নির্বাচন এক রেকর্ড অসংখ্য
লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ০৬ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৬:০০:৩২ সন্ধ্যা
রোববার ইতিহাস গড়া এক ব্যতিক্রমী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। সব দিক থেকেই রেকর্ড গড়ল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এত বেশি সহিংসতা, ভোট কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, ব্যালটবাক্স ও ব্যালটপেপার লুটপাট-ছিনতাইয়ের আতংক, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, এত বেশি সংখ্যক মানুষ নিহত, এত বেশি ব্যয়, এত কম ভোটার উপস্থিতি, এত কম প্রার্থীর অংশগ্রহণে অতীতে আর কোনো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রধান বিরোধী দল ছাড়া একতরফা নির্বাচন করায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে ইতিহাসের পাতায় এ নির্বাচন খারাপ নজির হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন তারা।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে ১৪টি রাজনৈতিক দলের বারো শতাধিক প্রার্থী এবং ১২০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। ভোট পড়ে ৫৫ শতাংশেরও বেশি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন ১১ জন প্রার্থী। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। ৬ বছর পর ১৯৭৯ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাতে অংশ নেন ২৯টি রাজনৈতিক দলের আড়াই হাজারেরও বেশি প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন চার শতাধিক। এতে ৫১ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়ে। ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে। ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে বিএনপি ছাড়াও অংশ নেন ২৮টি রাজনৈতিক দলের প্রায় ২ হাজার প্রার্থী ও চার শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক শাসন থেকে বেরিয়ে গণতন্ত্রের কথা বলে প্রতিষ্ঠিত হয় এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬৩ শতাংশ। দু’বছরের মাথায় চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ। বিএনপি ও আওয়ামী লীগবিহীন ওই নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসে এরশাদের জাতীয় পার্টি। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম- মাত্র ৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয় ওই নির্বাচনে। ১ হাজার ২০০ দলীয় ও ২১৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ১৮ জন।
এরশাদ সরকারের পতনের পর ’৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে ৭৫টি রাজনৈতিক দলের প্রায় ৩ হাজার প্রার্থী অংশ নেন। ভোট পড়ে ৫৫ শতাংশ। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে বিএনপি। ৫ বছর পর সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সে সময়কার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের আন্দোলন উপেক্ষা করে ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি না মানায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি দল। নির্বাচনে ৪১টি দলের প্রায় ২ হাজার প্রার্থী ও ৯৯৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ নেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ৪৯ প্রার্থী। ভোট পড়ে মাত্র ২৬ শতাংশ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি।
ষষ্ঠ সংসদ গঠনের মাত্র চার মাসের মাথায় একই বছরের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক ৮১টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। সব দলের প্রায় আড়াই হাজার প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ভোট পড়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৪টি রাজনৈতিক দলের প্রায় ২ হাজার প্রার্থী অংশ নেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ৪৮৪ জন। ভোট পড়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। এর ৭ বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নিবন্ধিত ৩৮টি রাজনৈতিক দলের ৩ হাজারেরও বেশি এবং ১৪১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ওই নির্বাচনে অংশ নেন। রেকর্ড ৮৭ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়ে। দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
এবার ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ফলে নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন সাধারণ মানুষ। বাকি ১৪৭টি আসনের ১৮ হাজার ২০৮টি কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। এতে ৩৮৬ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। আর নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অংশ নেয় মাত্র ১২টি দল। নির্বাচনের দু’দিন আগ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোট কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, ব্যালটপেপার ও নির্বাচনী সামগ্রী লুটপাট শুরু হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় প্রায় দেড়শ’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিপুলসংখ্যক আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করেও শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় সরকার। ফলে ভোটাদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। তাই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোটও কাস্ট হয়েছে অতীতের সব নির্বাচনের তুলনায় কম। সংঘাত আর অগ্নিসংযোগের কারণে দেশের পাঁচ শতাধিক ভোট কেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ ও স্থগিত করা হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিহতের খবর পাওয়া যায় ২০ জনের মতো। বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনকে ঘিরে যে সহিংসতা হয়েছে তা অতীতের কোনো নির্বাচনে দেখেননি দেশবাসী।
ব্যয়ের দিক থেকেও রেকর্ড গড়েছে এবারের নির্বাচন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে ১৬৫ কোটি টাকার কিছু বেশি। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় হয়েছিল ৭২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর আগের নির্বাচনগুলোর ব্যয় আরও অনেক কম ছিল। আর এবারের নির্বাচনে প্রথম ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০০ কোটি টাকা। তবে পরবর্তী সময়ে অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় এ ব্যয় ২৯১ কোটি টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। শুধু নির্বাচনী ব্যয় নয়, সহিংসতা, হত্যা, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন দিক থেকেও অনেক এগিয়ে এবারের নির্বাচন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত বিরোধী দলের ২৭ দিনের হরতাল-অবরোধে প্রায় দেড়শ’ লোকের প্রাণহানী ঘটে।
এর আগে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি বিএনপির একতরফা নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতায়ও এত মানুষের প্রাণ যায়নি। ১৯৯৬ সালের ৩ মার্চ সংবাদ পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে সহিংসতায় ৪১ জন মারা যান। আর ভোরের কাগজ ও আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯৬ সালের ১ থেকে ১৫ ফেব্র“য়ারির মধ্যে নির্বাচনকালীন সহিংসতায় মারা গেছেন ২৮ জন। আহত ব্যক্তিদের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।
২০০১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও তার আগে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আগের এক সপ্তাহে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় অন্তত ৩৮ জন প্রাণ হারান। আহত হন কমপক্ষে ১ হাজার ৬৭২ জন। নির্বাচনী এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, পেশিশক্তি প্রদর্শন প্রভৃতি ছিল এ সহিংসতার কারণ। বছরজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতাও ছিল অনেক।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে সবচেয়ে নির্বিঘ্নে। নির্বাচনের আগে-পরে সহিংসতার তেমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। পাতার পর পাতা উল্টিয়েও পাওয়া যায়নি নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যুর খবর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সালে গোটা বছরজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন মাত্র চারজন।
নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার পাশাপাশি ২০১৩ সাল রাজনৈতিক সহিংসতায় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রাণহানীর বছর। আসকের পরিসংখ্যান বলছে, বছরজুড়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় এবং বছরের শেষদিকে একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ও বিরোধী জোটের অবরোধ কর্মসূচির মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সারা বছরে ৫০৭ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ২২ হাজার ৪০৭ জন। এবারের নির্বাচনের সহিংসতার ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, মনে হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করার কারণেই এমনটি হয়েছে। ১৯৯৬ সালেও তখনকার প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা অংশগ্রহণ করেনি। আবার ’৮৬-তে বিএনপি এবং ’৮৮-তে এরশাদের সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তিনি বলেন, ওই সময়কার নির্বাচনগুলোর সঙ্গে ’৯১ পরবর্তী নির্বাচনগুলোর একটা গুণগত পরিবর্তন ছিল। এর আগের নির্বাচনগুলোর কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। কিন্তু ’৯১’র পরে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা এসেছে। ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গেছেন। ’৯৬’র নির্বাচন ছাড়া বাকিগুলোতে ৭৫ থেকে ৮৭ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে। কারণ নির্বাচনের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। সহিংসতা ছিল খুবই কম। ভোট কেন্দ্রে সহিংসতা ছিল না বললেই চলে।Click this link
বিষয়: বিবিধ
১০৮৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন