অন্যায়কে যেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে !

লিখেছেন লিখেছেন েনেসাঁ ০৭ জানুয়ারি, ২০১৪, ১২:৫০:২৬ রাত

বাংলাদেশ হলো এমনই এক রাষ্ট্র যে রাষ্ট্র দুর্নীতির সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে এবং দুর্নীতিবাজকে ভালোবাসাও হয়। দুর্নীতি এই দেশে কোনো ঘৃণার বস্তু নয়। দুর্নীতি হলো গৌরবের। এটা কেন হবে? এটা হচ্ছে এই জন্য যে, দুর্নীতি ধরার কেউ নেই। অন্য বিষয় হচ্ছে, বড় দুর্নীতিগুলো হচ্ছে সরকারি দফতরের পদগুলো ব্যবহার করেই। এই সরকারি পদগুলোর মধ্যে আছে যারা কার্যত জনপ্রতিনিধি তাদের পদগুলোও। জনপ্রতিনিধিদের কোনো রকম জবাবদিহিতা না থাকার ফলে সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত অন্য কর্মকর্তারাও দুর্নীতি করছেন অনেকটা প্রতিযোগিতা দিয়ে। বলা চলে, সরকারি পদের অপব্যবহার ও অতি ব্যবহার করে দুর্নীতিতে প্রথমদিকে আছেন সেই জনপ্রতিনিধিরা, যারা আবার নিজেরা নিজেদের জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেন। তাদের হাতে এত ক্ষমতা যে, তাদের কাজকর্মকে প্রশ্ন করার সাহস ও ক্ষমতা অন্য কোনো সংস্থা বা কমিশনের নেই।

দুর্নীতি ঠেকানো বা রোধ করার জন্য জনগণের অর্থে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক গঠন করা হয়েছে; কিন্তু আইন দ্বারা এই দুদকের ক্ষমতাকে এমনভাবে খর্ব করা হয়েছে, সে দুদক কার্যত এখন অচল। আর আইনও প্রণয়ন করেছে ওরা যারা দুর্নীতিতে বেশ ওপরে আছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। জনগণের কথিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমাজে ট্যাক্স দেয়নি বলে কোনো জনপ্রতিনিধি তার পদ হারাননি। কিংবা বেআইনিভাবে কোনো লোককে নিয়োগ দিয়েছেন বলে তাকে কখনও কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি। দুদক ক্ষমতাহীন বলে এবং বিচার বিভাগের দুর্নীতির ক্ষেত্রে দূরে অবস্থানের অভাবে এ দেশে দুর্নীতিবাজরা শেষ পর্যন্ত সফল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

সত্য হলো, এই সমাজের সফল রাজনীতিবিদদের অনেকেই দুর্নীতিবাজ, আর সফল ব্যবসায়ীদেরও অনেকেই দুর্নীতিবাজ। সরকারি সুযোগগুলো শুধু ক্ষমতায় আছে এমন লোকদের জন্যই অবারিত। জনগণ ট্যাক্স দিচ্ছে, সেই ট্যাক্সের অর্থ লোপাট হচ্ছে উন্নয়ন ব্যয়ের বরাদ্দ দেয়ার নামে, উন্নয়ন ব্যয়ে অর্থ খরচ করার নামে। সারা বাংলাদেশে দুর্নীতি হচ্ছে, একজনকে চাকরি দেয়ার নামে তার থেকে অর্থ নেয়া হচ্ছে। আবার চাকরিতে প্রমোশনের ক্ষেত্রেও অর্থ নেয়া হচ্ছে। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে ঘুষ নেয়া হচ্ছে। আবার এখন শুনছি শিক্ষকরা নিজেদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে ছাত্রকে কম নম্বর দেন। এভাবে সর্বত্রই যদি দুর্নীতি বিস্তারলাভ করে তাহলে এর বাইরে আছে কে? হ্যাঁ, এর বাইরে আছে দুই শ্রেণীর লোক। এক শ্রেণী হলো যারা সৎ থাকতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারা। তারা জীবনের কোনো সময়েই দুর্নীতি করেননি। দুর্নীতি করে সম্পদ জোগাড় করবেন এটা তাদের মনের অবস্থার বিরুদ্ধে ছিল। দুর্নীতির ক্ষেত্রে প্রথাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কোনো পক্ষে-বিপক্ষের উপাদান নয়। অর্থাৎ দুর্নীতি শিক্ষিত লোকেরাও করতে পারে, আবার কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোকেরাও করতে পারে। তবে শিক্ষিত লোকেরা দুর্নীতিবাজ হলে সে বড় রকমের দুর্নীতিবাজ হয়। তারা শিক্ষাকে কাজে লাগায় কীভাবে চাতুরিপনার আশ্রয়ে অর্জিত বোধ-বুদ্ধিকে ব্যবহার করা যায় দুর্নীতি করার কাজে।

দুর্নীতির সঙ্গে যদি কম শিক্ষার সম্পর্ক থাকত তাহলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিদের নামে এত বড় বড় দুর্নীতির খবর বের হতো না। সুতরাং পিএইচডিধারী লোকই যে দুর্নীতিবাজ হবে না, এমন নয়। বরং পিএইচডি সাহেব দুর্নীতিবাজ হলে উনি অতি নিকৃষ্ট স্তরের দুর্নীতিবাজ হন।

দুর্নীতি করার জন্য সরকারি সংস্থার মন্ত্রণালয়ে, কমিশনে, কমিটিতে পদ আছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে কীভাবে দুর্নীতি হচ্ছে? সেখানে দুর্নীতি করছেন যারা ঋণ বরাদ্দ ও ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক-নেতিবাচক নোট দিচ্ছেন, যারা ঋণ বরাদ্দ ও ঋণ মাফের জন্য নোটকে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করছেন, যারা ঋণের জন্য সুপারিশপত্র বোর্ড সভায় উপস্থাপন করছেন এবং যারা শেষ পর্যন্ত ব্যাংক নোটের সুপারিশ অনুযায়ী ঋণ বরাদ্দ বা ঋণের সুদ মাফ করছেন। এই পুরো প্রক্রিয়ায় কিছু কিছু লোক তো অবশ্যই সৎ থাকেন। কিন্তু যারা সৎ থাকেন তারা অসহায় বোধ করেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারাও নোট সই করেন কিংবা পর্ষদে বসে হ্যাঁ-না বলেন। দুর্নীতিবাজরা জানেন এই সৎ লোকগুলো হলো সংখ্যায় অতি নগণ্য। তারা মন্দ কাজের বা দুর্নীতিকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাখেন না।

সরকারি দফতরগুলোতে অনেক কেনাকাটা হয়। এই কেনাকাটায় দুর্নীতি হচ্ছে। অর্থ ব্যয় এবং অর্থ আহরণ সেখানেই আছে, যেখানেই দুর্নীতি হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা যে কী পরিমাণ দুর্নীতি করেছেন তার সামান্য নমুনা তো নির্বাচন কমিশনে দেয়া তাদের নিজেদের হলফনামাই প্রমাণ করে। আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্য পূর্ণকালীন কোনো ব্যবসা বা চাকরি করতে পারেন না, এমনকি কোনো কোম্পানি গঠন ও পরিচালনাও করতে পারবেন না। আইনটি এজন্য করা হয়েছে, যাতে তারা স্বপদকে ব্যবহার করে অসম কোনো সুযোগ নিতে না পারেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থা কী? তারা হলেন স্কুল-কলেজের গভর্নিং বোর্ডের প্রধান। তাদের নামে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে যে, তারা ছাত্র ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগে অর্থ নিয়েছেন। অবস্থাটা হলো, যারা পদ ও ক্ষমতার মালিক তারা কোনো জবাবদিহিতার মধ্যেই নেই। সম্পদ অনুযায়ী তারা ট্যাক্সও দেন না।

সরকারি সুযোগগুলোকে নিজ স্বার্থে তারা অবাধে ব্যবহার করেন। এ অবস্থায় প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারী সৎ থাকবে, সেটা আশা করা যায় না। যেসব লোক দুর্নীতি করা যায় না এমন পদগুলোতে থাকেন তারা সদাই তদবিরে ব্যস্ত থাকেন কখন সেই সব কথিত ভালো পোস্টিংগুলোতে যাওয়া যায়। দুর্নীতিবিরোধী অনেক কথা হয়েছে; কিন্তু সত্য হলো বাংলাদেশে দুর্নীতি শুধু বেড়েছেই। বাংলাদেশের দুর্নীতির তুলনা হয় ওইসব দেশের দুর্নীতির সঙ্গে যেগুলো পূর্ণ ব্যর্থরাষ্ট্র বা আধা ব্যর্থরাষ্ট্র। এখন সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছেন যে, এই দেশে দুর্নীতির সংস্কৃতিটা বিদায় হবে। এখন ধরেই নেয়া হয় লোকটা পদে বসে অবশ্যই দুর্নীতি করছেন। অনেকে বলেন, বেতন-ভাতা ইত্যাদি বাড়িয়ে দেয়া হলে দুর্নীতি কমে যেত, আমি তাদের এই মতের সঙ্গে একমত পোষণ করি না। কারণ যারা দুর্নীতি করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাদের বেতন-ভাতা বাড়ালেও তারা ওই পথে থেকে বিরত থাকবেন না। এটা হয়ে গেছে অভ্যাসের ব্যাপার। দুর্নীতিবাজদের আর একটা বিশ্বাস আর খোঁড়া যুক্তি হলো, সমাজের অন্য সবাই দুর্নীতি করছে। সুতরাং সে যা করছে সেটা অতি স্বাভাবিক কাজ।

বিষয়: বিবিধ

১৫৪২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

159854
০৭ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ০৭:৪৮
বুড়া মিয়া লিখেছেন : দুর্নীতির শিকড় কিন্তু ভাইয়া অনেক গভীরে; লাভ করার আশায় সামান্য ট্রেডার যে একটা পণ্য বিক্রি করে সেও কিন্তু কম দামের পণ্য বেশি দামে বেচতেছে (মানে বিক্রির সময় অর্থের পরিমাপের ওজনে কম দিচ্ছে)। এভাবে একেকজন একেকজনের লেভেল-বেষ্ট লাভ করে যাচ্ছে; কেননা সফলতার মাপকাঠি-ই তো এটা যে, কে কত বেশী লাভ করলো। মানে যে যত বড় ঠকবাজ হতে পারবে সে তত সফল সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে – এটা একটা সম্পর্ক কিংবা পরিবার থেকে শুরু করে সবখানেই।

শুধুই আমানতদারীর যে ব্যাংকিং সিষ্টেমের কথা ইতিহাসে জানা যায়, সেটা ভালো ছিল এবং ছিল মানুষের অর্থের সেফগার্ড। যেদিন থেকে আমানতের টাকা খাটিয়ে লাভ করার ইচ্ছা ব্যাংকিং সিষ্টেমের এসেছে – সেদিন থেকেই ব্যাংক ধোকাবাজী করে আসতেছে। চিন্তা করেন যে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাড়া আর কোন ব্যাংক নাই এবং অন্য কোন দেশের সাথে কোন ব্যবসা নেই – এ অবস্থায় সাধারণ ডিপোজিটর যারা লাভের আশায় টাকা জমা রাখলো তারা লাভ পাবে কোথেকে? প্রিন্ট করে দেয়া ছাড়া কোন উপায় নাই। ডিপোজিটরদের ইচ্ছাইতো এখানে অমূলক – আর এ অমূলক ইচ্ছা যদি কেউ পূরণ করতে পারে তবে ডিপোজিটররা তার কাছেই যাবে। শুধুই তাই না – ডিপোজিটরদের টাকাতো সিকিউর্ড পাওয়ার এবং যখন তা ব্যাংকের খরচের অধিকারে যায় তখন এর কোন সিক্যুরিটি নাই (মানে সমস্ত টাকা গোল্ড-সিলভার-ফরেন কারেন্সী-সিক্যুরিটি ব্যাকড, কিন্তু এ টাকায় যখন আপনারও রাইট আছে এবং ব্যাংকও ব্যবহারের করে তখন ডাবল সিক্যুরিটি থাকে না কিন্তু ডাবল পাওয়ার হয়)। এই সিক্যুরিটিহীন পাওয়ার তারা নিজেদের লাভের জন্য এবং নিজেদের ব্যবসায়-ই খাটিয়ে খায় এবং এ অধিকারতো সাধারণ মানুষ না দিলেও পারতো কিন্তু দিচ্ছে – কারণ সেভাবেই আমাদের গড়ে তোলা হয়েছে। এর ম্যানেজমেন্টও সুন্দর করে করা যায় – তবে সেটা করলে তো আর লাভ হবে না তাই করবে না।

সমস্ত দোষ আমাদের – আমরা কেন জানতে চাই না - লাভ কি? লাভ কোথেকে আসে? লাভ বলে কোন কিছুর অস্তিত্বই আছে কি নাই? আমরা কিছু না জেনে-বুঝে কেন লাভ চাই?

লাভ করার ইচ্ছাই দুর্নীতি এবং সমস্ত দুর্নীতির মূলেই এ ইচ্ছা – হালাল বলেন আর হারাম বলেন – লাভ করতে হইলে অবশ্যই আপনাকে দুর্নীতি করতেই হবে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File