিশুর জন্য তার মায়ের কোল ও ঘর একটি আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে যায়। অনুরূপভাবে মসজিদ তার জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপ নেয়। যার মধ্যে ইলম অর্জনের সাথে আমল এবং শিক্ষা অর্জনের যে মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে মানুষ হওয়া তা সম্পন্ন হতে থাকে।
উচ্চ শিক্ষা : উচ্চ শিক্ষার জন্য ইসলামের প্রাথমিক যুগসমূহে উলামায়ে কেরামের শিক্ষাদানের মজলিস এবং পঠন-পাঠনের হালকাসমূহ বিভিন্ন শহর ও উপশহরে চালু ছিল। এ উচ্চ শিক্ষাও সম্পূর্ণ বিনা খরচে সম্পন্ন করা হত। পরবর্তীতে স্বতন্ত্র বিদ্যালয় ও গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ভাষা শিক্ষা : সব শিক্ষানীতি কোরআন-হাদীসে বিদ্যমান ছিল। রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি ও যুদ্ধনীতির প্রয়োজনে যেসব কাজ শিক্ষা করা জরুরি এগুলোর ব্যবস্থাপনাও এই আড়ম্বরহীন জীবন বিধানের সাথে অব্যাহত ছিল। বদর যুদ্ধের বন্দিদের মধ্যে যারা লেখাপড়া জানত তাদেরকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল যেন তারা নিরক্ষর সাহাবায়ে কেরামকে লেখাপড়া শেখায়। মাতৃভাষা ছাড়াও অন্যান্য ভাষা জানা এবং শিক্ষা লাভ করার পরিমিত ব্যবস্থা ছিল। রোম, পারস্য ও আবিসিনীয় ভাষায় ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিদ্যমান ছিলেন।
কারিগরি বিদ্যার ব্যবস্থাপনা : ইসলামের প্রাথমিক যুগসমূহে কারিগরি ও কলা বিদ্যা শেখা ও শেখানোর ধারা অব্যাহত ছিল। দু’ একটি ঘটনা এমনও ঘটেছে যে, এ বিদ্যা ভিনদেশে গিয়েও শিখে আসা হয়েছে।
যুদ্ধাস্ত্র তৈরির প্রতি মনোযোগ : হাফেযে হাদীস আল্লামা ইবনে কাসীর তার প্রণীতগ্রন্থ আল বিদায়া ওয়ান-নিহায়ায় লিখেছেন, উরওয়া ইবনে মাসউদ এবং গাইলান ইবনে সালমা রাযি. হুনাইনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কারণ তারা যুদ্ধের কতিপয় অস্ত্র তৈরি করা শেখার জন্যে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। বাড়িতে অবস্থানকালে তারা সে সময়ের প্রচলিত কামান ও ট্যাংক তৈরি করা শিখেন। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/৩৪৫।
এখানে ট্যাংক দ্বারা উদ্দেশ্য হল কেল্লা ঘেরাও করার সময় তীর ও তরবারির প্রবল বর্ষণ থেকে বেঁচে কেল্লা পর্যন্ত নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাওয়ার এক প্রকার অস্ত্র। আজকের ট্যাংক মূলত ওই প্রাচীন ট্যাংকেরই ক্রমবর্ধমান উন্নতরূপ। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কতিপয় ব্যক্তির নিকট শুনেছি যে, ইংরেজরা মাইসূর নামক কেল্লা ধ্বংস করার সময় ওই প্রকার ট্যাংক ব্যবহার করেছিল।
উপরে উল্লেখিত ইসলামের প্রথমিক যুগের কামান দ্বারা উদ্দেশ্য হল ওই অস্ত্র যার দ্বারা ভারি পাথর উঠিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করা হত। আজকের বিশ্বের ক্ষেপণাস্ত্র তারই উন্নত বংশধর! কেল্লা বিধ্বংসী কামানসমূহ আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে একেই ব্যবহার করা হত। মুহাম্মাদ বিন কাসিম সিন্ধু বিজয়ের সময় সর্বপ্রথম দেবল বন্দরে কেল্লার ওপর তা ব্যবহার করে ছিলেন।
চিন্তা করুন, কত আড়ম্বরহীনভাবে বিনা খরচে শিক্ষাদান ও গ্রহণের এ বিরল ব্যবস্থা! যার মধ্যে শিক্ষাগত পূর্ণ যোগ্যতা, চারিত্রিক ও মানসিক উন্নতি ও আমলের সুদৃঢ় বাস্তবায়ন একসাথে সম্পাদিত হচ্ছে। আর শিক্ষা অর্জনের মূল উদ্দেশ্যে তথা মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষ বানানো পূর্ণ হচ্ছে। হযরত আবু বকর ও উমর ফারুক রাযি. কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত ছিলেন না। হযরত উসমান গণি ও আলী রাযি. ভিন্নদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেননি। হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ, আবু উবায়দ্য ইবনুল জাররাহ, আমর ইবনুল আস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. আল্লাহু আনহুম প্রমুখ এই অনাড়াম্বর শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ ছাড়া অন্য কোথাও গিয়ে শিক্ষা অর্জন করেননি। খোলাফায়ে রাশেদার স্বর্ণযুগ, হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ রাযি. এর সমরনৈপূণ্যসহ অপরাপর সাহাবায়ে কেরামের কীর্তিসমূহ এই পৃথিবীর বুকে দিবালোকের ন্যায় ভাস্বর হয়ে থাকবে।
উপসংহার : বাস্তব কথা হল, মহাগ্রন্থ’ আল কোরআনের শিক্ষাসমূহ যদি সঠিকভাবে অর্জন করা যায় তাহলে মানুষের ব্যক্তিজীবন ও সমাজ জীবনের এমন কোন দিক নেই যার সুস্পষ্ট নির্দেশনা আল কোরআনে বিদ্যামান নেই। ব্যক্তিজীবন ও গার্হস্থ্যজীবনের খুঁটিনাটি দিক থেকে নিয়ে গোত্রীয়, আন্ত:দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত যাবতীয় কর্ম পদ্ধতি এতে বিদ্যমান রয়েছে। যদি এর ওপর আমল করা হয় তাহলে নিখিল বিশ্ব সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা ও প্রশান্তির নীড়ে পরিণত হবে। আর এটি এমন এক বাস্তব সত্য যা কেবল মুসলমানদের বিরুদ্ধে যারা সদা তৎপর থাকে তাদের ও স্বীকার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
মুফতি মুহাম্মাদ শফী রহ.।
অনুবাদ : আবদুল কাইয়ূম শেখ। (সংগৃহীত)
বিষয়: বিবিধ
১১৬৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এখন শিক্ষা হয়ে গেছে অন্যসব কিছুর মতই পন্য। পয়সা ছাড়া কেউ ভাল শিক্ষা পায়না। অথচ ইসলামের পতন যুগে যখন উপমহাদেশে নবাবি শাসন চলছে তখনকার পর্যটক রাও লিখেছেন শিক্ষার ক্ষেত্রে সাধারন মানুষ আর উজিরের ছেলের প্রাপ্ত সুযোগসুবিধার কোন পার্থক্য নাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন